সাঈদ ইফতেখার আহমেদ :

নিশীথ রঞ্জন দাস, ভারতের অসম রাজ্যের সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক। বয়স ৯০ ছুঁই ছুঁই। বার্ধক্যজনিত কারণে শয্যাশায়ী। অসম্ভব সৎ এ মানুষটি সারাজীবন শিক্ষকতা করে সাধারণভাবে জীবন কাটিয়েছেন। নিজেকে উৎসর্গ করেছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। ভারতবর্ষকে সাংবিধানিকভাবে নয়, বাস্তবিক অর্থেই চেয়েছেন, সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসাবে দেখতে।

হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষমতায় এলেও একটা বিশ্বাস ছিল, সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বোধহয় এখনো সেক্যুলার নীতিমালার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। তাই ধরে নিয়ে বসেছিলেন, ক্ষমতায় হিন্দুত্ববাদীরা থাকলেও ভারতের সুপ্রীম কোর্ট রাজনৈতিক অবস্থান থেকে নয়, ন্যায় বিচারের জায়গা থেকে রায় প্রদান করবে। রায়টি হবে সংবিধানের সেক্যুলারিজমের স্পিরিটের আলোকে, কোনো বিশ্বাস, উপকথা বা ধর্মীয় মতাদর্শকে ভিত্তি করে নয়। তদুপরি, কিছুদিন আগেই সুপ্রিম কোর্ট একটি রায়ে বলেছিল, ‘বিশ্বাস আইনের ভিত্তি হতে পারে না।‘

বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে আদালত কোথাও রায় দেয় না। রায় দেয়া হয় প্রমাণ বা এভিডেন্সের উপর নির্ভর করে। তাই নিশীথ রঞ্জনের মত সুস্থ চিন্তার এবং সত্যিকার অর্থে সেক্যুলারিজমকে ধারণ করা ভারতবর্ষের অনেক মানুষ ধরে নিয়েছিলেন, বিজেপিসহ হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো একটা ঐতিহাসিক মসজিদকে নিয়ে রাজনীতি করলেও, কোর্ট অন্ততঃ তার রায়ের মধ্যে দিয়ে ন্যায় বিচারকে প্রতিষ্ঠা করবে। এর মধ্যে দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটা বিতর্কের সুরাহা হবে। তারা আশা করেছিলেন, কোর্টের রায়টি একটি নজির হয়ে থাকবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো গোষ্ঠী ধর্মীয় স্থাপনাকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে না পারে।

বাবরি মসজিদ মামলার শুনানীর সময় সরকারি আইনজীবীর কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, প্রমাণ করুন যে রাম ছিলেন, নয় তো মেনে নিন যে, রামায়ন একটি কাল্পনিক গ্রন্থ। এর জবাব সরকারি-উকিলের কাছে ছিল না। পুরাতত্ত্ব বিভাগকে বলা হয়েছিল রামরাজ্য যে এক সময় ছিল এর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে, সেটি স্বভাবতই তারা পারেননি বা পারার চেষ্টা করেননি।

পুরাতাত্ত্বিকরা বলেছিলেন যে মসজিদের নিচে একটি ঐতিহাসিক কাঠামোর সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে, সেটি মন্দির কিনা তা তারা বলতে পারেননি। সরকারি-উকিলকে আরো জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ৪০০০ বছর হলো সোনা আবিষ্কার হয়েছে, তো ৭০০০ বছর আগে সোনার লঙ্কা এল কোথা থেকে? স্বভাবতই মেলেনি এ প্রশ্নের জবাবও।

পাকিস্তান বা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মত ভারতের কোর্টকে সরকারের অধীন মনে করা হয় না। সরকারের অবস্থানের বাইরে গিয়েও ভারতে কোর্টের রায় দেওয়ার নজির রয়েছে। তদুপরি, যেখানে সরকারি পক্ষ রাম রাজ্যের অস্তিত্ব বা মসজিদের জায়গায় মন্দির থাকবার কোন প্রমাণ দিতে পারেনি, সেখানে রায় কোনোভাবে মন্দির নির্মাণের পক্ষে যাবে না, সেটা ধরে নেয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, ২০১৭ সালের ৮ অগাস্ট উত্তর প্রদেশের শিয়া সেন্ট্রাল বোর্ড সুপ্রিম কোর্টকে যে মতামত দেয়, সেটিকে ভিত্তি ধরে রায় দেওয়া হয়েছে।

