ড. সাখাওয়াৎ আনসারী: যে লেখাটি এখন লিখছি, তা দুদিন আগে হলে অনেক বেশি আবেদনময় হতো। তা-ও যে লিখছি, তা শ্রদ্ধাতর্পণের আবার কাল-অকাল বা সময়-অসময় কী, এই বিবেচনায়।

এক.

আমি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের পরিচিতিলাভে সৌভাগ্যধন্য হই ১৯৯৯ সালে; ছাত্রাবস্থায় তো নয়ই, এমনকি শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানেরও বছর ছয়েক পর। আমি তখন Contributions of Munier Chowdhury to the Bengali Language and Linguistics শীর্ষক এক গবেষণায় রত ছিলাম। গবেষণার জন্যে আমার প্রয়োজন হয়ে পড়ে মুনীর চৌধুরী রচিত An Illustrated Brochure on Bengali Typewriter পুস্তিকাটি। কিন্তু পুস্তিকাটি কোথাও না পেয়ে এক পর্যায়ে দ্বারস্থ হই তাঁর। বাংলা বিভাগে তাঁর বসার কক্ষে সালাম দিয়ে ঢুকে নিজের পরিচয় দিয়ে উদ্দেশ্য ব্যক্ত করি। তিনি বললেন, “স্যার ( মুনীর চৌধুরী) আমাকে উপহার হিসেবে একটা কপি দিয়েছিলেন। আজ রাত নটায় ফোন করে আমাকে একটু স্মরণ করিয়ে দিও। যদি পেয়ে যাই তো যত্ন করে রেখ। বোঝ তো, স্যারের স্মৃতি”। রাত নটায় ফোন করলাম। স্যার বললেন, ” সাখাওয়াৎ, আমার মনে আছে। এরই মধ্যে আমি বইটা বের করে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছি। কালকে তুমি সাঈদ (বাংলা বিভাগের কর্মচারী)-এর কাছ থেকে এটা নিয়ে নিও”। পরদিনই সাঈদ ভাইয়ের কাছ থেকে বইটি সংগ্রহ করলাম। মলাট উল্টিয়েই দেখি কালো কালিতে লেখা : “আনিসকে”; নিচে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর স্বাক্ষর। এই স্বাক্ষরের নিচে পেন্সিলে লেখা “সাখাওয়াৎকে”। বুঝলাম এটি আনিস স্যারের লেখা। হয়তোবা নামটি যাতে ভুলে না যান, অথবা বইটি কাকে দিতে হবে, তা যাতে স্মরণে থাকে, তার জন্যেই আমার নামটিও লিখে রাখা। মুনীর চৌধুরীর লেখা ” আনিসকে” এবং তাঁর স্বাক্ষর সম্বলিত বইটি পাওয়ামাত্রই ব্যাপক আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। বার বার হাত বুলাতে থাকি কালো হরফগুলোর ওপর; অনুভব করার চেষ্টা করতে থাকি বত্রিশ বছর আগের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর স্পর্শলাভের। মনে হতে থাকে এই সেই মুনীর চৌধুরী, যিনি হায়েনাদের নখরাঘাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে যাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি আজও (তখনও) হয়তোবা অস্বাভাবিক ছিল না। দ্রুত পুস্তিকাটি ফটোকপি করে ফেলি। পেন্সিলে লেখা “সাখাওয়াৎকে”-ও অস্পষ্টভাবে দৃষ্ট হয়ে ওঠে। পুস্তিকাটি স্যারের কাছে ফেরত দেয়ার জন্যে সাঈদ ভাইকে বুঝিয়ে দিই। আনিস স্যারের চলে যাবার পর এবার আর মুনীর চৌধুরীর নয়, এবার স্পর্শ করলাম আনিসুজ্জামানের লেখা “সাখাওয়াৎকে”-র ওপর; অনুভব করতে থাকি বিশ বছর আগের তাঁকে। আজ মুনীর চৌধুরী স্মৃতি, আনিসুজ্জামান স্মৃতি, স্মৃতি সাঈদ ভাইও। অস্পষ্ট হরফের ” সাখাওয়াৎ”-ও এক দিন স্মৃতিই হয়ে যাবে। সেদিন আর কত দূর?

দুই.

