সৈয়দ তোশারফ আলী

মানবপ্রজাতি আজ এক ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস এখনও পর্যন্ত এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া প্রতিটি মহাদেশেই সংক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। ইতিমধ্যে মৃতের সংখ্যা ৬ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এ সংখ্যা সামনের দিনগুলোতে কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ বলতে পারে না। উন্নত, উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত সব ধরনের দেশই বিপদের মধ্যে রয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে ভাইরাসও যে বৈশ্বিক চরিত্র পাবে এমনটি সম্ভবত কেউ ভাবেননি। তবে ভাইরাস নিয়ে যারা গবেষণায় বিপুল অর্থ ঢেলে থাকেন তারা এরকম শক্তিশালী অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণ সম্ভাবনা নিয়ে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এছাড়া বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ভাইরাস আক্রমণে ব্যাপক প্রাণহানি এবং প্রচলিত অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। তাদের এ পূর্বাভাষ ছিল সার্স, মার্স, সোয়াইন ফ্লু, ইবোলা ভাইরাস মোকাবিলার অভিজ্ঞতা প্রসূত। মার্কিন ধনকুবের বিল গেটস্ও অদৃশ্য শত্রু সম্পর্কে ১৯১৫ সালে আশঙ্কা প্রকাশ করে কিছু কথা বলেছিলেন। এছাড়া ‘কন্টাজিওন’ চলচ্চিত্রে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণচিত্র ফুটিয়ে তোলার দৃশ্য দেখে অনেকে আতঙ্কিত বোধ করেছিলেন। উক্ত ছবির কাহিনীও দৃশ্যের সঙ্গে আজকের ভয়াবহতার অপূর্ব মিল রয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে এ জাতীয় ভাইরাস যে কতোটা বিধ্বংসী রূপ নিতে পারে, সেটা বোধ হয় ঐ চলচ্চিত্র নির্মাতারাও আন্দাজ করতে পারেন নাই।

একুশ শতকের নতুন সম্ভাবনা নিয়ে যখন চিন্তা-ভাবনা চলছিল ঠিক তখন এই প্রাণঘাতী ভাইরাস মানবজাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিন্তা-গবেষণাকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। দীর্ঘ সময় জুড়ে মানব প্রজাতিকে দুটি পরাশক্তির যুদ্ধভীতির মধ্যে থাকতে হয়। বিশ শতকের শেষ দশকে এসে সোভিয়েত ইউনিয়ন অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। তখন ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলো স্বাধীনভাবে পথ চলা শুরু করে এবং কথিত সমাজতন্ত্রের পথ পরিত্যাগ করে। আর লেনিন, স্ট্যালিনের সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া ‘রুশ ফেডারেশন’ নাম ধারণ করে টিকে থাকে। দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ রাজনীতির ইতিহাসে প্রেস্ত্রইকা ও গ্লাসনস্ত, এই দু’টি রুশ শব্দ সংযোজন করে ক্ষমতার মঞ্চ থেকে বিদায় নেন। এ শব্দ দু’টির অর্থ হচ্ছে, পুনর্গঠন ও স্বচ্ছতা। তারপর রুশ দেশের রাজনীতির হাওয়া রাতারাতি বদলে যেতে শুরু করে। তবে রুশ বিপ্লবের অবিসংবাদিত নেতা লেনিনের মূর্তি সরিয়ে ফেলা হলেও তার প্রবর্তিত একদলীয় সাম্যবাদী শাসন বহাল থেকে যায়। আসলে স্বাধীন গণমাধ্যম এবং স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার অবর্তমানে ডিক্টেটরী শাসন কোথাও একবার চালু হলে তা আর সহজে বিলুপ্ত হয় না। একদলীয় নির্বাচনী ব্যবস্থা, অনুগত আমলাতন্ত্র এবং শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় খাতের শিল্প-বাণিজ্য যে কায়েমী স্বার্থের সৃষ্টি করে তারা এর সুফল ভোগ করা। পরিত্যাগ করতে চাইবে কেন? ভ্লাদিমির পুটিন উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়ার ভিত্তি এবং কাঠামোকে ব্যবহার করেই দীর্ঘকাল রাশিয়ার ক্ষমতায় টিকে রয়েছেন এবং সম্প্রতি সংবিধান সংশোধন ও গণভোট অনুষ্ঠান করে তিনি ২০৩৬ সাল পর্যন্ত দেশটি শাসন করার বৈধতা ঠিকই নিয়ে নিয়েছেন। সামরিক শক্তি ও প্রভাবের দিক দিয়ে পুটিনের রাশিয়া বিশ্ব রাজনীতিতে এখনও অন্যতম প্রধান শক্তিধর রাষ্ট্র।

