নিউজবাংলা প্রতিবেদক  
লেখক গবেষক ও সাপ্তাহিক রোববারের সম্পাদক সৈয়দ তোশারফ আলী বলেছেন, সমাজে যে সব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাবলী ঘটছে তা আমাদের সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রতি ইংগিত করছে। এ অবক্ষয় একদিনে ঘটেনি এবং রাতারাতি দূর করাও যাবে না। আমাদের যৌন শিক্ষা ও যৌন জীবন ত্রুটিপূর্ণ। মাদকাসক্তি, সন্ত্রাস ও সুবিচারের অভাব এক মারাত্মক সঙ্কটের সুষ্টি করেছে। সুশিক্ষা ও সুস্বাস্থ্য ও সুবিচারের সমাজ গঠন ব্যতীত এর স্থায়ী প্রতিকার পাওয়া যাবে না। অন্যায়কে ধীক্কার দিয়ে অপরাধীকে কঠোর দন্ড দিয়ে নিরাপদ সমাজ গঠন করা সম্বব নয়। আমাদের তাই উপসর্গের মূল কারণ খুঁজতে হবে। এবং তা দূর করতে হবে। যে পর্যন্ত তা আমরা করতে পারবো না ততদিন দ্রুত আদালতে বিচার করে অপরাধীদের কঠোর দণ্ড দিতে হবে। তিনি বলেন, গত দুশো আড়াইশো বছরে বাংলা সাহিত্য যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তা বিস্ময়কর। তবে এদেশের শিল্প-বনিক শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় সাহিত্য সংস্কৃতি তেমন পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে না। ‘ধর্ষণ ও সহিংসতার বিরুদ্ধে সাহিত্য’ শীর্ষক সাহিত্য সভার আয়োজন দেখে আমি আশান্বিত হয়েছি।
তিনি বলেন, একটা ভালো কবিতার প্রতিবাদ করার ক্ষমতা অনেক বেশী, যা বক্তৃতা বিবৃতি বা প্রস্তাব গ্রহণের থেকে অনেক বেশী কার্যকর। আপনারা যারা কাব্যকর্মী বা সাহিত্যকর্মী তারা নিজেদের জীবন গড়ে তোলার জন্য একটি পরিচ্ছন্ন, প্রদীপ্ত এবং আলোকিত জীবনদর্শন সামনে রেখে কাজ করুন। আদর্শ বলুন আর বিশ^াস বলুন এটা এমন এক ভাবশক্তি যা জীবন তরীর হালের কাজ করবে, আঁধারে আলো ছড়াবে। সচেতন মানুষ মাত্রেরই সমস্ত সিদ্ধান্ত সংকল্প ও কর্মকে পরিচালিত করে থাকে।
সাহিতের এই সমালোচক বলেন, সমকালীন অপ্রীতিকর অমানবিক ঘটনা সংঘটিত হতে দেখলে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল তাদের কবিতায় তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ হিজলী হত্যাকান্ডের ঘটনায় তার বিখ্যাত ‘প্রশ্ন’ কবিতাটি লেখেন। এই কবিতায় তিনি তার ভগবানকে প্রশ্ন করেন; যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো / তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছো ভালো? কলকাতায় সংঘটিত দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি লিখেছিলেন তার ব্যতিক্রমী ‘ধর্মদ্রোহ’ কবিতাটি। আর নজরুল তো চলমান ঘটনা প্রবাহের কাব্যভাষা রচনা করে তার দুর্লভ প্রতিভার পরিচয় দেন।
তিনি শনিবার সারেঙ সাহিত্য সভা আয়োজিত ‘ধর্ষণ ও সহিংসতার বিরুদ্ধে সাহিত্য’ শীর্ষক সাহিত্য সভায় প্রেরিত লিখিত বার্তা এসব কথা বলেন। বাংলা ভিশনের সিনিয়র নিউজরুম এডিটর কবি ও লেখক নাসরীন গীতির সঞ্চালনায় মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল আ্যান্ড কলেজের সাবেক শিক্ষক ও লেখক ফজলুল হক খান এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় অন্যান্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন সাপ্তাহিক পতাকার নির্বাহী সম্পাদক সেলিম খান, মানবাধিকার সংগঠক ও লেখক রুহুল ইসলাম টিপু, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট জামালুদ্দীন বারী, কবি হামীম হাফিজুল্লাহ, ছড়াকার মানসুর মুজাম্মিল, সারেঙ সম্পাদক আবদুর রহমান মল্লিক, কচিপাতা সম্পাদক আলেয়া বেগম আলো, সিনিয়র সাংবাদিক সাহিদুল ইসলাম, ছড়াকার ফরিদ সাইদ প্রমুখ ।
