সৈয়দ তোশারফ আলী

সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। জীবনানন্দ দাশের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে অন্য কবিরা বিশেষ করে কবি যশপ্রার্থীরা একমত হবেন কিনা আমি বলতে পারবো না। কারণ, আমি কবি নই, তবে সাহিত্য ও সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সুবাদে দেশের নামকরা অনেক কবিদের সঙ্গে পরিচয় ছিল। তাদের কারও কারও সঙ্গে মেলামেশা ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই পরিচয়ের সুবাদে তাদের জীবনের অন্দর মহলে ঢুকবার অবকাশ পাইনি। কবিতার পেছনে যে কবি এবং তার পেছনে যে কবির জীবন যাপন, অধ্যয়ন ও অভিজ্ঞতার জল সিঞ্চন, সে সব সম্যকভাবে না জানলে কি কবিতার মর্মভেদ করা যায়? তবে কবিতা আমার পড়তে ভাল লাগে। এর অন্যতম কারণ, কবিতার অবয়ব সংক্ষিপ্ত। কবিতার ভাব, ভাষা, উপমা, অলংকার, ছন্দ ও মিল এবং ব্যাঞ্চনা আমাকে মুগ্ধ করে। ভাল কবিতার আবৃত্তি হৃদয় ছুঁয়ে যায়। প্রসাদগুণ থাকলে গদ্য বা প্রবন্ধ পাঠেও আনন্দ পাওয়া যায়। তবে কবিতার জগৎ হচ্ছে আবেগ আর অনুভূতির জগৎ এবং প্রবন্ধের জগৎ হচ্ছে যুক্তি ও বিচার-বিশ্লেষণের জগৎ, এই দুই জগতের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে।

কবিতার ভাষায় ও প্রকাশ ভঙ্গিতে যুগে যুগে পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে আঙ্গিক ও পাঠক রুচিতে। একদা যা ছিল ভাব প্রকাশের অনবদ্য মাধ্যম তা এখন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে। উপযোগিতা বেড়েছে কথা সাহিত্যের, একে বলা হচ্ছে, গদ্য প্রতিমা। সেই সঙ্গে চাহিদা বেড়েছে ছোট গল্পের। এ সবের উপজীব্য এখন নগরে বসবাসকারী নর-নারীর আধুনিক জীবন। অর্থাৎ জীবনের নানা দিক ও নানা সম্পর্ক। সুখ-দুঃখ, ভাললাগা, ভালবাসা, প্রেম, বিরহ, দ্বন্দ্ব-বিরোধ, সংগ্রাম, সাধনা, স্বপ্ন-কল্পনা, পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম-দর্শন, যুদ্ধ, শান্তি, পতন, স্খলন, লোভ-লালসা, ত্যাগ, তিতিক্ষা, জালা-যন্ত্রণা, দুঃখ দারিদ্র্য, অনাহার বুভুক্ষা, দুর্যোগ, দুর্ঘটনা এক কথায় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনে যা কিছু ঘটতে পারে তার সব কিছু উঠে আসছে গল্প ও উপন্যাসের আধারে। মহাভারতের মত অসংখ্য চরিত্রের জন্ম হচ্ছে কথাসাহিত্যে। নানাভাবে আলো ফেলে দেখা হচ্ছে জীবনকে। কোন কিছু আড়ালে, আবডালে, অন্ধকারে থাকার সুযোগ নেই। সব কিছু চলে আসছে আলোচনার টেবিলে। কেউ সাগ্রহে দেখছে এবং উপভোগ করছে। আবার অনেকে অবজ্ঞাভরে উপেক্ষা করে যাচ্ছে। আধুনিক নর-নারীর দল এখনও ভালবাসছে, ঘর বাঁধছে, ঘর ভাঙ্গছে। বিয়ে