অন্যদিকে একমাত্র পরাশক্তি আমেরিকার ছিল সম্পদের প্রাচুর্য্য। অর্থনীতি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। আমেরিকার বড় বড় কোম্পানীর সিইওরা ছিল বিশ্বের সেরা মেধার অধিকারী। বিশ্বের অনেকগুলো শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আমেরিকায়। সামরিক শক্তিতেও তার কোন জুড়ি ছিল না। কিন্তু দেশটি শান্তি ও সম্প্রীতির পৃথিবী গড়ে তুলতে অগ্রনী ভূমিকা রাখতে পারে নাই। কর্তৃত্ব ও আধিপত্য করতে গিয়ে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার মহতী উদ্যোগে নেতৃত্বের ভূমিকা রাখতে চায় নাই। তার মেধা, বুদ্ধিমত্তা, শক্তি ও সম্পদ বেশি বেশি ব্যবহৃত হয়েছে যুদ্ধ ও সংঘাতে তথা সামরিক শক্তি পরীক্ষায়। অথচ সহযোগিতার মাধ্যমে সাম্য ও স্বাধীনতার মহতী লক্ষ্য অর্জনে আগ্রহ দেখালে আজ বিশ্বের চেহারা হতো অন্য রকম। দেশটির ফাউন্ডিং ফাদারসরা সেই স্বপ্নই দেখেছিলেন।

একদা আমেরিকা পারমাণবিক অস্ত্রের একক মালিক ছিল। দ্বিতীয় বিশ্যুদ্ধে এই অস্ত্র ব্যবহার করে জাপানকে উচিত শিক্ষা দিতে পেরে আমেরিকা বেশ তৃপ্তিও অনুভব করেছিল। কিন্তু দেশটি জাপানের আত্মসমর্পণের পর ব্যাপক ধ্বংসের চিত্র দেখে পরমাণু বিজ্ঞানীদের কিছু পরামর্শকে কার্যকর করার পদক্ষেপও নিয়েছিল। স্মরণীয় সেদিনের ‘বারুচ পরিকল্পনার (১৯৪৬) কথা, যে পরিকল্পনায় ‘আন্তর্জাতিক পারমাণবিক উন্নয়ন সংস্থা’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, এই সংস্থার হাতে থাকবে খনি থেকে ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম সংগ্রহের ও আকরিক পরিশোধনের অধিকার ও যাবতীয় উপাদান ও উপকরণের মালিকানা। এই প্রস্তাবে এমন কথাও বলা হয়েছিল যে, পারমাণবিক শক্তিকে কাজে লাগানোর ও প্রয়োজনীয় প্ল্যান্ট নির্মাণ ও পরিচালনার একমাত্র অধিকার থাকবে এই সংস্থার। আর এই সংস্থাটি গঠনের ভার থাকবে জাতিসংঘের উপর। আর তখন পর্যন্ত প্রাপ্ত সব তথ্য জাতিসংঘের হাতে তুলে দিতে সম্মত হয়েছিল আমেরিকা। কিন্তু আমেরিকার প্রস্তাবটি যথেষ্ট উদার হওয়া সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয় নাই। তাই কার্যকরও হয় নাই। জোসেফ স্ট্যালিনের রাশিয়া এ সময়ে জার্মানদের পরাজিত করার গর্বে বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিল। তদুপরি ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে যে কোন প্রস্তাব আটকে দেয়ার বিধান থাকায় সোভিয়েত ইউনিয়ন নিশ্চিত ছিল যে রাষ্ট্রসংঘে ভোটাভুটির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে কিছু করতে পারবে না। পারমাণবিক যুদ্ধের বিপদ এড়ানোর জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন বরাবরই এর বিরোধীতা করে যায়। তারা যুক্তি দেখায়, এরকম কোনো সংস্থা গঠিত হলে সেই সংস্থাটি এমন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সংহত ও স্থায়ী করে তুলতে চাইবে যা তাদের বিবেচনায় মানব প্রজাতির জন্য ক্ষতিকর। এই আপত্তি দূর করার জন্য প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার অবকাশ ছিল। কিন্তু প্রস্তাবটি তৎকালীন সোভিয়েত সরকার সরাসরি নাকচ করে দিলে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমী দুনিয়ার সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটে। এই সুযোগে আমেরিকা বলে বসে, এ রকম প্রস্তাব আর কখনও উত্থাপন করা হবে না।

