সালেম সুলেরী : ঘটনাটি ১৯৮৮ সালের উপান্তকাল। বসে আছি সন্দ্বীপ ম্যাগাজিনে’র কার্যালয়ে। ঢাকার মতিঝিলস্থ টয়েনবী রোডের তৃতীয় তলায়। নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে আমার কক্ষটি সুনসান। অফিস সহকারী আব্দুস সাত্তার মুন্সী’র তাড়া। স্যার, সংবাদ পত্রিকার সোহরাব সাহেবের লোক আসছেন। ইয়াংমতো, আপনার জোর সাক্ষাৎপ্রার্থী। বললাম, অসুবিধা নেই, নিয়ে এসো। হ্যাংলা-পাতলা তরুণটির মায়ামুগ্ধ চেহারা। হাতে কবি-সাংবাদিক সোহরাব হাসানের চিঠি। ‘বাংলার বাণী’ ছেড়ে সোহরাব ভাই তখন ‘সংবাদে’। বার্তা বিভাগে শিফট ইন চার্জ। পরে বার্তা সম্পাদক হয়েছিলেন। আরো পরে ‘প্রথম আলো’য় সহযোগী সম্পাদক। আমার সাথে স্মৃতিময় সম্পর্ক। ব্যাচেলর জীবনে এক বাসাতেই থাকতাম। হাতিরপুলের ভেতরে চাররুমের বাসায় চারজন। ইকবাল আজিজ, সোহরাব হাসান, আইয়ুব হোসেন আর আমি। সর্বকনিষ্ঠ হলেও সবাই সমীহ করতেন। ‘বাতিল রাজদন্ড’-খ্যাত সোহরাব হাসান সত্তর দশকের কবি। আমি ওনাকে ‘সতীর্থ-অভিভাবক’ রূপে গণ্য করতাম। বোধকরি পঁচাশিতে বিয়ে করে আলাদা বাসা নিলেন। বিয়ে না করলেও আমিও আলাদা বাসায় উঠলাম ছিয়াশিতে। নিউজপ্রিন্টে বল পয়েন্টে লেখা চিঠি। সোহরাব ভাই লিখেছেন অনুরোধপত্র। ‘পত্রবাহক সাংবাদিক হতে আগ্রহী। আমার পরিচিত ও উদ্যমী। একটা বিহিত করতে পারলে কৃতজ্ঞ থাকবো।’ শুভেচ্ছা, সোহরাব হাসান। আমি তরুণের সঙ্গে লেখালেখির আলাপ করলাম। পৈতৃকবাস কুমিল্লার নাঙ্গলকোট। তবে ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। জানালো, ‘৮৪ সাল থেকে মিরপুরে থাকছে। সেখানে ভাই-এর সঙ্গে বসবাস। এর আগে সাপ্তাহিক ‘কনক’ পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করেছে। বুঝলাম সাংবাদিকতার প্রস্তুতিও নিয়েছে। কিন্তু তখন আমাদের ‘সন্দ্বীপে’ পর্যাপ্ত সাংবাদিক। আমাদের চেষ্টা সার্কুলেশনে সেরা হওয়া। তখন ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ ছিলো শীর্ষে। স্বল্পমূল্যের যায়যায়দিন, বিচিন্তা বন্ধ। শীর্ষে পৌঁছতে রিপোর্টিং বাড়াতে হবে। আগত তরুণকে ‘ সাপোর্টিং রিপোর্টার’ করবো ভাবলাম। আর চাকরি’র ব্যবস্থা আপাতত ‘স্বদেশ খবরে’। সন্দ্বীপ ভবনের সহযোগী কাগজে। ‘সন্দ্বীপ ভবনে’র কর্ণধার ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। বিসিআই ব্যাংকে’র প্রেসিডেন্ট, পরবর্তীকালের এমপি। ‘দ্বীপবন্ধু’ উপাধিও তখন প্রচারণাধীন। সেই তরুণকে নিতে ওনার অনুমোদন লাগবে। এতোক্ষণে মনে পড়লো– নামটিই জানা হয়নি। দেখলাম–টেবিলের ওপর স্বহস্তে লিখিত জীবনপাতা। নাম– মোহাম্মদ নঈম উদ্দিন। বললাম, সাহিত্য-সাংবাদিকতায় তিন শব্দ চলেনা। সাধারণত দুই শব্দে নান্দনিক হতে হয় নাম। শামসুর রাহমান, আল মাহমুূূূদ নামের সংস্কার করেছেন। রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ– সবাই। যার