সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা 

বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামন্দা বিশ্বব্যাপী ১০ কোটি মানুষকে চরম দরিদ্র অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

বাংলাদেশের হিসাবটা অনেকে অনেকভাবে করছেন। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ঢাকা-চট্টগ্রামের প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষের ওপর এক জরিপ করেছে। ব্র্যাকের চেয়ারম্যান, পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এই জরিপের তথ্য উপস্থাপন করে বলেছেন, মহামারি করোনাভাইরাসের আঘাতে গত তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) দেশের অন্তত ১৭ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়ে নতুন করে বেকার হয়েছেন এবং একইভাবে ২১ শতাংশ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। এর আগে ব্র্যাক, ডেটা সেন্স এবং উন্নয়ন সমন্বয়-এর এক যৌথ সমীক্ষায় করোনায় বাংলাদেশের ১০ কোটি ২২ লাখ মানুষের আয় কমে গেছে৷ আর পরিবার হিসাবে আয় কমেছে শতকরা ৭৪ ভাগ পরিবারের৷

জীবিকা বাঁচাতে সরকার শুরু থেকেই কড়া লকডাউনে যায়নি। সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে মানুষের চলাচল অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সবকিছু সচল ছিল না। এই অসাধারণ সাধারণ ছুটিতে মানুষ দেখেছে, সে সত্যিই একেবারে একা, বাড়ি থেকে বেড়োনোর উপায় নেই, মোড়ের মাথায় ঝট করে চা খাওয়া যাচ্ছে না, কাজ নেই, আয় নেই।

এখন সবকিছু প্রায় স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। রাস্তাঘাটে আবার মানুষের ঢল। কিন্তু সবকিছু আগের জায়গায় ফিরছে বা ফিরবে সেটা নিশ্চিত নয়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপে দেখা গেছে, করোনায় ফর্মাল সেক্টরে কাজ করা ১৩ শতাংশ মানুষ চাকরি হরিয়েছেন। যাদের আয় ১১ হাজার টাকার কম তাদের ৫৬.৮৯ শতাংশ পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে গেছে, ৩২.১২ শতাংশের আয় কমে গেছে। যাদের আয় ১৫ হাজার টাকার মধ্যে তাদের ২৩.২ শতাংশের আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ৪৭.২৬ শতাংশের আয় কমে গেছে। আর যাদের আয় ৩০ হাজার টাকার বেশি তাদের ৩৯.৪ শতাংশের কমেছে এবং ৬.৪৬ শতাংশের আয় বন্ধ হয়ে গেছে।

এই জরিপে বোঝা যায়, মধ্যবিত্তের ওপর করোনার অভিঘাত স্পষ্ট। কিন্তু সেটা বলার কেউ নাই। বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের চাকরির আয় এরই মধ্যে ঝুঁকির মুখে পড়েছে। একটি অংশের চাকরি আছে, কিন্তু বেতন নেই। আবার কারও বেতন কমে গেছে। এসএমই সেক্টরে ধস নেমেছে। যারা সরকারি চাকরি করেন তাদের কোনো সংকট নেই। কিন্তু যারা বেসরকারি খাতে আছেন তারা জমানো টাকা খাওয়া শুরু করে এখন ঋণ করে অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে নিম্নবিত্তের কাতারে নেমে গেছেন।

এদিকে সরকার দাবি করেছে, করোনার প্রভাবে প্রবৃদ্ধি কমলেও মাথাপিছু আয় বেড়েছে। গড় আয় হয়েছে দুই হাজার ৬৪ ডলার। অর্থাৎ প্রতি ডলার সমান ৮৫ টাকা ধরলে বার্ষিক আয় এক লাখ ৭৫ হাজার ৪৪০ টাকা। এক্ষেত্রে গড়ে প্রত্যেকের মাসিক আয় ১৪ হাজার ৬২০ টাকা। আগের অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল এক হাজার ৯০৯ ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ১৫৫ ডলার আয় বেড়েছে।

আয় কার বেড়েছে বোঝাই যাচ্ছে। যাদের আয় সবসময় বাড়তি থাকে তাদেরই বেড়েছে। ফলে অসাম্য বেড়েছে আরও বেশি। সরকার সবকিছু স্বাভাবিক করতে চাইলেও বেসরকারি প্রচুর প্রতিষ্ঠানে কাজের গতি আসেনি। প্রতিদিন প্রায় গড়ে ৪০ জনের মতো মৃত্যু, আর করোনা সংক্রমণের হার প্রায় ২৪ শতাংশের খবর দেখে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিবেচনা করে বহু অফিসে কাজ হচ্ছে স্বল্প পরিসরে, মাত্র কয়েক শতাংশ কর্মীর উপস্থিতিতে।

বাচ্চাদের পড়াশোনা কবে থেকে বন্ধ, মাত্র শুরু হয়ছে কিছু কিছু অনলাইন। কিন্তু টিউশন ফি দিতে হচ্ছে পুরোটাই। আয় কমে যাওয়ায়, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হওয়ায় মধ্যবিত্তরা সংসার খরচ কমিয়ে ফেলছে। তাদের সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে বা যাচ্ছে।

মধ্যবিত্তের এই অবস্থাটাই অর্থনীতিতে একটা স্থবিরতা নিয়ে আসতে পারে। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে মধ্যবিত্তের মনে সৃষ্ট এই অনিশ্চয়তার শঙ্কা কীভাবে দূর করা যায় সেই ভাবনাটা প্রয়োজন। মধ্যবিত্তের হাতে খানিকটা বাড়তি টাকা থাকতে হবে, তাদের আবার সঞ্চয়ে উৎসাহী করতে হবে। সেটা কীভাবে হবে সেই ভাবনাচিন্তা কি আছে অর্থমন্ত্রীর? এই উত্তরটাই জানা জরুরি।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

সূত্র: জাগো নিউজ

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here