না করেও একসঙ্গে থাকছে। বৌ থাকতে অন্যের বৌকে ফুসলিয়ে আনছে। নীতি-নৈতিকতা বা পাপবোধের বালাই নেই। জীবন প্রবাহে কোন সমাপ্তি নেই। সবাই ছুটে চলেছে। সময় নেই দাঁড়াবার, দেখবার ও মনোযগ দেবার। সময় নেই ভাববারও। সব কিছু কেড়ে নিয়েছে গতি, দুর্বার গতি। কবিতাও ছুটি নিয়েছে। গভীর ভাব ও আবেগ বিদায় নিয়েছে। অথচ প্রকৃতির সব কিছুই রয়েছে আগের মতই। সেই সুনীল আকাশ, সেই দিগন্ত বিস্তৃত ধান ক্ষেত, গম ক্ষেত। সেই মাঠ, সেই প্রান্তর, সেই নদী, সেই সাগর, সেই মহাসাগর। সেই পশু,পাখি, কীট-পতঙ্গ, জীব-জন্তু, পুষ্প, বৃক্ষ, সবুজ বনানী। সেই সকাল, সন্ধ্যা, দিবস-রজনী, সেই শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা। কিন্তু সব কিছু থেকেও মানুষ আজ নিঃস্ব। মানুষ হারিয়ে ফেলেছে তার মন, একদা তার কাছে যা ছিল অরূপ রতন। হারিয়ে ফেলেছে মানুষ তার বিশ্বাসের বিভূতি। যা তাকে যোগাতো শান্তি, শক্তি ও সাহস। যা তাকে যোগাতো এক ধরনের অভিন্নবোধ। সে আত্মনিবেদনে এবং আত্মসমর্পণে পেত অপার আনন্দ, অফুরন্ত সুখ। যেমন প্রেমিক-প্রেমিকারা পেয়ে থাকে। বিশ্বাসের জায়গায় অবিশ্বাস কিংবা সংশয় এলে সেই সুখ, সেই হাসি, সেই খুশি, সেই আনন্দ কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। বিশ্বাস একবার ভেঙ্গে গেলে নতুন ছন্দে আর জীবন গড়া যায় না। খেলার নিয়ম না মানলে খেলা চলে না। যেমন ছন্দ মিলের রেওয়াজ ভেঙ্গে কবিতা লিখলে তা শিল্প হয়ে উঠে না। তাল-লয়-সুর-এর শাসন মেনে গান গাইতে হয়। তারপরও সঙ্গীতকে প্রাণময় করে তোলার দায়িত্ব নিতে হয় শিল্পীর। গায়কী ব্যক্তিত্বের স্পর্শ পেলে তাল-লয়-সুর প্রাণ পায়। নতুবা নয়। সুরের মধ্যে একটা ঘোর আছে, নেশার মত ঘোর। এজন্য গানের প্রকার ভেদ অনুসারে সুরেরও রকম ফের আছে। ভজন কিংবা কাওয়ালী পরিবেশন করার ধরণ আলাদা। ভক্তিগীতি আর লালনগীতি একভাবে গাওয়া হয়না। রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে নজরুল ইসলামের গানেরও পার্থক্য রয়েছে। গীতি আর সঙ্গীতও এক নয়। সঙ্গীতের মধ্যে গীতিকার, সুরকার, বাজনাদারদের সমন্বিত ভূমিকা থাকে। এমনকি সুরের ভিন্নতর অভিব্যক্তি দেওয়ারও স্বাধীনতা থাকে। গীতির ক্ষেত্রে এই সুযোগ সীমিত। রবীন্দ্রনাথ অখুশী হবেন তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায় আধুনিক গান গাইতে পারেননি। রাগ সঙ্গীত আর আধুনিক সঙ্গীতও এক নয়। সুর, তাল, লয় এবং ভাব এই পার্থক্য রচনা করেছে।