চিঠি নিয়ে এলে, সোহরাব হাসানও। তরুণ নিচু কন্ঠে বললো, আমিও রাজি। বলেন কি করতে হবে? বললাম, মো. নঈম উদ্দীন থেকে ‘নঈম’ চলে। তোমার কোন ডাক নাম আছে? বললো, আছে, — নিজাম। আমি উৎফুল্ল হলাম। বললাম, দারুণ হবে– নঈম নিজাম। ন-এর অ্যালিটারেশন বা অনুপ্রাসও আছে। দেখলাম– তরুণটিও উচ্ছ্বসিত। কারণ সে নাকি ডাক নামে এলাকায় পরিচিত। স্কুল-কলেজ-পাড়া, সবাই ‘নিজাম’ নামটি জানে। অতএব তরুণটি– নতুন নামটি লুফে নিলো। অচিরেই পাঠকগোষ্ঠীও গ্রহণ করলো সেই নামের সাংবাদিকতা। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন করালাম। সিলেটে ‘শিবির’ বনাম ‘ছাত্রলীগে’র রক্তাক্ত লড়াই। এক সপ্তাহে চারটি লাশ পড়লো। সাহস দিয়ে নঈম নিজামকে পাঠালাম পূণ্যভূমিতে। বাবরুল হোসেন বাবুল তখন পৌর চেয়ারম্যান। ইসমাঈল হোসেন আমাদের পত্রিকা এজেন্ট। সন্দ্বীপে’র সিলেট প্রতিনিধি সম্ভবত ইকবাল কবির। সবার সহযেগিতায় প্রামাণ্য প্রতিবেদন হলো। প্রচ্ছদপট আঁকালাম চোখকাড়া লাল রঙে। রক্তের স্রোত বয়ে যাওয়া সুরমা-কুশিয়ারা নদী। লাশ দিয়ে বানানো ভেলা। তার ওপর নাঙ্গা তলোয়ার হাতে তিন যুবক। শিরোনাম ঃ লাশের ভেলায় জামাত-শিবির। অসাধারণ এঁকেছিলেন শিল্পী সাইফুল আলম বাবুল। তিনবার ছাপতে হয়েছিলো সংখ্যাটি। আরেকটি সাহসী কাজ করলো নঈম নিজাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের চরম কোন্দল। অভি ও ইলিয়াস গ্রুপে সশস্ত্র লড়াই। বললাম, দু’জনের দুটি সাক্ষাৎকার চাই। সে বললো, প্রশ্নপত্র লিখে দেন। চেষ্টা করে দেখতে পারি। আমিও সেমতেই কম্পোজ করে দিলাম। ৫০ঃ৫০ সম্ভাবনার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু আমাদের অবাক করে তিন দিনে ফলাফল আনলো। সোর্স ধরে সুড়ঙ্গসম গোপন পথে পৌঁছতে হয়েছিলো। প্রতিপক্ষ আর সরকারি বাহিনীর ভয় ছিলো উভয়ের। এজন্যে চরম গোপনীয়তার মধ্যে অভি-ইলিয়াস থাকতো। তখন প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই নঈমকে যেতে হয়েছে। পুরোদস্তুর বুঝিয়ে তবেই নিতে হয়েছে উভয়ের সাক্ষাৎকার। সেই প্রচ্ছদ কাহিনীটিও দেশে-বিদেশে আলোড়ন তোলে। অভি-ইলিয়াসের অবস্থান জানতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফোন দিয়েছিলেন। বলেছিলাম, আমরা মিডিয়ায় কাজ করি, পুলিশে নই। স্মৃতি থেকে ঘটনাগুলোর কিছুটা বিবৃত করলাম। ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ নিয়ে নঈম একটি সিরিজও করেছিলো। অনেক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার সংযোজিত হয়। বিবিসি-খ্যাত আতাউস সামাদে’র বক্তব্যটি মনে পড়ে। বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আর জিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষক ‘। নঈম সেই সিরিজটি দিয়ে