হুমায়ুন কবির, ঝিনাইদহ প্রতিনিধি :
নির্মাণে নিন্মমানের সামগ্রী ব্যবহার ছাড়াও নানা অনিয়মের সত্যতা মেলাতে কালীগঞ্জের সেই বহুল আলোচিত সড়কটির নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দ্দেশে গত দু’ সপ্তাহ আগে কাজ বন্ধের পর থেকেই রাস্তার রুলার, পিচ ঢালায় মেশিন, ও যানবাহন রেখে চলে গেছে শ্রমিকরা।

 

তবে, এরই মাঝে ঠিকাদারের লোকজন ভেকু গাড়ী দিয়ে রাস্তার কিছু পিচ ঢালায় পাথর তুলে কৌশলে নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সে সময়ে স্থানীয় জনতার বাধায় কাজ আবারো বন্ধ হয়ে যায়। অভিযোগ উঠেছে, ওই রাস্তারই পুরাতন ইট খোয়া ছাড়াও নি¤œমানের ইট দিয়ে ম্যাকাডম কাজ সম্পন্ন করা হয়। এরপর তারই উপরে নিন্মমানের পিচ কার্পেটিং ঢালায় সম্পন্নের ৭ দিনের মাথায় উঠে যাচ্ছিল রাস্তার পিচ কার্পেটিং। সড়ক ও জনপথ বিভাগের ১৯ কোটি টাকার নির্মানাধীন এ রাস্তাটির বেহাল অবস্থার খবর স্পন্দন সহ বিভিন্ন গনমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হওয়াতে টনক নড়ে সংশ্লিষ্টদের।

এরপর ছুটে আসেন সড়ক ও জনপথ ঝিনাইদহের নির্বাহী প্রকৌশলী, কালীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন, দুদক যশোর টিম ও সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ঢাকা হেড অফিসের তদন্ত টিম। তাদের সকলেই সরেজমিনে তদন্তের পর রাস্তাটিতে নির্মানে ত্রুটি হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। এদিকে খোজ নিয়ে দেখা গেছে ওই রাস্তার ১ কিঃ মিঃ সড়কের নষ্ট পিচ পাথর ভেকু গাড়ী দিয়ে তুলে উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সামনে স্তুপ করে রেখেছে ঠিকাদার। গোপনে তারা ওই নষ্ট পাথরগুলি আবারো সড়কে ব্যাবহার করতে পারে বলে এমন আশংকাও করছেন অনেকেই। আর রাস্তা খোড়ার পর নির্মান কাজটি বন্ধ থাকায় ভোগান্তীতে পড়েছে ভুক্তভোগীরা।

রাস্তাটির বর্তমান অবস্থা দেখতে সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, আমতলা বাজার নামক স্থানে ফিডার রাস্তার পাশেই কাজের পিচ ঢালায় মেশিন, রুলার ও যানবাহন গুলি রাখা রয়েছে। সেখানে উপস্থিত স্থানীয়রা বলেছে, ১০/১২ দিন আগে ওই গাড়ীর ড্রাইভার শ্রমিকরা গাড়ীগুলো রেখে চলে গেছে। এখন ওই বাজারেরই নাইটগার্ড গাড়ী গুলো দেখভাল ও রাতে পাহারা দিচ্ছেন। এ সময় সাংবাদিকদের দেখে এগিয়ে এসে রাস্তা সংলগ্ন কমলাপুর গ্রামের মোশারেফ হোসেন জানান, এত নি¤œমানের রাস্তা তৈরি তারা জীবনেও দেখেনি। ঠিকাদারের লোকজন এই রাস্তারই পুরাতন ইট খোয়া তোলার পর সেই ইট খোয়াই রাস্তাতে ব্যাবহার করেছে। তাই ৬/৭ দিনেই রাস্তা উঠে যাচ্ছে। এরপর রাস্তার কাজের লেবার শ্রমিকেরা বাজার গোপালপুরের একটি ভাড়া বাড়িতে আছে শুনে সেখানে গেলেও তাদের কাউকেই পাওয়া যায়নি।