কবিতা সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। ছড়া, পদ্য আর কবিতা দেখতে অভিন্ন মনে হলেও ভাবে ও ভঙ্গিতে, ছন্দে ও মিলে অনেক পাথর্ক্য রয়েছে। সময় এবং পরিবেশের সঙ্গে আঙ্গিক বদলাতে বদলাতে কবিতা এখন আগের খোলস একদম ফেলে দিয়েছে। আগে ছিল ‘অলংকৃত বনিতা’ এখন একেবারে নিরাভরণ গ্রাম্য বালিকা। কবিতার গায়ে গদ্যের হাওয়া লেগেছে। তার স্বপ্ন-কল্পনা বদলে গেছে। আগে পর্বত হয়েও বাতাসের বেগ লেগে ‘বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ’ হতে চাইতো। এখন আর কবিতা পাখা মেলে আকাশে ওড়েনা। ‘হেতা নয়, হেতা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোন খানে’, বলতে বলতে নিরুদ্দেশে হারিয়ে যায় না। সে এখন ‘ঝরা পালক’, উড়বার স্মৃতি আছে, সাধও হয়তো নিঃশেষ হয়ে যায়নি কিন্তু ‘শক্তি নাহিকো উড়িবার’। কবিতা এখন ডানা কাটা পাখি অথবা ‘উট পাখি’। নামে পাখি কিন্তু উড়তে অক্ষম। আগে কবিতার সামাজিক দায় ও দায়িত্ব ছিল। ছিল কবির মহতী অঙ্গীকারও। স্মরণীয় ‘সোনার তরী’র ‘পুরস্কার’ কবিতায় কবিগুরুর মনোবাসনা। “ধরণীর তলে গগনের গায়/ সাগরের জলে অরন্য ছায়/ আর একটুখানি নবীন আভায়/ রঙিন করিয়া দিব।” এখানেই শেষ নয়? কবির আরও অঙ্গীকার রয়েছে। কবি বলছেন, “সংসার-মাঝে কয়েকটি সুর/ রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর,/ দু’একটি কাঁটা করি দিব দূরÑ/ তার পরে ছুটি নিব।” এই অঙ্গীকার পূরণ করার পর ফলাফল কি দাঁড়াবে তাও কবির কল্পনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। কবি বলছেন, “সুখহাসি আরো হবে উজ্জ্বল,/ সুন্দর হবে নয়নের জল,/ স্নেহসুধা মাখা বাসগৃহতল/ আরো আপনার হবে।” এখানে এসে কবিতার অঙ্গীকারের ইতি টানলেই চলতো, কিন্তু কবি প্রসঙ্গটির ইতি না টেনে অঙ্গীকারের পরিধি আরও একটু বাড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, “প্রেয়সী নারীর নয়নে অধরে/ আরেকটু মধু দিয়ে যাব ভরে,/ আরেকটু স্নেহ শিশুমুখ- ‘পরে/ শিশিরের মত রবে।” কি সুন্দর, কত পেলব কবির অঙ্গীকারে ছবি! কিন্তু আধুনিক মানুষের জীবন থেকে এই সিগ্ধ ছবি হারিয়ে গেছে।

এই মর্তলোকের মানুষ কবির এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের সুফল পেলে সমাজ ও সংসারের ছবিটা কেমন দাঁড়াতো সেটা ভাবলে মনে শিহরন জাগে। মর্তলোকের জীবনকে সুন্দর, সুখী, আনন্দময় ও সৌন্দর্যমন্ডিত করার ব্যাপারে তার এই আকুলতা ও সদিচ্ছার কথা স্মরণ করলে কবির প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। দুর্ভাগ্যের বিষয় সমাজ সংসার সেদিকে ধাবিত হয়নি, রক্তক্ষরণ আর অশ্রুপাত জীবনকে বেদনা বিধুর করে চলেছে। কিন্তু সেজন্য কবির অঙ্গীকারের গুরুত্ব বিন্দুমাত্র কমেনি। আমার মত একজন অকবিও বেদনাবিহবল হই যখন আধুনিক পঞ্চ কবির অন্যতম প্রধান কবি ও সাহিত্য