অনুষ্ঠানের সভাপতি ফজলুল হক খান  বলেন, একটি সভ্য সমাজ বিনির্মানে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরী। নারীর প্রতি সংহিসতা রোধেও সেই সমন্বিত প্রয়াস নিতে হবে। তিনি বলেন, প্রিভেনসন ইজ বেটার দ্যান কিউর। ঘটনা ঘটে যাবার পর শুধু আওয়াজ তুললে হবে না। ঘটনা যাতে না ঘটে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের উপলব্ধি ও চেতনাকে আরো জাগ্রত করতে হবে। আমরা শুধু পরিবারে বাস করি না, একই সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাস করি। রাষ্ট্রের ভালো মন্দ নিয়ে কথা বলার অধিকার প্রতিটি নাগরিকের আছে। রাষ্ট্রেরও দায় রয়েছে প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা দেয়ার। আমাদেরকে সুনাগরিকের কর্তব্যও পালন করতে হবে। তিনি সারেঙ এর উদ্যোগকে স্বাগত জানান।


রুহুল ইসলাম টিপু: আমরা আমাদের এই প্রিয় মাতৃভ‚মি বাংলাদেশকে চট করে পেয়ে যাই নি। এর পেছনে অনেক ত্যাগ রয়েছে। কতিপয় ধর্ষক কতিপয় সন্ত্রাসীর হাতে দেশটাকে ছেড়ে দিতে পারি না। নাগরিক অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই সমাজ আগের সমাজ নেই। বড়দের মান্যতার সংস্কৃতি বিনষ্ট হতে চলেছে। তবে বিনয় প্রকাশ শিষ্টাচারের ঘটনাও রয়েছে অনেক। পড়াশেনা নেই, পাঠাগার নেই থাকলেই তার পরিচর্যা নেই। পাশাপাশি আবার নানা উদ্যোগের সাথে আমরা একাত্ম হই, আমরা কাজ করি। এই কাজই বাংলাদেশের শক্তি। ধর্ষনের বিরুদ্ধে আজ একটা জাগরণের সৃষ্টি হয়েছে। হত ছয় মাসে ধর্ষণের ঘটনা হাজারে পৌঁছেছে। ভ‚ক্তিভোগী এবং তার মা-বাবাই কেবল বুঝতে পারে ধর্ষণের একটি ঘটনা মানুষকে কতটা অসহায় করে দেয়। মানবিক সমাজ গঠনে তাই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
সেলিম খান: সমাজে কিশোর অপরাধটা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। স্মার্ট ফোন, রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশয় ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমি বিশ^াস করি কোনো তরুণের মাঝে যদি একবার দেশপ্রেমের উপলব্ধি তৈরি হয় সে সহজে বিভ্রান্ত হয়ে না। আমাদের সন্তানকে সেভাবে গড়ে তুলতে হবে। মা-বাবা হিসেবে আমাদেরকে তাদের সহযোগীর ভ‚মিকা পালন করতে হবে। একজন সময় এসিড নিক্ষেপ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। ধর্ষনের ঘটনাও একদিন কমে যাবে সেজন্য আমাদের সোচ্চার ভ‚মিকা পালন করতে হবে। সারেঙ এর মাধ্যমে মানুষের কাছে একটা মেসেজ যাবে সেটা প্রত্যাশা করি।
জামালুদ্দীন বারী: ধর্ষণ সহিংসতা খুনসহ নৈরাজ্যকর ও সংকটময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে দেশে গণতন্ত্রহীনতার কারণে। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে কাজ করতে পারছেনা। যখই আমরা ভোটের অধিকার হারাই তখনই গণতন্ত্রকে হারাই। গণতন্ত্র হারালে সমাজে নানা উপসর্গ দেখা দেয়। সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের নাগরিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সেই প্রয়াস সৃষ্টিতে সারেঙ অনেকখানি ভ‚মিকা পালন করতে পারে।
মানসুর মুজাম্মিল: আগে চোর ধরা পড়লে মানুষ দেখতে যেতো। সে চোরের গায়ে কাপড় থাকতো না। তাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এখনকার চোরেরা থাকে সুটেড বুটেডে পরিপাটি ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত। শিক্ষিত সুন্দর চেহারার চোরেরা দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে। তারা মিথ্যাকে সত্যের মতো করে উপস্থাপন করে। কিছু কবি আছে যারা দিনের পর দিন তুমি আমি কবিতা লিখে যাচ্ছে। দেশে কি কি আর কোনো বিষয় নেই। খুব দুঃখের সাথে বলতে হয় মাদরায় কীভাবে শিক্ষার্থীদের দিয়ে শরীর টেপানো হয়।


