আমার সন্তানেরা
আমার সন্তানেরা

নিউজবাংলা২৪ ডেস্ক: পৃথিবীর ইতিহাস বলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের যোগসূত্র না থাকলে বংশ পরিচয় টিকে না। সন্তানেরা হলো এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের যোগসূত্র। এই যেমন আমার বাবা আমার দাদা’র, আমি আমার বাবা’র। আমার সন্তানেরা ঠিক তেমন নয়। আমার সন্তানেরা হলো আমার লেখনী, আমার সৃজনশীলতা। বংশ, প্রজন্ম রক্ষা বিষয় অন্যভাবেও হয়। তবে লেখনী আমার সন্তান। সন্তানের মত নয়।

এই যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর সন্তানদের বা সন্তানের নাম পরিচয় আমার ততোটা জানা না থাকলেও গীতাঞ্জলি কিন্তু ঠিকই’ চিনি, জানি। রবীন্দ্রনাথের এই সকল সন্তানের উপর কতজন গবেষণা করেছে তারও ইয়ত্তা নেই। এই সন্তানেরা বছরের পর বছর বেঁচে আছে। তাঁরা আমাদের শিখিয়ে যাচ্ছে। আমরা শিখছি, তাঁদের আলোয় পথ চলছি।

এমনই রেখে যাওয়া শত লেখকের শতশত সন্তানেরা সমাজে, দেশে, পৃথিবীতে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার বিলানোয় তাঁদের কোন অবদান নেই। এমন সন্তান কে’না চায়। বড় বড় মানুষের মুখে মুখে যে সন্তানের নাম থাকে সে সন্তান’তো সকলের কাম্য।

আমি বলছি আমার লেখনী’র কথা। আগেই বলেছি আমার সন্তানেরা কারোর বিপদ ডেকে আনবে না। পারলে আলো ছড়াবে। বাবা বলতেন,”কারোর উপকার করতে না পারিস, ক্ষতি করিস না। মনে রাখিস, যে মানুষ উপকার করলো না; আবার ক্ষতিও করলো না। সেও তোর বন্ধু, শত্রু না।” বাবা আজও বেঁচে আছেন। এখনও তাঁর কথা মেনে চলি। আমি কারোর ক্ষতি করতে চাই না। সেটা মরেও না। আমি এমন সন্তান রেখে যাব না, যে সন্তান অপরে পথ না হয়ে পথের কাঁটা হবে। সকলের সন্তান সকলে পথ হোক, কাঁটা যেন না হয়।

সন্তানের সাফল্য বাবা-মায়ের জন্য সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতির খোরাক। সন্তান সফল হলে বাবা’র আনন্দের শেষ থাকে না। রবীন্দ্রনাথের সফল সন্তান গীতাঞ্জলি যখন নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছিল তখন রবীন্দ্রনাথ না জানি কত খুশি হয়েছিলেন।

সন্তানদের তৈরি না করে সমাজে ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়। যে সন্তান আলো না ছড়ালো, সমাজের কল্যাণে না আসলো। সে সন্তান প্রকাশিত না হওয়াই ভালো। সকল বাবার সন্তান’ই যেন কারোর মাথা ব্যাথার কারণ না হয়। তবে এও মনে রাখা চাই; সন্তান ভালো হোক মন্দ হোক সন্তান সন্তানই। সে যেমন’ই হোক। কোন বাবা’ই সন্তান ফেলে দেয় না। এই যেমন গুজব। গুজব যারা ছড়ায় তাঁরা খুব যত্ন করেই ছড়ায়। তাঁরা ঐ গুজব সৃষ্টিকারীর সন্তান। হতে পারে সে সন্তান কুসন্তান। তবুও কিন্তু সন্তান।

আবার যারা অনেক কষ্টে কঠিন পাথর কুঁদে কুঁদে অসম্ভব প্রচেষ্টায় একটা লেখা লিখে বিফল হয় সে কিন্তু ঐ লেখকের সন্তান। সব মানুষ’ই তাঁর সন্তানকে ভালোবাসে। অর্থাৎ সব লেখকই তাঁর সৃষ্টিকে সন্তান হিসেবে দেখে। কোন সন্তানকে ফেলো দিতে চায় না বলেই কিন্তু নিজের নামটা সন্তানের নামের সাথে যত্ন করে সেটে দেয়। কেউ যদি বলি, মেজদিদি কার সন্তান? টপকরে বলে দেবে সে’তো শরৎ বাবুর অমর সৃষ্টি! কি করে বুঝলে? কারণ শরৎ বাবু ঐ সন্তানের জন্মের সময় নিজ হাতে নাম রেখেছেন ‘মেঝদিদি’।