তার পর ভলগা-মিসিসিপি দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে, একাধিক ভয়ংকর যুদ্ধও সংঘটিত হয়েছে, এমনকি কোরিয়া নিয়ে, কিউবা নিয়ে পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু হয়নি। এরপর স্নায়ুযুদ্ধ, ঠান্ডা যুদ্ধের পর্ব পেরিয়ে এখন চলছে অবরোধ এবং বাণিজ্য যুদ্ধের যুগ। আর কনভেনশনাল যুদ্ধ তো কমবেশি জারি রয়েছে। এসব যুদ্ধের পেছনে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ থাকার কারণে জাতিসংঘের পক্ষে এসব যুদ্ধ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

প্রশ্ন উঠতে পারে, শান্তি যেমন পরম কাক্সিক্ষত যুদ্ধও কী তেমনি অপরিহার্য? হ্যাঁ, ঠিক তাই। বিপরীতের ঐক্যই নিয়ম। এইজন্য ন্যায় যুদ্ধ এবং অন্যায় যুদ্ধ বলে যুদ্ধের শ্রেণীভেদ করা হয়েছে। মানুষ প্রজাতি হোমো সেপিয়ান বা মনন প্রবন প্রজাতি হওয়া সত্বেও মানুষের প্রকৃতিতে আদিম হিংস্রতা বিদ্যমান। সভ্যতার বড়াই করা সত্ত্বেও মানুষ প্রজাতি হিংসা পরিহার করতে অনিচ্ছুক। স্বভাব-চরিত্র সহজে বদলায় না! কথায় বলে, কয়লা ধুলে ময়লা যায় না। অহিংসার কথা শেষ তীর্থাঙ্কর মহাবীর বলেছেন, গৌতম বুদ্ধও বলেছেন। অহিংসাকে তারা জীবনের প্রধান ব্রত বলে প্রচারও করেছেন। আধুনিক কালে মহাত্মা গান্ধীও অহিংসার সাধনা করেছেন। কিন্তু অহিংসা হনুজ দূর অস্ত! হিমালয় সংলগ্ন লাদাক সীমান্তে চীন-ভারত মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সৈন্য ও সমরাস্ত্রের বিপুল সমাবেশ করা হয়েছে। সম্প্রতি দু’পক্ষের সৈনিকদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনায় হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। ভারতীয় সৈনিকদের বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, ‘দুর্বল শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে না, শান্তির জন্য প্রয়োজন শক্তি।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন জন ফস্টার ডালেস। তার লেখা ‘ওয়ার অর পিস’ নামের বইটি বেশ বিখ্যাত। বিজেপী নেতা মোদি যা বলেছেন, ফস্টার ডালেসও তার বইয়ে একই কথা বলেছেন। শান্তি চাইলে যুদ্ধ করতে হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে মহাভারতের শিক্ষা কি? কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ফলাফলের দিকে তাকিয়ে দেখুন। নীট রেজাল্ট ধ্বংস। গান্ধী তাই অহিংসার সাধক হয়ে মানুষকে শান্তির পথে ডেকেছিলেন। পারমাণবিক শক্তির অধিকারী ভারত, পাকিস্তান এবং চীন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে ভয়-ভীতি ও উত্তেজনার এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। তবে যুদ্ধ হোক বা না হোক এ রকম যুদ্ধের উত্তেজনা চলতে থাকায় সমরাস্ত্র বাণিজ্য বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। তবে ভারত এবং চীন, এশিয়ার প্রাচীন সভ্যতার দু’টি প্রধান কেন্দ্র। তাই দেশ দুটি সামরিক শক্তির মাধ্যমে সীমান্ত সমস্যার মীমাংসা করতে চাইলে তার পরিনতি হবে ভয়াবহ। কিন্তু নিছক সদিচ্ছা কি যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে? যুদ্ধ না থাকলে অস্ত্র বাণিজ্যও থাকবে না, যুদ্ধকেন্দ্রিক অবকাঠামো, পরিকাঠামোও তার অপরিহার্যতা হারাবে। তখন এর প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। যে পণ্য পরিভোগ হচ্ছে না তা উৎপাদন করা হবে কেন? এ প্রশ্ন উঠবে। আর এ জন্যই সহসা যুদ্ধের আশঙ্কা দূর হবার নয়। তবে যে-যাই বলুক, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার হবে না। কারণ, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহৃত হলে এই অঞ্চলের মানুষসহ সমস্ত প্রাণীকুল ধ্বংস হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে যুদ্ধের ফলাফল দাঁড়াবে শূন্য। তাছাড়া পারমাণবিক সমরাস্ত্র বর্তমানে বহু দেশের কাছে থাকায় এর ব্যবহারিক উপযোগীতাও বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। এখন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে মাঝে-মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর কাজে? এ প্রাকটিসও বন্ধ হতে হবে হওয়া বাঞ্ছনীয়। এজন্য প্রয়োজনে রাজনৈতিক চিন্তার পুনর্গঠন করতে হবে এবং ক্ষমতাধরদের ক্ষমতার সীমা মানতে বাধ্য করতে হবে। আর এই কাজে অগ্রনী ভূমিকা রাখতে হবে জাতিসংঘকে।

