অরিত্রির-কী-‘অপরাধ’-ছিলনিউজ বাংলা প্রতিবেদন: বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ পাহাড়সম ভারী। দিলীপ অধিকারীর বেদনা হয়তো আমরা কেউ ছুঁতে পারব না। গতকাল চোখের পলকে তিনি মেয়েকে হারালেন। কিন্তু অরিত্রির আত্মহত্যা কি একটি অপমৃত্যু? ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শত শত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মধ্যে নিশ্চয়ই ঘুরেফিরে এই প্রশ্নই আসছে। হৃদয়বিদারক এই ঘটনা স্কুলটির সব অভিভাবককেই ভীত ও বিহ্বল করে তুলেছে। বিদ্যালয়ের কাজ শিশুদের জীবনবাদী করে তোলা, ভুলগুলো শুধরে দেওয়া; নিশ্চয়ই মৃত্যুতে প্ররোচিত করা নয়। শাস্তি দিয়ে আশ্রয়চ্যুত করা নয়। অপমানিত করাও নয়। বিদ্যালয় নিশ্চয়ই কারাগার নয়, কোনো শৃঙ্খলা বাহিনীও নয়।

ভুল করে করেই স্কুলে সবাই শিখবে—এটাই শিক্ষাদর্শনের গোড়ার কথা। অন্তত মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত এমনটিই হওয়ার কথা। শিক্ষকদের কাজ পড়ানো। তাঁরা নিশ্চয়ই ফৌজদারি দণ্ডবিধি নিয়ে বিচারকের আসনে বসে নেই। তাঁরা শিশুদের বিকশিত করার দায়িত্ব নিয়েছেন এবং বিদ্যালয়ও ‘মানুষ গড়ার সংস্থা’ হওয়ার কথা। অরিত্রি তাহলে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে কী শিক্ষা পেল? নবম শ্রেণি পর্যন্ত আসতে আসতে অরিত্রিকে কীভাবে গড়ে তুললেন এই খ্যাতনামা বিদ্যাপীঠের মানুষ গড়ার কারিগরেরা? আমরা আসলেই জানি না, অরিত্রিদের ক্লাসে কী হতো এবং পরীক্ষার হলে কী ঘটেছে ২ ডিসেম্বর।

ভাবতে অবাক লাগছে, কীভাবে এই বিদ্যালয় ‘নামী প্রতিষ্ঠান’ হয়ে উঠল, যেখানে একজন ছাত্রীর কাছে একটা মোবাইল ফোন পেলে তাকে স্কুল ছাড়ার শাস্তি পেতে হয়? এবং যেখানে অভিভাবকসহ শিক্ষার্থীকে ক্ষমা চেয়েও রেহাই মেলে না। প্রচারমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী, অরিত্রি তার শাস্তিস্বরূপ ‘ট্রান্সফার’ আদেশ বদলাতে বাবার সামনে প্রিন্সিপালের কাছে অনুনয়-বিনয় করে ক্ষমা চেয়েছিল। সেখানে ব্যর্থ হয়ে বাসায় গিয়ে আত্মহত্যা করে। পূর্বাপর ঘটনাবলি কতটা সত্য, সেটা তদন্তসাপেক্ষ। সব অভিভাবকই এর সত্যাসত্য জানতে আগ্রহী। তবে যদি সত্য হয়, তাহলে বিদ্যালয়ের সঙ্গে শ্রমশিবিরের পার্থক্য রইল কোথায়? শিশুরা ক্ষমা চেয়েও ক্ষমা পাবে না?বিদ্যালয়গুলোর জন্য এমন নির্মম আচরণবিধি কবে, কাদের অভিভাবকত্বে তৈরি হলো? এমন আচরণবিধি কতটা শিশুমনস্তত্ত্বসম্মত? এ কি আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়া সর্বগ্রাসী সামগ্রিক একনায়কতান্ত্রিক সংস্কৃতির কোনো খুদে প্রকাশ?