পিতার সন্তানের পরিচয় এভাবে শতশত বছর টিকে থাকে। সে সকল সফল সন্তানে আমাদের আলোকিত করে যাচ্ছে। আমরা আলোকিত হচ্ছি। আমাদের সন্তানের সন্তানেরাও আলোকিত হবে। এ সকল সন্তানেরা অন্ধকারে পা দেবে না। কোন বাবা’ই তা চায়ও না তার সন্তান অন্ধকারের সারথি হোক।

আমার রক্তে মাংসে গড়া দু’চারটি সন্তান থাকলে তাঁদের নিয়ে হয়তো কখনো অভিযোগ শুনতে হলেও হতে পারতো। কিন্তু আমার কলমের কালিতে সৃষ্টি করা ছয়টি সন্তান কাউকে অভিযোগে করার সুযোগ দেয়নি। আমার বড় সন্তানের বয়স এই সাত হলো এ বছর। ওর জন্ম দু’হাজার তের’তে। তখন আমি বেসরকারি কলেজে খুব জুনিয়র সাধারণ শিক্ষক। ওর পাশে নিজের নামটা লিখতে কেমন যেন বেমানান লাগছিল। তবুও কলম শক্ত করে লিখে দিলাম। তারপর সে তারমত চলছে।

একদিন বাড্ডা দিয়ে বাসে আসছিলাম। হঠাৎ দেখি একটি সুনামধন্য কলেজের অনেকগুলো শিক্ষার্থী কুঁচকুঁচে কালো পোশাকে আমার সন্তান’কে হাতে নিয়ে যাচ্ছে। সুন্দর লাইন করে হাটছে। সাতে তাদের গাইড শিক্ষক ছিলেন। তাদের সুশৃঙ্খল লাইন দেখে বুঝতে বাকী নেই। তখন আমার সন্তানের গায়ের রং ছিল হলুদ। তাঁর শরীরে একটি কালো জীর্ন ক্যালকুলেটর ছিল। তখন নিজের মনের ভেতর বিশ্ব জয়ের অনুভূতি পেয়েছিলাম। সে অনুভূতি কয়েক হাজার পৃষ্ঠা লিখে শেষ করা যাবে না।

দু’হাজার সতেরো সাল। আমি তখন ঢাকা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। সবে মাত্র যোগদান করেছি। তার দু’দিন পর ঢাকা সিটি কলেজে আমার খুব কাছের খুব ভালো মানুষ মোহাম্মদ জাকির হোসেন স্যারের সাথে দেখা করতে গেলাম। সেখানে কথা বলা আড্ডা শেষে বেড়িয়ে দেখি- শতশত ছেলে মেয়ের হাতে আমার সন্তান! কি সুন্দর কলে করে নিয়ে যাচ্ছে। কারোর কোলে, কারোর বুকে! সে আনন্দ বলে শেষ হবে না। সে অনুভূতি লেখা যাবে না। আমি সেদিন থেকে ধরে নিয়েছি আমি সফল। আমার সন্তানেরা আরো সফল।

গতকাল এক সিনিয়র স্যার আমার ফেসবুকের মেসেঞ্জারে বেশ কয়েকটি বইয়ের ছবি পাঠিয়েছেন। সেখানে আমার নামটা ছোট করে লেখা। স্যার জানতে চেয়েছেন, “এই নামটি কার?” আমি তো টপ করে বলে দিলাম,”স্যার এটা তো আমার নাম। বলতে দেরি হয় নি।

কি জানি আমার যদি রক্তে মাংসে গড়া কতগুলো সন্তান থাকতো তাঁরা এমন সফল হতো কি না! তাঁরা সমাজের মুখ আলোকিত করতো কি না! কে জানে! এসব না বাড়াই। তবে এতটুকু বলবো আমার সন্তানেরা আজ অবধি ভালো আছে। সফল হয়েছে। আমার লেখনী আমার সন্তানের মত নয়। আমার প্রাণপ্রিয় সন্তান। সন্তানের কল্যাণ আমার কল্যাণ।

( লেখক আব্দুর রাজ্জাক)Md. Abdur Razzak

Md. Abdur Razzak
BCS (General Education) Research Officer on Deputation
Establishment of 10 Government Secondary High Schools Pheriferal Area of Dhaka City Project
Ministry of Education
Mother Post: Lecturer in Accounting and Accounting Text Books writer
Ex- Lecturer in Accounting at Dhaka College

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here