আজ যে ভয়াবহ কোভিড-১৯ ভাইরাসের মোকাবিলা করতে হচ্ছে তার উদ্ভবের রহস্য নিয়েও নানা কথা বলা হচ্ছে, দেশ বিশেষের দিকে ইংগিত পর্যন্ত করা হচ্ছে। এই সন্দেহের পেছনে কূটনীতি ও রাজনীতির মাত্রা যুক্ত হয়েছে, তাই একে চূড়ান্ত সত্য বলে গ্রহণ করা যাচ্ছে না। আমেরিকার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ভাষ্যমতে অসাবধানতা বশত: এমন বিপর্যয় যদি ঘটেই থাকে তবে আজ হোক, কাল হোক, প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হবে। রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে বলা যায় : “মরে না মরে না কভু সত্য যাহা শত শতাব্দীর / বিস্মৃতির তলে-/ নাহি মরে উপেক্ষায়, অপমানে না হয় অস্থির, / আঘাতে না টলে।” (শিবাজী উৎসব)

মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস। সূদর অতীতের ধূসর অধ্যায় সম্পর্কে আমরা কতটুকুই বা জানি। তবে এই অনন্য মানব প্রজাতির যাত্রা শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বিপদ-আপদ কখনও পিছু ছাড়েনি। জন্ম লাভের পর দীর্ঘ একটা সময় মানুষকে বেঁচে থাকতে অন্যের সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয়। কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে গিয়ে সে কেবল তার হাত ও মস্তিষ্কের সাহায্য পেয়েছে। এ কাহিনী আমরা কম বেশি জানি। প্রাথমিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কারের পর মানুষ তার সর্বোত্তম কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে ভাষার বিকাশ ঘটিয়ে এবং এই ভাষার সাহায্যেই মানুষ তার মনোভাব প্রকাশ করতে এবং অভিজ্ঞতাকে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু কোন আবিষ্কারই মানব প্রজাতিকে প্রাকৃতিক বিপদ-আপদ, দুর্যোগ-দুর্বিপাকের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। কখনও বন্যা, কখনও ভূমিকম্প, কখনও সুনামি, কখনও দুর্ভিক্ষ, কখনও মহামারি, কখনও বজ্রপাত, আবার কখনও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ব্যাপক সম্পদ ও প্রাণহানি ঘটিয়েছে এবং এখনও ঘটাচ্ছে। বহু কষ্টে সাজানো অনেক কিছু তছনছ হয়ে যাচ্ছে। তবুও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে মানুষ এসব বিপদের মোকাবিলা করে যাচ্ছে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন প্রকৃতির। ভাইরাসটির চরিত্র এখনও বহুলাংশে রহস্যাবৃত। কিন্তু তার মধ্যেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডাক্তার, নার্স এবং হাসপাতালের অন্যান্য স্টাফরা আক্রান্তদের সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে সাহায্য করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। উপকরণের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমাদের অনেক অভিজ্ঞ ডাক্তার মৃত্যুবরণ করেছেন, যারা ছিলেন ডাক্তারদের রোল মডেল। এসব অভিজ্ঞ ডাক্তারের মৃত্যুতে আমাদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা সহজে পূরণ হবার নয়। তারপরও ডাক্তার নার্সরা দায়িত্ব পালনে পিছপা হচ্ছেন না। আমরা তাদের আন্তরিক সাধুবাদ জানিয়ে বলতে চাই, মানুষের সেবায় জীবন উৎসর্গকারী প্রতিটি প্রাণ আল্লাহ্র কাছে অবশ্যই শহীদের উচ্চ মর্যাদা লাভ করবেন। তারা মানুষের হৃদয়েও শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন থাকবেন।