বোর্ড কোর্টকে জানায়, বিতর্কিত স্থান থেকে কিছুটা দূরে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় মসজিদ বানানো যেতে পারে। এটিকে ভিত্তি করে কোর্ট রায় দেয়– বাবরি মসজিদের ২.৭৭ একর জমি পাবে হিন্দুরা। মসজিদ নির্মাণের জন্য, মুসলিমদের দেওয়া হবে বিকল্প ৫ একর জমি। লক্ষ্যণীয় যে, বিজেপিসহ সব হিন্দুত্ববাদীরা এ রায়ই চাচ্ছিল।

এ রায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে একটা সাধারণ রায় নয়। বস্তুত এ রায়ের উপরে নির্ভর করছিল পুরো হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ভবিষ্যৎ। ১৯৯০ সালের ২৫ ডিসেম্বর বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি গুজরাটের সোমনাথ থেকে যে রথযাত্রা শুরু করেন, তার মূল শ্লোগান ছিল, বিজেপি ক্ষমতায় আসলে, বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণ করা হবে।

লক্ষ্যণীয় যে, ১৫২৮ সালে মুঘল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকি বাবরি মসজিদ নির্মাণ করলেও ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত একে ঘিরে কোনোরকম বিতর্ক ছিল না। ১৮৮৫ সালে মহান্ত রঘুবর দাস ফৈজাবাদ জেলা আদালতে বাবরি মসজিদের বাইরে চাঁদোয়া টাঙানোর আবেদন জানান যা আদলত কর্তৃক নাকচ হয়ে যায়। ব্রিটিশ আমল জুড়ে বাবরি মসজিদ নিয়ে এটি ছাড়া আর কোন ইস্যু তৈরি হয়নি।

ভারত স্বাধীন হবার পর ১৯৫০ সালে রামলালার মূর্তিগুলির পূজার অধিকারের আবেদন জানিয়ে ফৈজাবাদ জেলা আদালতে আবেদন করেন গোপাল শিমলা বিশারদ। মূর্তি রেখে দেওয়ার এবং পূজা চালিয়ে যাওয়ার জন্য মামলা করেন পরমহংস রামচন্দ্র দাসও। ১৯৫৯ সালে বাবরি মসজিদের অধিকার চেয়ে মামলা করে নির্মোহী আখড়া। লক্ষ্যণীয় যে, হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলির পূর্বসূরী নথুরাম গডসে কর্তৃক গান্ধীকে হত্যার পর, নেহেরু ঘোষিত সেক্যুলার ভারতে এ গোষ্ঠীগুলি তখন নিজেদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছে।

নেহেরু এবং পরবর্তীতে তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধী কেউই বাবরি মসজিদ ইস্যুটি সমাধানের উদ্যোগ নেননি। তারা ইস্যুটিকে জিইয়ে রেখেছিলেন হিন্দু ভোটের কথা ভেবে। নিজেদের সেক্যুলার দাবি করেও পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মূলধারার দলগুলির মত কংগ্রেসকে নানা সময় ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে দেখা গেছে, যা আখেরে বিজেপিসহ হিন্দুত্ববাদীদের লাভবান করেছে।

সেক্যুলার নামাবলি গায়ে দিয়ে কংগ্রেস যে এখনো হিন্দু ধর্মবাদী গোষ্ঠীগুলোর সাথে আপোষ, ক্ষেত্রবিশেষে পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে তার সর্বশেষ উদাহরণ হলো, মহারাষ্ট্র রাজ্যে বিজেপির চেয়ে কট্টর শিবসেনাকে সমর্থন দেওয়া। আর কংগ্রেসের এ সমর্থন নিয়েই মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন চরম হিন্দুত্ববাদী প্রয়াত বাল ঠাকরের ছেলে উদ্ধব ঠাকরে।

‘হিন্দুত্ববাদ’ এবং হিন্দু ধর্ম কিন্তু এক নয়। হিন্দু ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করবার নামান্তর হচ্ছে ‘হিন্দুত্ববাদ’। যারা ‘হিন্দুত্ববাদের’ রাজনীতি করেন, তারা হিন্দু ধর্মের বহু মত এবং পথকে বিলুপ্ত করে এ ধর্মকে এক মত এবং পথে আনতে চান। সে পথটি হল, একমাত্র উত্তর ভারতের উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা যেভাবে ধর্মটিকে বোঝেন, সেটি।

এখন কোর্টের রায় যদি বিজেপির বিপক্ষে যেত তাহলে পুরো হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিই প্রশ্নবিদ্ধ হত। কোনো কার্যকরী অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিকল্পনা না থাকা সত্ত্বেও এ বাবরি মসজিদ ইস্যুকে ধরেই ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান এবং ক্ষমতায় আরোহণ। তাহলে এখানে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, ভারতের মত একটি গণতান্ত্রিক দেশে যেখানে সুপ্রীম কোর্টকে স্বাধীন মনে করা হয়, সেখানে কোর্ট নিজের ইমেজ ক্ষুণ্ণ করে, একটি দলের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে যাতে সুবিধা হয়, সেভাবে রায় দিল কেন?

