হামিদ বিশ্বাস

ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের প্রায় ৮৭ শতাংশই মন্দ মানের (কুঋণ)। এর পরিমাণ ৮৩ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। গত ছয় মাসে মন্দ ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। এর বাইরে অবলোপনকৃত (রাইট অফ) মন্দ ঋণ রয়েছে আরও ৪৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকা।

বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের মূল হিসাব থেকে এটা বাদ দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে আদায় অযোগ্য খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ২৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। আর সরকারি ব্যাংকগুলোতেই আদায় অযোগ্য খেলাপি ঋণ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যথাযথ নিয়মাচার ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সর্বোত্তম পরিপালন না করে ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করায় ঋণের বড় অংশই খেলাপি হয়ে একটা সময় আদায় অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এই মানের ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। এই ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর পরিচালন আয় কমে নিট মুনাফায় প্রভাব পড়ছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, মন্দমানের খেলাপি ঋণ ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। তার মানে মোট খেলাপির ৮৭ শতাংশই আদায় অযোগ্য। এটা অত্যন্ত ভয়াবহ চিত্র। এখানেই শেষ নয়, ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নিয়ে যে পুনঃতফসিল করা হয়েছে, তার বেশিরভাগই মন্দ ঋণ। অর্থাৎ মন্দ ঋণের হার আরও বাড়বে। তিনি বলেন, খেলাপিদের আর সুযোগ দেয়া যাবে না। আগে যারা সুবিধা নিয়েছেন, তারা যেন নতুন করে খেলাপি না হন-সেদিকে নজর দিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, মোট খেলাপির ৮৭ শতাংশ মন্দ ঋণ। এটা খুবই বিপজ্জনক সংকেত। তিনি বলেন, সব সময় আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বড় ঋণখেলাপিরা বেরিয়ে যাচ্ছেন। তারা ব্যাংকে খেলাপি হলেও প্রকাশ্যে সবই করছেন। মনে হয় এটা কোনো অপরাধের মধ্যেই পড়ে না। তাদের রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি এমনকি বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমের খবরে দেখা যায় তারা দেশের বাইরেও মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। তার মতে, সুশাসন এবং সদিচ্ছা না থাকলে খেলাপির এই সংস্কৃতি থেকে বের হওয়া যাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের তিনটি পর্যায় রয়েছে। এগুলো হল : নিুমান, সন্দেহজনক ও মন্দ মান। অর্থাৎ সর্বশেষ ধাপের খেলাপি ঋণকে মন্দ বা ক্ষতিজনক বলে ধরা হয়। এটা ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ হিসেবেও বিবেচিত। এ জন্য এই ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। অপর দুটি পর্যায়ের মধ্যে সন্দেহজনক ঋণে ৫০ শতাংশ ও নিুমানের ঋণে ২০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, তদবির ও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ বের করে নেয়া হয়েছে। এখন সেই ঋণের একটা বড় অংশ খেলাপি হয়ে মন্দ মানে পরিণত হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে আরও দেখা যায়, মোট মন্দ ঋণের ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশই রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকের। এর পরিমাণ ৩৯ হাজার ৮৬৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এর পরেই রয়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। বেসরকারি ব্যাংকের মোট মন্দ ঋণের পরিমাণ ৩৮ হাজার ১৫৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা, যা মোট মন্দ ঋণের ৪৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। এ ছাড়া বিদেশি ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর যথাক্রমে ২ দশমিক ৩০ ও ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ মন্দ ঋণ রয়েছে।

মহামারী করোনার কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধে ছাড় দেয়ায় প্রথম তিন মাসে (মার্চ প্রান্তিক) খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা কমে ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকায় নেমে আসে। দ্বিতীয় তিন মাসে (জুন প্রান্তিক) আবার খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা বেড়ে ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই খেলাপির মধ্যে ৮৩ হাজার ৬৪২ কোটি টাকাই মন্দ মানের, যা মোট খেলাপির প্রায় ৮৭ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে ৯৪ হাজার ৩১২ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দ মানের খেলাপি ছিল ৮১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত ছয় মাসের ব্যবধানে মন্দ মানের খেলাপি বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা।

ব্যাংকভিত্তিক খেলাপি ঋণ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণের গড় হার ২২ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এই হার বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ, বিদেশি ব্যাংকে ৫ দশমিক ৪১ শতাংশ ও বিশেষায়িত ব্যাংকের ১৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। তবে মার্চে এই হার ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে ২২ দশমিক ৮২ শতাংশ, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ, বিদেশি ব্যাংকে ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং বিশেষায়িত ব্যাংকে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ। অর্থাৎ গত তিন মাসে সরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের গড় হার যথাক্রমে ০.০৯ ও ০.১০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের গড় হার যথাক্রমে ০.২৩ ও ০.৮২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here