নাসরীন গীতি: ধর্ষণ হোক আর যেকোন ধরণের নির্যাতনই হোক,বন্ধ হওয়া জরুরি। কারণ, সমাজে তৈরি অবক্ষয় বেড়ে পুঁতিগন্ধময় সমাজ যাতে সৃষ্টি হয়। সেজন্য এখনই রুখে দাঁড়াবার সময়। যার যার অবস্থান থেকে যদি নৈতিক মূল্যবোধের শিকড় নতুন প্রজন্মের মধ্যে গড়ে দেয়া না যায়, তাহলে অনাচার, আর অন্যায় বেড়েই যাবে। নৈতিক স্খলন প্রতিরোধে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র -প্রত্যেকের দ্বায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের উপর গুরুত্ব দেয়া জরুরি। আর ফোকাস পয়েন্টে থাকাই জরুরি। বাহুল্য চলে আসলে মূল কাজ হয় না। তাই ধর্ষক ও নির্যাতনকারীর শাস্তি আগে নিশ্চিত জরুরি, পরে সমাজের বাকি অর্গানগুলো নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
হামীম হাফিজুল্লাহ: সামাজিক অবক্ষয়ের এক দুষ্ট চক্রে আমরা পতিত হয়েছি। এর থেকে মুক্তি পেতে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সম্প্রদায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে, সেক্ষেত্রে আমাদের কবি লেখক সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপক ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। বিজ্ঞানের আবিষ্কার ভার্চুয়াল কমিউনিকেশন সিস্টেম থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কীভাবে সঠিক ব্যবহার করে সুফল পেতে পারে তার দিকনির্দেশনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এখনই আমাদের প্রজন্মকে যদি আমরা এই ভয়ঙ্কর অনিষ্ট থেকে রক্ষা করতে না পারি তবে পৃথিবীর মানচিত্রে আমাদের অস্তিত্ব সংকট দেখা দিবে।
আলেয়া বেগম আলো : ধর্ষণ ও নারীর প্রতি অবমাননার ঘটনা কেন ঘটছে তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। এটিকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে। আমাদের সন্তানদের বাঁচাতে তাদের সাথে খোলামেরা করতে হবে। স্পর্শকাতর বিষয় বাইরে থেকে শুনলে ভুল ইনফরমেশন পেতে পারে। তারা যাতে সব সমস্যা বাবা মায়ের সাথে শেয়ার করতে পারে সেই সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তিনি তার ছেলে সন্তানের অ্যাবিউজের ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, আমি ও সন্তানের চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। ডাক্তার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মাওলানা সবাই বলেছিলেন সন্তানের সাথে খোলামেলা কথা বলতে। আমি সেট্ওা ইতিবাচক ফল পেয়েছি।
আবদুর রহমান মল্লিক: করোনাকালেও একটা প্রানবন্ত সভা উপহার দেয়ার জন্য সারেঙ সম্পাদক সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন দেশটি আমাদের মায়ের মতো। মায়ের সম্মান রক্ষা করা সকলের দায়িত্ব। কোনো মাকে ধর্ষণ কিংবা সম্ভ্রমহানি থেকে বাঁচিয়ে কোনো সন্তান এর বিনিময়ে কোনো প্রতিদান চাইতে পারেনা। এর কোনো প্রতিদান হয়। এটা দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমরা আমাদের অহংবোধের জায়গাটা দিন দিন হারিয়ে ফেলছি। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে সংবেদনশীল কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ সুভা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারের মতো অসংখ্য চরিত্র নির্মাণ করেছেন।
ফরিদ সাইদ: সমাজের এই অধঃপতন অসঙ্গতি একদিনে হয়নি। এর কারণগুলো খতিয়ে দেখতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটা সঙ্কট মোকাবেলায় নাগরিক সমাজের পাশাপাশি কবি সাহিত্যিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

 

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here