বইও করেছিলো। সন্দ্বীপ ম্যাগাজিনে আরেকটি বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলো। ‘টাগ অব ওয়ার’ শিরোনামে ব্যক্তিদ্বন্দ্ব বিষয়ক কলাম। অনেক গোপন তথ্যের সংযোজন ঘটাতে হতো। যেমন ইকবাল সোবহান চৌধুরী বনাম রিয়াজুদ্দিন আহমদ। ডেইলি অবজারভারে পাশাপাশি বসলেও সম্পর্ক সাপে-নেউলে। প্রতিপক্ষ সাংবাদিক নেতৃত্ব, দারুণ জমেছিলো। মন্ত্রি-রাজনীতিকদের দ্বন্দ্ব নিয়েও জমে ওঠে কলামটি। ততোদিনে নিজস্ব ভাষা গড়ে উঠছিলো নঈম নিজামের। স্বল্প শব্দে বাক্য গড়তেন মতিউর রহমান চৌধুরী। নঈমও সেই বাক্যকৌশলটি আয়ত্বে আনতে সচেষ্ট হয়। সাংবাদিক মুন্নী সাহার প্রথম লেখাও সন্দ্বীপে প্রকাশিত। প্রতি সপ্তাহে বিটিভি’র ওপর চমৎকার রিভিউ লিখতো। আরেকটি ইতিহাস কপালে তিলক দেওয়া। জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রথম লেখা নিবন্ধ সন্দ্বীপে প্রকাশিত। সময়কাল ১৯৮৮-এর ফেব্রুয়ারি। বর্ষপূর্তি সংখ্যায়, শীর্ষ রাজনীতিকেরা লিখেছিলেন। ঐ বছরেই সাপ্তাহিক হিসেবে সন্দ্বীপ সর্বোচ্চ সার্কুলেশনপ্রাপ্ত হয়। সেক্ষেত্রে নঈম নিজামের নিবেদনও স্মৃতি ইতিহাস। ঢাকার মালিবাগে পাবনা কলোনির উল্টোদিকে আমার বাসা। আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলামের মালিকানাধীন। নঈম নিজাম একাধিক রাত তাতে যাপন করে। বিসিএস (পাসকোর্স) দিতেও ২-৩ রাত থাকতে হয়। একানব্বই-এর অক্টোবরে ‘মাইক্রোবাস’ কেনায় বাসা পাল্টাই। নঈমও বোধকরি ‘অফিসার হওয়া’র মতামত পাল্টায়। ১৯৯১ সালেই আমি অন্য কাগজে চলে যাই। তিনমাস কাজ করি ‘আকর্ষণ’ ম্যাগাজিনে। অতঃপর ‘দৈনিক বাংলাবাজা’রে বার্তা সম্পাদক। ১৯৯২-এ প্রকাশ করি ‘সাদাকালো’ ম্যাগাজিন। উত্তর অ্যামেরিকা’র ঠিকানা’র বিশেষ প্রতিনিধিও। নঈম নিজাম ‘আজকের কাগজ’ হয়ে ‘ভোরের কাগজে’। এরপর এটিএন টিভিতে দীর্ঘমেয়াদী বার্তা সম্পাদক। ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ২০১১-তে। পরের বছর পূর্ণাঙ্গ সম্পাদক। পাশাপাশি ‘নিউজ ২৪-টিভি’র প্রধান সম্পাদকও। সার্কুলেশনে সর্বোচ্চ আসন পায় দৈনিকটি। এগুলোর পাশে অনেক মিডিয়ায় রয়েছে স্মৃতিকর্ম। স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমীন জাতীয় প্রেসক্লাবের প্রথম নারী সম্পাদক। সাংবাদিক হিসেবে দৈনিক ইত্তেফাকে কর্মরত। একটি ছেলে একটি মেয়ে অ্যামেরিকায় অধ্যয়নরত। মরণব্যাধি করোনা’য় আক্রান্ত হয়েছিলো নঈম নিজাম। বাসাতেই চিকিৎসা নিয়ে ধীরে ধীরে সেরে উঠেছে। এটিও একটি আয়ুযাচন সুবিশাল যুদ্ধ। এই বিজয়সংবাদে ভীষণভাবে প্রাণিত হয়েছি। মহান সৃষ্টিকর্তাকে জানিয়েছি নিযুতকোটি শুকরিয়া। এবং তোমাকে শুভেচ্ছাভিনন্দন– প্রিয় নঈম নিজাম। ♦ নিউইয়র্ক, জুন ২০২০ # salemsuleri.ss@gmail.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here