এদিকে স্থানীয়দের কেউ কেউ বলেছে, এ রাস্তার ঠিকাদার ঝিনাইদহের মিজানুর রহমান মাছুম একজন প্রভাবশালী। সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপরি মহলের অসাধু কর্তাদের সাথে তার বেশ সখ্যতা আছে। এবং তিনি যে এলাকাতেই কাজ করেন সেই এলাকার প্রভাবশালীদেরও ম্যানেজ করে থাকেন। নিয়ম আছে সরকারী কাজ শুরুর আগে রাস্তার নকশার সাইনবোড প্রদর্শনের কথা। কিন্তু তিনি সেটাও করেননি। ওই রাস্তার পুরোটা ঘুরে কোথাও সাইন বোর্ডের দেখা মিলেনি।

খোজ নিয়ে জানা গেছে, টেন্ডারে ওই রাস্তার কাজটি পান খুলনার মুজাহার এন্টার প্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু হাত বদল হয়ে রাস্তার কাজটি করছেন ঝিনাইদহের ঠিকাদার মিজানুর রহমান মাসুম মিয়া। তাই রাস্তার কাজের সর্বশেষ অবস্থার বিষয়টি জানতে রোববার বিকালে ঠিকাদার মাসুম মিয়ার মোবাইলে কয়েকবার কল দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

এদিকে বর্তমানে ওই সড়কের কাজের সার্বিক অবস্থা জানতে রোববার দুপুরে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঝিনাইদহ নির্বাহী প্রকৌশলী জিয়াউল হায়দারের মুঠোফোনে কল দেওয়া হয়। এ সময় তিনি অপর প্রান্ত থেকে অফিসের বাইরে আছেন বলে জানিয়ে, খবর জানতে সাংবাদিককে তার অফিসে আসতে বলেন। তবে অন্য একটি মাধ্যম থেকে জানা গেছে, রাস্তাটির নির্মান ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।

উল্লেখ্য, কালীগঞ্জ থেকে গান্না হয়ে ঝিনাইদহের ডাকবাংলা পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার এ রাস্তার মজবুতিসহ ওয়ারিং এর কাজ চলছে তিন বছর ধরে। এরিমধ্যে তিন কিলোমিটার পিচ কার্পেটিং কাজ সম্পন্ন করেছিল। কিন্তু ৭ দিনের মধ্যে ওই সড়কের শ্রীরামপুর এলাকার প্রায় এক কিলোমিটার অংশে রাস্তার পিচ ঢালাই উঠে যায়। এবং কোথাও কোথাও বড় বড় ফাটলের সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে সে সময়ে বিভিন্ন পত্রিকাতে অনিয়মের খবর প্রকাশের পরই শুরু হয় তোড়জোড়। এরপর প্রথমে স্থানীয়ভাবে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সূবর্না রানী সাহা ও সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঝিনাইদহ নির্বাহী প্রকৌশলী জিয়াউল হায়দার রাস্তাটি পরিদর্শনে আসেন। তারা নির্মানে ত্রæটির কথা স্বীকার করে তারা খারাপ অংশটি তুলে পুনরায় নতুন করে নির্মানের জন্য ঠিকাদারকে নির্দ্দেশ দিয়ে গেছেন। এরপর গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাস্তাটি দেখতে সরেজমিনে পরিদর্শনে আসেন দুদকের যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নাজমুস সাদাত। সে সময় তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, সড়কটিতে অতি নি¤œমানের নির্মান সামগ্রী ব্যবহারের কারনেই পিচ উঠে যাচ্ছে। যে কারনে এমন অনিয়মের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুদক যথাযথ ব্যবস্থা নিবেন বলেও জানান।

এ নিয়ে গনমাধ্যমে ধারাবাহিক খবরে আলোচিত ওই রাস্তাটির অনিয়ম তদন্তে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। সর্বশেষ গত ৯ অক্টোবর শুক্রবার বিকালে ঢাকা থেকে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে উপ সচিব আব্দুল মোক্তাদের নেতৃত্বে ২ সদস্যের একটি তদন্ত টিম কালীগঞ্জে আসেন। তারা রাস্তার নমুনা নিয়ে গেছেন এবং খুব শিঘ্রই অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিবেন বলেও জানিয়েছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here