নিউজবাংলা ডেস্ক:
বিজেপি সরকারে বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে বিক্ষোভে দেশটির রাজধানী দিল্লিও উত্তাল হয়ে উঠেছে। রোববার সন্ধ্যায় দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়া ছাড়াও ক্যাম্পাসে ঢুকে শিক্ষার্থীদের মারধর ও আটক করা হয়।
জামিয়া মিলিয়ার শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের এমন নির্যাতনের প্রতিবাদে সন্ধ্যা থেকে ক্ষোভ জানাতে শুরু করে দেশটির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রোববার সন্ধ্যার সংঘর্ষের পর আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দিল্লির জামিয়ার মিলিয়ার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে।
মধ্যরাতে হায়দারাবাদের মাওলানা আজাদ উর্দু বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থীও মধ্যরাতে দিল্লি পুলিশের সদর দফতরের সামনে জড়ো হয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের নির্যাতনের নিন্দা ও গ্রেফতার শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবি জানায়।
গতকাল সন্ধ্যায় জামিয়ার মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ছোড়াসহ বিক্ষোভকারীদের গ্রেফতারের পর এই পরিস্থিতির সূত্রপাত। তারপর শিক্ষার্থীরা বেশ কিছু গাড়িতে ভাঙচুর চালায় ও আগুন জ্বালিয়ে দেয়। পরে পুলিশ ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকে প্রায় একশ শিক্ষার্থীকে আটক করে।
প্রায় মাঝরাতে হায়দারাবাদের মাওলানা আজাদ উর্দু বিশ্ববিদ্যালয় ও বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। এদিকে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা মধ্যরাতে ক্যাম্পাসের আশপাশের এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করে। উর্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের পরীক্ষা পিুছিয়ে দেয়ার দাবিও জানায়।
প্রচন্ড ঠাণ্ডার মধ্যে গতকাল মধ্যরাতে দিল্লি পুলিশের সদর দফতরের সামনে শত শত বিক্ষোভকারী জড়ো হয়। পুলিশ সদর দফতরের সামনের মূল সড়কের সবটা জুড়ে তখন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরাই। এদিকে পুলিশও সেখানে কাঁদানে গ্যাস ও জলকামান নিয়ে প্রস্তুত ছিল। তারপর রাত চারটার দিকে আটক শিক্ষার্থীদের ছেড়ে দেয় দিল্লি পুলিশ।
জামিয়া মিলিয়ার ঘটনার পর প্রথম প্রতিরোধ-বিক্ষোভ জানাতে শুরু করে প্রতিবেশী আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা একটি সংহতি মিছিলের আয়োজন করে, পরে পুলিশ সেটি ছত্রভঙ্গ করতে গেলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে।
তাতে প্রায় ৩০ শিক্ষার্থী ও দশ পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশ সব হোস্টেল খালি করে দেয়ার নির্দেশ দেয়। শহরে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টি আগামী ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এমন ঘোষণা আসার পরপরই ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে।
সন্ধ্যায় জামিয়া মিলিয়ায় শুরু হওয়া বিক্ষোভ মিছিলটি রাজধানী শহরের প্রতিবাদী মঞ্চ হিসেবে বিবেচিত যন্তর মন্তর নামক এলাকায় গিয়ে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মিছিল শুরু হতেই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে বিক্ষোভকারীদের। তাতে শিক্ষার্থী ছাড়াও পুলিশের অনেকে মারাত্মকভাবে আহত হন। বিক্ষোভকারীরা দুটি বাসে আগুন দেয়।
তারপর পুলিশ অন্তত একশ শিক্ষার্থীকে আটক করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রক্টর ওয়াসিম আহমেদ খান বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুমতি দেয়া না হলেও পুলিশ জোর করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ে। আমাদের কর্মী ও শিক্ষার্থীদের বেধড়ক মারপিট শুরুর পর তাদের আটক করতে থাকলে অনেকে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়।’

পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা চিন্ময়া বিশ্বল অবশ্য দাবি করেছেন, সহিংস বিক্ষোভ ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে শুরু হলে এবং পাথর নিক্ষেপ শুরু কলে পুলিশের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। এনডিটিভিকে তিনি বলেন, ‘আমরা এটা দেখার চেষ্টা করছিলাম যে এসব সহিংস বিক্ষোভকারী কোথায় অবস্থান নেয় এবং কি করে।’

পুলিশ বিক্ষোভকারী সংঘর্ষের পর ওই এলাকার মেট্রোরেল পরিষেবা বন্ধ করে দেয়া হয়, বন্ধ থাকে পাঁচটি স্টেশন। সড়কে চলাচলের গতিপথ বদলে দেয়া হয়। এক টুইট বার্তায় দিল্লির উপ-মুখ্যমন্ত্রী মনীশ সিসোদা বলেন, ‘দক্ষিণপূর্ব জেলার জামিয়া, ওখলা, নিউ ফ্রেন্ডস কলোনি এবং মদনপুর খাদারের স্কুলগুলো আগামী সোমবার (আজ) বন্ধ থাকবে।’

অপর এক টুইট বার্তায় দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এই সহিংসতার নিন্দা করে লিখেছেন, ‘পুলিশ প্রধানের সঙ্গে কথা বলে স্বাভাবিক অবস্থা ও শান্তি ফিরিয়ে আনতে সকল পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছি। আমরা আমাদের জায়গা থেকে সম্ভাব্য সব করার চেষ্টা করছি। প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।’

মোদি সরকারের সদ্যপ্রণীত আইনটি নিয়ে উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্য আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়ম ও ত্রিপুরাসহ বিক্ষোভ চলছে । আসামের বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত ছয়জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া আছে। রেল ও সড়কপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ জানাচ্ছে মানুষে। পশ্চিমবঙ্গে ছয়টি ট্রেনে আগুন দেয়া বাস পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ভারতের ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে এ সংশোধনে গত সোমবার ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় একটি বিল (সিএবি) উত্থাপন করেন অমিত শাহ। ব্যাপক বিতর্কের পর সেদিন মধ্যরাতে বিলটি পাস হয়। এরপর গত বুধবার রাজ্যসভায়ও বিলটি পাসের পর রাষ্ট্রপতি গত বৃহস্পতিবার স্বাক্ষর করায় সেটি এখন আইন।

নতুন এই আইন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ ২০১৫ সালের আগে প্রতিবেশী পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে ‘ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার’ হয়ে যেসব অমুসলিম (হিন্দু, শিখ, খ্রিষ্টান, জৈন, পারসি ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা) ভারতে গেছেন তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেয়া হবে।

বিরোধী দলের এমপিরা পার্লামেন্টে মোদি সরকারের প্রস্তাবিত এ বিলটিতে আপত্তি জানালেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় বিলটি পাসে কোনো বেগ পেতে হয়নি সরকারকে। বিরোধীরা বলছেন, নতুন আইনের মাধ্যমে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের নাগরিক সুরক্ষাকে উপেক্ষা করা হবে, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন রাজ্য আসামসহ উত্তরপূর্ব ভারতে বিক্ষোভকারীদের দাবি, আইনটির মাধ্যমে অন্য দেশ থেকে আসা অভিবাসীরা সহজেই এ দেশের (ভারতের) নাগরিকত্ব পাবেন। তাতে সংকটে পড়বেন আদি বাসিন্দারা। তবে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বলেছেন, আইনটিতে উত্তরপূর্বের অনেকটা অংশই বাদ দেয়া হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here