সমালোচক বুদ্ধদেব বসু বলেন, কবি ও কবিতার কাজ সমাজ-সংসারের হিতাহিত নিয়ে মাথা ঘামানো নয়। এসব দায়-দায়িত্ব পালন করা কবি ও কবিতার কাজ নয়। কবিতাকে হতে হবে একটা নিটোল শিল্পকর্ম। প্রকৃতিতে যেমন ফুল ফোটে ঠিক তেমনি কবিতাকেও হতে হবে মানব মনের কুসুম। সে শুধু সৌন্দর্য ছড়াবে, মন ভরাবে। তত্ত্ব, দর্শন, কিংবা সমাজ কল্যাণ তার কাজ নয়। কবির মাথামগজ থেকে ওসব চিন্তা-ভাবনা ঝেটিয়ে বিদায় করে দিতে হবে। কবিতার কোন অর্থ থাকবে না, ব্যাখ্যা থাকবে না। শিল্পীর তুলিতে, রঙে এবং রেখায় বিমূর্ত ছবি হয়ে ওঠার মত কবিতাও শব্দের অসুসঙ্গ, অনুভব এবং অনুভূতিতে, ছন্দ মিলের সংহত বন্ধনে কবিতা হয়ে উঠবে। এই সংজ্ঞা মানলে কবিতার বিশাল ভান্ডার জঞ্জাল হিসাবে পরিত্যক্ত হবে নিশ্চয়। এ রকম বোধ নিয়ে যারা আধুনিক বিশুদ্ধ কাব্য চর্চা করছেন তাদের কবিতা হারিয়ে ফেলছে সরলতা, সহবোধ্যতা। হারিয়ে ফেলছে সহজাত সৌন্দর্য। এমনিতেই আধুনিক যুগ-যন্ত্রণায় ও জটিলতায় কবিতায় আমদানি হয়েছে দুর্বোধ্যতা। এমনকি কদর্যতা ও বীভৎসতাও কবিতা পদবাচ্য হয়ে উঠছে। আর পাঠকের কাছ থেকে দাবি করা হচ্ছে সাবালকত্ব। পাঠকের উপর দায়িত্ব চাপানো হচ্ছে অবগুণ্ঠন খুলে সৌন্দর্য অবলোকন করার। কবি অভিধান ঘেঁটে শব্দ প্রয়োগ করবেন আর পাঠক তার অর্থ উদ্ধার করতে একটু পরিশ্রম করবেন না,তা কি হয়!

প্রাকৃতিক রহস্য উন্মোচন করতে বিজ্ঞানীরা কঠিন পরিশ্রম করেন। দার্শনিকরাও যুক্তি দিয়ে সব কিছুর ব্যাখ্যা হাজির করতে কম মাথা ঘামান না। যোগী, সাধু-সন্ত ও সুফী, সাধকরাও আত্মিক উৎকর্ষ অর্জনের জন্য একাগ্রচিত্তে জপ, তপ, ধ্যান, মোরাকাবা, মোশাহেবা করে থাকেন। সিদ্ধি লাভের তরিকা প্রত্যেকের আলাদা আলাদা। কিন্তু প্রকৃতি তার সৌন্দর্য স্বরূপকে সবার সামনে মেলে ধরে সহজ ভঙ্গিতে। সমুদ্র তটে একটা ঝিনুক হাতে নিয়ে তার বর্নিল সৌন্দর্য ছটা অবলোকন করতে গেলে বিস্ময়ের অন্ত থাকেনা। পৃথিবীর সেরা চিত্রকরও তেমন নিখুত সৌন্দর্যের বিচ্ছুরণ ফুটিয়ে তুলতে পারবেন কিনা সন্দেহ রয়েছে। একটা পাতা বাহারি গাছের দিকে তাকিয়ে দেখুন, কি অপরূপ সৌন্দর্য তার পাতায়। কোন জটিলতা নেই, কোন দুর্বোধ্যতা নেই। সরল, অনাড়ম্বর কিন্তু অপূর্ব সুন্দর! ফুলের বাহার সম্পর্কে আর কি বলবো; সেতো প্রকৃতির কবিতা। নারীর রূপও ঠিক তাই। অনির্বচনীয়। কিন্তু মধুকর যখন মধু সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে তখন ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে না। ঠিক তেমনি পূজার উপাচার হিসেবে ফুল সংগ্রহকারী কিংবা মালা গাঁথার জন্য ফুল সংগ্রহকারীরও লক্ষ্য থাকে ফুল সংগ্রহ, ফুলের সৌন্দর্য্যরে প্রতি তাদের মনোযোগ থাকে না। এই কথাটাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কত ফুল নিয়ে আসে বসন্ত, আগে পড়িতনা নয়নে।’ কারণ ‘তখন কেবল ব্যস্ত ছিলাম চয়নে।’ এই ‘চয়ন’ করতে ব্যস্ত লোকের পক্ষে বসন্তের পুষ্প সম্ভার এবং তার সৌন্দর্য অনুভব করা সম্ভব হয়না। প্রজাপতির পাখায়, ময়ূরের পেখমে কিংবা রংধনুর বর্নছটাই আমরা যে সৌন্দর্যের প্রকাশ দেখি তার মধ্যে কোন কৃত্রিমতা নেই। মানুষের সৃজনী ক্ষমতা এসবের তুলনায় নিতান্তই তুচ্ছ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মূলে রয়েছে রাসায়নিক বিক্রিয়া, যা মানুষের দৃষ্টি কাড়ছে। তারা আরও বলছেন, জিনোম কোডে একশো ভাগের মধ্যে মাত্র ০.০১ ভাগ পার্থক্য থাকার কারণে এত রূপ এত বৈচিত্র্য সৃষ্টি হচ্ছে জগতে। বিজ্ঞানের এসব তত্ত্ব কবি না জানলেও ক্ষতি নেই কিন্তু বুদ্ধদেব বসু ফরাসী কবি বোদলেয়ার সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে উপসংহারে যা বলেছেন তার মর্মকথা হচ্ছে: মানুষের সাধুতা, সততা, পরার্থপরতা এবং অন্যান্য গুণাবলীর কথা কবিকে অবশ্যই জানতে হবে। সেই সঙ্গে জানতে হবে শঠতা, নীচতা, পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা, দ্বেষ, হিংসা এককথায় মানুষ কতটা নিচে নামতে পারে তার আদ্যোপান্ত। আর কবিতায় মানব চরিত্রের উৎকর্ষ এবং অপকর্ষ দুই-ই ফুটিয়ে তুলতে হবে।

কিন্তু কেন? ভাল কবি হওয়ার জন্য, খ্যাতিমান হওয়ার জন্য, না মানুষের জীবনকে অর্থবহ করার জন্য, এ প্রশ্নের উত্তর রবীন্দ্রনাথে, ইকবালে, নজরুলে, জীবনানন্দ দাশে আছে। কিন্তু নেই অনেক আধুনিক কবির কাব্যে।

কবিতাকে যে কবি একটি নিটোল সৌন্দর্য হিসেবে রূপ দিতে চাইবেন তাকে প্রকৃতি থেকে পাঠ নিতে হবে। জটিল প্রক্রিয়া কবির মনোজগতেই থাকবে কিন্তু কবিতায় তার প্রকাশ হতে হবে লাবণ্যমণ্ডিত। এর জন্য ছন্দ এবং ধ্বনির মাহাত্ম্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে। ছন্দের শাসনকে বলা যায় নদীকূলের পাড়। এর কাজ পানির প্রাবাহ নিয়ন্ত্রণ করা। যাতে দুকুল ছাপিয়ে প্লাবন না হতে পারে। ঠিক এ কারণেই আবেগকে শাসন করার জন্য ছন্দ-মিলের শাসন মানতে হবে কবিকে। যাতে কবিতায় আবেগের প্লাবন না ঘটে। গদ্যও কবিতা হয়ে ওঠে যখন শব্দের ব্যবহার শ্রুতিসুখকর হয়ে ওঠে। প্রখর শিল্পবোধ ছাড়া ভাল গদ্যকবিতা লেখা যায় না। কবিতায় ভাবের গভীরতা, শব্দের ধ্বনি ও ব্যঞ্জনা আনতে জানলে সার্থক গদ্যকবিতা লেখা সহজ হতে পারে। এটা সবার জন্য নয়। প্রবন্ধ লেখা কঠিন মনে করে যারা কবিতা লিখে যাচ্ছেন তাদের একথা বোঝানো কঠিন। কবিতা রচনার জন্যও ধর্ম-দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের গভীরতর জ্ঞান থাকা চাই। জীবনান্দদাশের কবিতা পাঠ করলেই বোঝা যায় কিভাবে ইতিহাস বোধ, কাল চেতনা মিশে আছে তার সৃষ্টিতে। বিবর্তনের ধারায় এ কারণেই তিনি রবীন্দ্রনাথকে সার্থকভাবে অতিক্রম করতে পেরেছেন। তার সময়কার অনেকেই পাশ্চাত্যের অনুকরণ করতে গিয়ে স্বকীয়তা হারিয়ে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছেন; অথবা কাব্যগ্রন্থের শুষ্ক পৃষ্ঠায় আশ্রয় খুঁজে পেয়েছেন।

কবিতা একটি সূক্ষ্ম ও সুন্দর শিল্পকর্ম। শিল্পের এই শাখাটি আজ অনাসৃষ্টির কারণে পাঠক হারাতে বসেছে। কবিযশপ্রার্থীরা কবিতা চর্চাকে এমনভাবে টেনে-হেঁচড়ে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন যে, সাহিত্যের এই সমৃদ্ধ শাখাটির অবস্থা সঙ্গীন। কবি আবুহেনা মোস্তফা কামাল ক্ষেদের সঙ্গে একদা লিখেছিলেন তৃতীয় বিশ্বে দ্রুত জনসংখ্যা বাড়ার মত ক্রমবর্ধমান কবির সংখ্যাও। এর কারণ হতে পারে প্রবন্ধের চর্চা করতে গেলে জ্ঞানের গভীরতা এবং যুক্তির ধার থাকতে হয়। কবিতা যারা লিখছেন তারা অনেকেই ওসবের ধার ধারতে চাইছেন না। কবি রফিক আজাদ বলতেন, ‘কথা সাহিত্যের চর্চা আর কোদাল দিয়ে মাটি কাটা সমার্থক।’ ব্যাপারটা কি তাই? কবিতা রচনায় কল্পনাশক্তি থাকতে হয় কিন্তু কেবল কল্পনাশক্তি থাকলেই কথাশিল্পী হওয়া যায় না, সাবলীল গদ্য লেখার হাত থাকতে হয়। যারা মনের ভাব প্রকাশের সংক্ষিপ্ততম মাধ্যমটি সহজে ব্যবহার করার আনন্দ পাচ্ছেন এবং নিজেদের খেয়াল-খুশি মত যখন তখন একটি কবিতা লিখে ফেসবুকে পোস্ট করছেন বা নিজস্ব অর্থায়নে কবিতার বই বের করছেন, সাহিত্যকর্মীদের মধ্যে তারাই সংখ্যায় প্রচুর। তাদেরকে পরিকল্পিতভাবে প্রশিক্ষণ দেয়ার একটা প্রতিষ্ঠান থাকলে অবশ্যই ভাল ফল পাওয়া যেত বলে আমার বিশ্বাস। অনেকে দীর্ঘদিন ধরে কবিতা লিখে যাচ্ছেন কিন্তু কবিতায় রস সৃষ্টি করতে পারছেন না। কারণ, তাদের বেশির ভাগই যা দেখছেন তাই কবিতায় প্রকাশ করছেন। কিন্তু দৃষ্টিপাতের সঙ্গে মনের যোগ ঘটছে না। অনুভবের সঙ্গে যোগ হচ্ছে না আনন্দ বা বেদনার। যোগ হচ্ছে না সাহস ও সংগ্রামের। তাই সৃষ্টি হচ্ছে না রস। এই সংযোগ সাধন করার ক্ষমতা রাখেন সত্যিকারের কবি ও গীতিকার। সঙ্গীত শিখতে ওস্তাদ লাগে কিন্তু কবিতা রচনা করতে শিক্ষক লাগেনা। সবাই কি স্বভাব কবি! এজন্যই প্রচুর অনাসৃষ্টি হচ্ছে, যা এক সময় বইয়ের পাতায় লজ্জায় মুখ লুকাবে। কবি ও কবিতার জন্য যা মোটেও গৌরবজনক হবে না। তাই বিষয়টি নিয়ে কবিদের ভাবতে বলি।

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও সাংবাদিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here