২০১৪ সালের ২১শে নভেম্বর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এক আন্তর্জাতিক সেমিনার। বিষয়: বাংলা ভাষা পরিকল্পনা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিচারপতি খায়রুল হক, মূল প্রবন্ধকার অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আমি হলাম পরবর্তী এক অধিবেশনের প্রবন্ধকার। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরের অধিবেশন। সভাপতিত্ব করছেন বিচারপতি খায়রুল হক। বিষয় : আইন-আদালতে বাংলা ভাষা। মঞ্চে এবং প্রথম সারিতে বসে আছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রোপাচার্য, ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দসহ অতিথিবৃন্দ। সিনেট ভবন ভর্তি। সভাপতি এক পর্যায়ে উল্লেখ করলেন যে আদালতে শতভাগ বাংলার প্রচলন সম্ভব নয়। দর্শকসারি থেকে আমি কিছু বলার জন্যে দু’ মিনিট সময় চাইলাম। তিনি অনুমোদন করলেন। আমি মঞ্চে গিয়ে অন্য দু’ একটি কথার পর বললাম, “বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক সত্যেন বোস, যাঁকে বলা হয় “One of the five fathers of Modern Physics” (পাঁচজনের একজন আইনস্টাইন), বলেছেন, ‘যাঁরা বলে যে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়, তাঁরা হয় বিজ্ঞান বোঝে না, নয়তো বাংলা জানে না’। এই একই সূরে আমি বলতে চাই যে ‘যাঁরা বলেন যে বাংলা ভাষায় আইন-আদালত পরিচালনা সম্ভব নয়, তাঁরা হয় আইন বোঝেন না, নয়তো বাংলা জানেন না”‘। আমার বক্তব্যে পুরো হল করতালিমুখর হয়ে উঠল। সভাপতি বিব্রতবোধ করলেন। এরপর মধ্যাহ্নভোজ। বিচারপতি খায়রুল হক অন্যত্র। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বহু মানুষের মধ্যে আমাকে দেখে দূর থেকেই বললেন, “সাখাওয়াৎ তুমি ঠিকই বলেছ। আমার স্মৃতিপটে তাঁর এই শংসাবাচন চির অমলিন হয়ে রয়েছে।

তিন.

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন বাংলাদেশ ভাষা সমিতির উপদেষ্টা; সভাপতি অধ্যাপক মনসুর মুসা, আমি সাধারণ সম্পাদক। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। সূচনালগ্নে এর উপদেষ্টা ছিলেন ড. মুহম্মদ এনামুল হক, সভাপতি ছিলেন ড. আহমদ শরীফ, সহসভাপতি ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক মনসুর মুসা। ৪৪ বছর ধরেই তিনি এর সঙ্গে জড়িত। যখনই সমিতির কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করে তাঁকে ফোন করেছি, তিনি তাৎক্ষণিক ফোন ধরতে না পারলে পরে কখনোই কল ব্যাক করতে ভুল করতেন না। আমার নম্বর তাঁর সেভ করা ছিল না। তিনি নানান ব্যাস্ততায় আসতে পারতেন না। তবে পরে ফোন করে খোঁজ নিতেন। না আসতে পারার জন্যে দুঃখও প্রকাশ করতেন। তাঁর এই ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধে মুগ্ধ হয়েছি।

চার.

২০১৭ সালের ৮ই নভেম্বর। বাঙলার পাঠশালা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে আয়োজন করে এক সেমিনার। এতে ” আমাদের সংবিধানে মূলনীতি” শীর্ষক একমাত্র প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। সেখানে আমি সংবিধানে উল্লেখকৃত “ইংরেজিতে অনুদিত” শব্দজোড় ব্যবহারের যাথার্থ্য নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলাম। সবাই জানেন যে সংবিধানের বাংলা পাঠ তৈরিতে মূল ভূমিকা ছিল তাঁরই। তিনি প্রশ্নটির কোনো সদুত্তর না দিয়ে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেলেন। সেমিনার শেষে তিনি গাড়িতে চড়বেন, এমন সময় দূর থেকে আমাকে দেখে ইশারায় কাছে ডাকলেন। অন্যদের আড়াল করে আমাকে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ। আড়ালে যা বলা যায়, সবার সামনে সব সময় তা বলা যায় না”। সেদিন তাঁর কষ্টবোধে দুঃখ পেলেও সত্যস্বীকারে প্রীত হয়েছিলাম।

পাঁচ.

২০১৮ সালের ১৮ই জুলাই। জাতীয় অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত হওয়ায় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এবং অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে দেয়া হয় সংবর্ধনা। অনুষ্ঠান শেষে মধ্যাহ্নভোজে একই টেবিলে বসেছেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এবং অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। দূর থেকে আমাকে দেখে তিনি ডাকলেন, “সাখাওয়াৎ”। কাছে গেলে তিনি বললেন, ” তুমি আবার আমার মাথায় টোপর পরালে কেন”?। আমি ছিলাম অনুষ্ঠান আয়োজনের আহ্বায়ক। আমন্ত্রণপত্রটিও আমারই করা। সেখানে লেখা ছিল, “অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের ওপর প্রশস্তিপাঠ”। তাঁর মনে হয়েছে যে “ওপর” শব্দটির ব্যবহার না করাই ছিল যথাযথ। ক্ষুদ্র হয়ে বৃহতের সঙ্গে বিতর্কে রত হওয়া ঔদ্ধত্য বিবেচনায় মৌন থাকলাম। সেই স্যারের সঙ্গে অন্তিম দেখা ও কথা।

আর কোনো দিন তাঁর জলদগম্ভীর “সাখাওয়াৎ” ডাক শুনব না। তবে তাঁর অস্পষ্ট হরফে লেখা “সাখাওয়াৎ” সঙ্গী থাকবে চিরকাল। লেখাটুকু থেকে যাবে, যদিও আমি নিজেই এক দিন অস্পষ্ট হয়ে যাব স্যারেরই মতো।

ড. সাখাওয়াৎ আনসারী

অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here