নিউজবাংলা২ে৪ ডেস্ক: নব্বই দশকের কথা। সিনেমা বা নাটকের বিরতিতে ইবনে সিনার বিজ্ঞাপন। হাজির হতেন দেশসেরা রেডিওলজিস্ট ডা. মেজর (অব) আবুল মোকারিম মোহাম্মদ মহসিন উদ্দিন। সেই বিজ্ঞাপনের শেষ প্রান্তে তাকে দেখা যেতো কয়েক সেকেন্ডের জন্য। হাস্যোজ্জ্বল মুখে তিনি বলতেন অযথা বাড়তি খরচ কেন করবেন?  টেলিভিশনের পর্দায় দেখা এপ্রোন পরা সে মানুষটির মায়ামাখা হাসিটা এখনো চোখে ভাসে অনেকের। টেলিভিশনের সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখটা, বাস্তবেও ছিল অনেক প্রাণবন্ত। হাসি মুখ নিয়ে কথা বলতেন সবার সঙ্গে। কিন্তু সেই হাসিমুখের মানুষটি ও তার পরিবারের সঙ্গে ঘটে গেছে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম ঘটনা।

করোনা মহামারি শুরুতে যখন অন্য আটদশজন চিকিৎসক রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, ঠিক তখনি নিয়মিত রোগী দেখতেন তিনি। হাসপাতাল ইবনে সিনা ও মেডিনোভায় নিয়মিত রোগীদের চিকিৎসা দিতেন। সহকর্মীদের সঙ্গে বলতেন, এই বিপদের সময় রোগী না দেখলে কখন দেখবো? এখনই  তো মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময়। ভালো সময়ে সবাই রোগী দেখবে, কিন্তু এই সময়টা খুব খারাপ। মানুষের পাশে দাঁড়ানো চিকিৎসক হিসেবে আমার দায়িত্ব। সেই দায়িত্বকেই পুঁজি করে দুই হাসপাতালে নিয়মিত রোগী দেখতেন তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, রোগী দেখতে গিয়েই তিনি আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি আক্রান্ত হওয়ার পর পরই ইবনে সিনায় আইসোলেশনে চলে যান। পরে তিনিসহ পরিবারে সবার করোনা টেস্ট করান। ফলাফল সবাই করোনা পজেটিভ। এদিকে বাবাকে দেখাশুনা করতে গিয়ে আক্রান্ত হন বড় ছেলে রেডিওলজি এন্ড ইমেজিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাফায়েল মুরসালীন। রাফায়েল বলেন, যখন লকডাউন শুরু হয় তখন আব্বুকে বলছিলাম, আব্বু চারদিকে করোনা, অবস্থা ভালো না, কাজ যা আছে আমি চালিয়ে নিতে পারবো। তুমি বাসায় থাকো। তোমার অ্যাজমা , হার্ট কনডিশন তো আছেই। তখন আব্বু বলছিলেন, তোমরা কাজ করবা আর আমি বাসায় বসে থাকবো। নিজেকে স্বার্থপর মনে হবে। অথচ স্বার্থপরের মতোই বাবা চলে গেলেন। বাবাকে শত চেষ্টা করেও বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর কয়েকদিন ধরেই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ওই চিকিৎসক। তখন থেকেই প্লাজমা চেয়ে একের পর এক ফেসবুক পোস্ট করেন অনেকেই। কিন্তু কোথাও মিলেনি প্লাজমা। যদিও তখন প্লাজমার ব্যবস্থাটির সঙ্গে পরিচয় ছিলো না দেশে। তিনি আক্রান্ত হওয়ার পর প্রথমে ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও পরে সিএমএইচ-এর আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়।  প্রায় পাঁচ দিনের মতো হসপিটালাইজড ছিলেন তিনি। সেখানে চিকিৎসকরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন তাদের সহকর্মীকে ফিরিয়ে আনার, কিন্তু তাদের  চেষ্টাকে বিফল করে দিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
প্লাজমা পেলেই কি তাকে বাঁচানানো সম্ভব ছিলো না কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তার ছেলে রাফায়েল বলেন, এটা শতভাগ নিশ্চিত ছিলো না। তবে সেই সময়টা প্লাজমা সংগ্রহ করা প্রদান করার মতো এমন ব্যবস্থাপনা ছিলো না হাসপাতাগুলোতে। দেশে আমরাই প্রথম প্লাজমার সন্ধান করেছিলাম।
তিনি বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের পরিবারের মানসিক অবস্থা খুব খারাপ ছিলো। সবার মধ্যে টেনশন কাজ করছিলো দ্বিগুণ, ছিল আতঙ্ক। এই ভয়াবহতা রূপ নিতে থাকলো দিনের পর দিন। বাবা মারা যাওয়ার তিন দিন পর আমার আদরের ছোট বোন মামার মেয়ে শায়িরা আফিয়া (১৭) আমাদের  ছেড়ে  চলে  গেছে।  ছোট বোনটি মারা যাওয়ার নয়দিন পর মারা গেলো আমার নানু। তারা সবাই ধানমন্ডিতে একই বাসায় থাকতো। শুধু আমি থাকতাম আলাদা বাসায়। যদিও বাবাকে দেখাশুনা করতে গিয়ে আমি নিজেও আক্রান্ত হয়েছি। আমার আম্মু আক্রান্ত হয়েছেন। এখন আমরা সবাই নেগেটিভ। মাঝখানে তিনজন মানুষকে আমরা হারালাম।
পুরো পরিবার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর আশেপাশের মানুষদের কেমন সহযোগিতা পেয়েছেন এমন প্রশ্নে রাফায়েল বলেন, আমরা ধানমন্ডির যে বাসায় থাকি সেখানে প্রায় ১৭ বছর ধরে থাকি। আশেপাশে সবার সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক। সবারই সহযোগিতা পেয়েছি।
চিকিৎসক আবুল মোকারিম ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘদিন।  সেনাবাহিনীর  মেডিকেল কোরে চাকুরী করেছেন। মেজর পদমর্যাদায় থাকা অবস্থায় স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে যুক্ত হয়েছেন বেসরকারী হাসপাতালের সঙ্গে। ইবনে সিনা ট্রাস্টের চিফ রেডিওলজিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি, নিজক্ষেত্রে  দেশসেরা একজন চিকিৎসক ছিলেন তিনি।

সূত্র : মানবজমিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here