কোর্ট যে শুধু নিজের স্বাধীন ইমেজ ক্ষুণ্ণ করে রায় দিয়েছে তাই নয়। আদালত এখানে হিন্দুত্ববাদকে রাজনৈতিক সুবিধা দেওয়ার জন্য, ভারতীয় সংবিধানের যে মূলনীতি, এমনকি তার বিপক্ষে যেয়েও এ রায় দিয়েছে। অর্থাৎ, কোর্ট এখানে একাধারে ভারতীয় সংবিধান এবং তাদের নির্দেশিত নীতিমালা, দুই-ই লঙ্ঘন করেছে।

১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে ভারতীয় সংবিধান কার্যকরী হয়। এ সংবিধানকে ভিত্তি করে ভারতীয় বিচারব্যবস্থা বা কোর্ট সিস্টেম গড়ে উঠেছে। ভারতের সমস্ত আইনের ভিত্তি হচ্ছে এ সংবিধান। অর্থাৎ, ভারতে এমন কোনো আইন প্রণয়ন করা যাবে না বা রায় দেওয়া যাবে না, যা সংবিধানের মূলনীতিকে লঙ্ঘন করবে।

সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে এ সংবিধানের মূল নীতিমালা। এতে ভারতীয় রাষ্ট্রকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রত্যেক ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রক্ষা এবং হেফাজত করবার। এখানে আদালতের ভূমিকা হলো রাষ্ট্র তার এ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে কিনা, সেটি নিশ্চিত করা। কোনো ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মালিকানা থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা সংবিধান অনুযায়ীই আদালতের অধিকার বহির্ভুত।

এখন এ রায় দেবার ক্ষেত্রে, সংবিধান এবং নিজেদের করা নীতিমালা উভয়েই লঙ্ঘন করে ভারতের মত সেক্যুলার দাবিদার দেশে, আদালতকে কেন বাবরি মসজিদকে নিয়ে এ ধরণের রায় দিতে হল? এটা বুঝতে হলে, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর, বিশ্লেষকদের ভাষায় ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতকে কী অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে, সে বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে।

বিজেপি ক্ষমতায় আসবার পর থেকেই, ভারতে যতটুকু সেক্যুলারিজম টিকে আছে, তা থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করে, ধারাবাহিকভাবে আস্তে আস্তে রাষ্ট্রকে পূর্ণ হিন্দুত্ববাদে রূপান্তরের একটা অলিখিত উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এটি বাস্তবায়নে হিন্দুত্ববাদীরা বামপন্থী, সেক্যুলার, প্রগতিশীল, উদারনৈতিক ইত্যাদি পরিচয়ে পরিচিত ব্যক্তিবর্গ, বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, সিভিল সোসাইটি অ্যাক্টিভিস্টদেরকে প্রধান প্রতিবন্ধক মনে করছে। তাই, বিজেপি ক্ষমতায় আসবার পর থেকেই হামলা, মামালা, জেল, হত্যা, চাকুরিচ্যুত করা ইত্যাদি নানাভাবে তাদেরকে হয়রানি করা হচ্ছে। এমনকি, সাম্প্রতিক সময়ে একজন বিচারকও হিন্দুত্ববাদীদের হাতে নিহত হয়েছেন। এর লক্ষ্য একটাই, আর তাহলো একটা ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ তৈরি করা, যাতে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে কেউ সক্রিয় হতে না পারে।

এক্ষেত্রে, একদিকে তারা যেমন রাষ্ট্রযন্ত্রকে কাজে লাগাচ্ছে, তেমনি তাদের দলীয় কর্মীসহ অন্য হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর কর্মীদের ব্যবহার করছে। অর্থাৎ, বিজেপি মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সেক্যুলারিজম বিযুক্ত করে, অনেকটা ফ্যাসিস্ট ধাঁচের, উচ্চবর্ণের উত্তর ভারতীয় হিন্দুদের প্রাধান্য নিশ্চিত করে, ভারতকে সম্পূর্ণভাবে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে চাচ্ছে। এটি হচ্ছে বিজেপিসহ সব হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর চূড়ান্ত লক্ষ্য।

একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এ চূড়ান্ত লক্ষ্যের কথা মাথায় রেখেই বাবরি মসজিদ বিষয়ক রায়টি দেওয়া হয়েছে। এ রায়টি একটি প্রিসিডেন্স হয়ে থাকল হিন্দুত্ববাদীদের কাছে। এটিকে ধরে তারা মুসলমানদের আরো যে সমস্ত বিতর্কিত ধর্মীয় স্থাপনা আছে, সে বিতর্কগুলোকে সামনে আনবার চেষ্টা করবে। পাশাপাশি, আরো অন্য স্থাপনাকেও এ বিতর্কের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কেননা, ধর্ম সংক্রান্ত বিতর্ক, হামলা, মামলা, দাঙ্গা হলো ‘ধর্মবাদী’ রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর প্রাণশক্তি।

তাই বাবরি মসজিদ নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের যে দীর্ঘ রাজনীতি, কোর্টের রায় এর বিপক্ষে যেয়ে, এ ধারার রাজনীতি করবার পথ বন্ধ করা হলে সেটি হিন্দুত্ববাদের রাজনীতির সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করত। কিন্তু বিচারকরা সে পথে না যেয়ে, রায়ের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদকে আগ্রসর করবার পথ উন্মুক্ত করলেন।

হিন্দুত্ববাদীরা আশা করেছিলেন, এ রায়ের ফলে মুসলমানদের মাঝে উগ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে। আর এ প্রতিক্রিয়া সব বিষয়ে ব্যর্থ হিন্দুত্ববাদকে চাঙ্গা রাখবার জন্য অতীব সহায়ক হবে। তারা এ লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিয়েও রেখেছিলেন। কিন্তু তাদেরকে হতাশ করে দিয়ে প্রায় সর্বস্তরের মুসলিম নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, যাতে কোনো অবস্থাতেই দাঙ্গা পরিস্থিতির উদ্ভব না হয়।

ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাস থেকে তারা এ বিষয়টা উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, এ ধরনের দাঙ্গায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন দরিদ্র মুসলমান জনগোষ্ঠী, আর সবচেয়ে লাভবান হয় হিন্দুত্ববাদীরা। তাই রায় ঘোষণার পর সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড থেকে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড, দিল্লি জামা মসজিদের শাহি ইমাম সৈয়দ আহমেদ বুখারি, আজমির শরীফের দরগার দেওয়ান সৈয়দ জয়নুল আবেদিন, অযোধ্যার জামা মসজিদের শাহি ইমাম থেকে শুরু করে প্রায় সবাই অসন্তোষ প্রকাশ করলেও একই সাথে এ রায় মেনে নেবার আহবান জানিয়েছেন।

তারা সবাই একটা ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন, যাতে রায়কে ঘিরে এ মুহূর্তে বিজেপিসহ হিন্দুত্ববাদীরা কোন সুবিধা তুলতে না পারে। তারা তাদের অভিজ্ঞতায় এটি বুঝতে পেরেছেন যে, যেকোনো ধরণের হঠকারী সিদ্ধান্ত বা বক্তব্য, হিন্দুত্ববাদী শাসনে কোণঠাসা মুসলমানদের জীবনে বাড়তি দুর্ভোগ ডেকে আনবে।

তবে, সারা ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দ যে সুরে কথা বলছেন, তার চেয়ে ভিন্ন সুরে কথা বলছেন লোকসভা সদস্য, অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। তিনি বলছেন, ‘আমি আমার মসজিদ ফেরত চাই’। লোকসভায় এ নিয়ে চারবার নির্বাচিত হয়েছেন ওয়াইসি। বর্তমান লোকসভায় ২৭ জন মুসলমান সদস্যের মধ্যে তিনি এবং ইমতিয়াজ জলিলসহ তার দলের সদস্য সংখ্যা দুই।

কিন্তু, খোদ মুসলমানদের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে তার দাবির আন্তরিকতা নিয়ে। তিনি কী সত্যি মসজিদ ফেরত চান, না মসজিদ নিয়ে রাজনীতি জিইয়ে রেখে বিজেপিকে সুবিধা দিতে চান? ওয়াইসি আসলে কার লোক এ প্রশ্নও উঠেছে ভারতীয় মুসলমানদের মাঝে। এ ধরনের প্রশ্ন উঠবার কারণ, মুসলমানদের স্বার্থে সোচ্চার হলেও তিনি এমন সব কর্মসূচি দেন, যা বিজেপিকে লাভবান করে। নির্বাচনেও তিনি এমনভাবে প্রার্থী দাঁড় করান, যাতে বিজেপিবিরোধী ভোট ভাগ হয়ে যায়।