অতীত ইতিহাসের পথরেখা ধরে পিছনে হাঁটতে থাকলে চোখে পড়বে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় দুটি পদ্ধতি সমান্তরালভাবে চলে এসেছে। চীনের মানুষ বন্যার প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য তাদের দেশের ইয়োলো নদীর পাড় দিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছিল, আর পশ্চিম এশিয়ার মানুষ পবিত্র জীবনযাপনের উপর গুরুত্ব দিয়েছিল। করোনা ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচার জন্য টিকা, ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি আমরা পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তুলতে পারি। অস্বীকার করবো না, পবিত্র শব্দটির মধ্যে একটা ধর্মীয় ব্যঞ্জনা রয়েছে। যদিও ধার্মিকতার জন্য আরও বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হয়। কেউ ধার্মিক হতে চাইলে তাকে পরম সত্তার কাছে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করতে হয় এবং তার আনুগত্য পোষণ করতে হয়। তার সব সময় ধৈর্য ও সংযমের আকিদা থাকতে হয়। পরম সত্তার গুণাবলীসমূহ নিজে ধারণ করতে হয়। সৃষ্টি রহস্য নিয়ে ভাবতে হয় এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অভাব ও বেদনা সাধ্যমত দূর করতে হয়। আত্মসুখে মগ্ন না থেকে চারদিকের জীবন ও জগতের প্রতি তাকাতে হয়। ব্যবহারে বিনম্র এবং দানের ব্যাপারে অগ্রনী হতে হয়। লক্ষ্য রাখতে হয় প্রতিবেশী ও সহচর যেন বাক্য ও ব্যবহারে কষ্ট না পায়। বক্তব্য রাখার সময় সত্যভাষী এবং দায়িত্ব পালনে সৎ ও আন্তরিক হতে হয়। কোন ওয়াদা করলে তা রক্ষা করতে হয়। সত্যের সঙ্গে মিথ্যাকে মিশাল দেয়া থেকে বিরত থাকতে না। সহজ সরল পথের পথিক হতে হয় এবং পথভ্রষ্ট হওয়ার ভয়ে থাকতে হয় সর্বদা শঙ্কিত। এই হচ্ছে সেই মাপকাঠি যা দিয়ে মানুষের ধার্মিকতা ও শ্রেষ্ঠত্ব পরিমাপ করা হয়। বস্তুত, সহজ সরল পথের যাত্রীরাই পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র জীবনযাপনকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আর চরিত্রই নির্ধারণ করে জান্নাত কিংবা জাহান্নাম। মন না রাঙিয়ে বসন রাঙিয়ে ধার্মিক হওয়া যায় না। সত্যের পথ কঠিন, তাই আমরা সবাই কঠিনকে ভালবাসতে পারি না।

ঘরে-বাইরে এখনও জীবনহানি ঘটে চলেছে। শেষ পর্যন্ত কারা টিকে থাকবে বলা যাচ্ছে না। তবে আজ হোক কাল হোক, বিপদ কেটে যাবে, মানুষ আবার আগের মত কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মানুষ প্রজাতি কি পুরনো পথেই হাঁটতে থাকবে? প্রতিটি দেশ কি তাদের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা এবং শান্তির জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে নতুন আর্থ-সামাজিক ভিত্তি নির্মাণ করার পদক্ষেপ নিবে না? আণবিক শক্তিকে কেবল শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করার মধ্যে সীমিত রাখবে না, যেমন রাখা হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ও চিকিৎসায়, না, মানুষকে ভয়-ভীতির মধ্যে রাখার কাজে এর ব্যবহার অব্যাহত থাকবে? এসব প্রশ্নের সদুত্তোরের উপর নির্ভর করছে মানব-প্রজাতির ভবিতব্য।

লেখক : মননশীল প্রাবন্ধিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here