এর বিপরীতে, ভারতীয় মুসলিম লীগকে নিয়ে এ ধরনের সন্দেহ মুসলমানদের মাঝে কখনো দানা বাধেনি। বর্তমানে লোকসভায় তাদের সদস্য সংখ্যা তিন। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় প্রত্যেকটি নির্বাচনেই তাদের কয়েকজন করে সদস্য লোকসভায় নির্বাচিত হয়ে আসছেন।

মুসলিম লীগকে নিয়ে এ সন্দেহ না হবার কারণ, স্বাধীন ভারতে তারা মুসলমানদের স্বার্থ নিয়ে কথা বললেও, একইসাথে সব সম্প্রদায়কে নিয়ে সর্ব ভারতীয় একটা জায়গা থেকে রাজনীতি করবার চেষ্টা এ দলটি সবসময় করে আসছে। ফলে, হিন্দু প্রধান এলাকাগুলিতে প্রার্থী দিয়েও বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনে তারা জয়ী হয়েছেন। আর এ জন্যই মুসলিম লীগের মত দল বিজেপির পছন্দ না।

বিজেপি চায় সর্ব ভারতীয় নয়, ওয়াইসির মত সাম্প্রদায়িক জায়গা থেকে মুসলিমরা রাজনীতি করুক। এটা বিজেপির রাজনীতি সচল রাখবার জন্য সহায়ক। অপরদিকে, শুধু ওয়াইসিই নয়, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের ‘ইসলামপন্থী’ দলগুলোর জন্যও বাবরি মসজিদ রায় আশির্বাদ স্বরূপ। এ রায় তাদের রাজনীতিকেও চাঙ্গা রাখবার জন্য সহায়ক।

প্রতিবেশি দেশগুলিতে “ইসলামপন্থীরা” এবং নিজ দেশে ওয়াইসিরা আরো বেশি সক্রিয় হোক, এটা চায় বিজেপি। কেননা, সাম্প্রদায়িক জুজুকে বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া, বিজেপির সামনে তার রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখবার আর কোনো উপাদান এ মুহূর্তে হাতে নেই।

বিজেপির শাসনামল ভারতীয় অর্থনীতিকে নিক্ষিপ্ত করেছে এক নজিরবিহীন সঙ্কটে। গত ছয় বছরে দেশটিতে চাকুরি হারিয়েছেন ৯০ লক্ষের অধিক মানুষ। তরুণ সমাজের মাঝে বেকারত্বের হার প্রবল। কৃষকরা পতিত হয়েছেন চরম দুরাবস্থায়। মোদীর শাসনামল তাদের আত্মহত্যার হার কমাতে পারেনি।

তদুপরি, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৪.৫ শতাংশে। এ ধারা নিম্নমুখী। এর বিপরীতে ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অর্থ পাচার ইত্যাদি সত্ত্বেও বর্তমান অর্থ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি থাকবে ৮ শতাংশের উপরে। ভারতের অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় ‘ধর্ম নির্ভর’ রাজনীতিবিদরা যে কতটা ব্যর্থ, এ তুলনা থেকে সেটা বোঝা যায়। আর এ ব্যর্থতার ফলেই, গত কয়েক বছরে মানব উন্নয়ন এবং সামাজিক অগ্রগতির প্রায় প্রতিটা সূচকে ভারত পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ থেকে।

এ পিছিয়ে পড়া এবং প্রবৃদ্ধির নিম্নগতি যদি অব্যাহত থাকে, তবে তা ভারতকে নিপতিত করবে তার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কটে। আর এ সঙ্কট যত ঘনীভূত হতে থাকবে, বিজেপি মুসলমানদের এর জন্য দায়ী করে, ধর্মীয় সংঘাত উস্কে দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকবার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাবে। তবে, মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে, শুধু ধর্মীয় উস্কানির উপর নির্ভর করে হিন্দুত্ববাদীরা সাময়িক কিছুটা সুবিধা পেলেও, ক্ষমতায় যে টিকে থাকতে পারবে না, অন্ততঃ ইতিহাসের শিক্ষা সেটিই বলে। সূত্র: বিডি নিউজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here