বলা হচ্ছে, নবম শ্রেণির এই শিক্ষার্থীর কাছে পরীক্ষার হলে মোবাইল পাওয়া গিয়েছিল। নবম শ্রেণির পরীক্ষা মানেই অভ্যন্তরীণ মেধা যাচাইয়ের উদ্যোগ। এটা জাতীয় পর্যায়ের কোনো ‘পাবলিক পরীক্ষা’ নয়। অভ্যন্তরীণ পরীক্ষাগুলো নেওয়াই হয় অধিকতর মানোন্নয়নের লক্ষ্যে। শিক্ষার্থীদের ভুল-শুদ্ধ যাচাই-বাছাইয়ের জন্য। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয়, খুদে এই শিক্ষার্থী ‘অসদুপায়’ অবলম্বন করেছিল, কিন্তু সেটা কি সংশোধনের অযোগ্য ছিল? আমাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় এটা কি এমন বিরল ঘটনা, যার জন্য শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয় ত্যাগের দণ্ড দেওয়া হয়?

বিজ্ঞান শাখায় যার রোল নম্বর ১২, সে নিশ্চয়ই শিক্ষার্থী হিসেবে মানোন্নয়নের অযোগ্য একজন ছিল না। উপরন্তু, অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় যদি সে অসদুপায় করেও, সেটা এমন অপরাধ নয় যে প্রাণ দিয়ে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

প্রশ্ন উঠেছে, এই মৃত্যুর কি কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত হবে? পুরো ঘটনা খতিয়ে দেখবে কি সরকারি কোনো সংস্থা, যাতে অভিভাবকদেরও প্রতিনিধি থাকবে?

যত দূর জানা যায়, আলোচ্য বিদ্যালয়ের পরিচালনায় অভিভাবকদের প্রতিনিধিরাও রয়েছেন। সবারই প্রত্যাশা, তাঁরা বিদ্যালয়টির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক ও ওয়াকিবহাল। তাঁরা সর্বশেষ ঘটনার জন্য কতটা দায়িত্ব নেবেন, সেটা জানতেও কৌতূহল হচ্ছে। বিদ্যালয়ের হাজার হাজার অভিভাবক তাঁদের কাছ থেকে নিশ্চয়ই আশ্বস্ত হতে চাইবেন এখন।

শিক্ষার্থীরা কতটা ভীতিমুক্ত পরিবেশে আছে?
সাধারণ অভিভাবকদের কাছে প্রায়ই আমরা শুনি, রাজধানীসহ দেশব্যাপী তথাকথিত খ্যাতনামা স্কুলগুলো ‘ভালো রেজাল্ট’ করে বলে সেগুলোর প্রশাসন ও শিক্ষকমণ্ডলী এখন আর জবাবদিহির মনোভাবে নেই। আসলেই খ্যাতনামা স্কুলগুলোয় কী চলছে, সেটা হয়তো খতিয়ে দেখার সময় এল এবার। কী শিখছে—এই প্রশ্ন যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি হলো কীভাবে শিখছে। অরিত্রির মৃত্যু হয়তো একটা ঘুমভাঙানি ডাক। সবাই কি আমরা সোচ্চার কণ্ঠে জানতে চাইতে পারি না যে আমাদের শিক্ষকেরা কীভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলছেন? আমাদের সন্তানেরা কতটা ভীতিমুক্ত পরিবেশে লেখাপড়া করতে পারছে, সেটা জানার অধিকার রয়েছে আমাদের। আমরা কি আবার একটু খতিয়ে দেখব, একটি বিদ্যালয়ের ও সেখানকার স্টাফদের আসলে মূল কাজ কী?

তবে এসবের মাধ্যমে নিশ্চয়ই আমরা আর অরিত্রিকে পাব না। অরিত্রির ছোট বোনটিকে এরপর থেকে একা একাই একই স্কুলে যেতে হবে। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার পথেই বড় বোনের কথা মনে হবে তার। পুরো পরিবারের হাহাকার থেকেই যাবে। কিন্তু এটা কি জানা যায় না যে আসলেই মোবাইল ফোন রাখার ‘অপরাধ’-এর ঘটনায় ভিকারুননিসা নূন স্কুলের প্রশাসন অরিত্রির অভিভাবককে ভর্ৎসনা করেছিল? স্কুল কর্তৃপক্ষের কি আর ভিন্ন কিছু করার ছিল? অরিত্রিকে মৃত্যুর দিকে প্ররোচিত না করে কি এই ঘটনার মীমাংসা করা যেত না? অরিত্রি ও তার বাবার ক্ষমা প্রার্থনা কি এমন ‘অপরাধ’-এর জন্য যথেষ্ট ছিল না? স্কুলপর্যায়ে সাধারণ কোনো ‘অপরাধ’-এর জন্য একজন শিক্ষার্থী ও তার পরিবারের ক্ষমা প্রার্থনার চেয়ে অধিক আর কী করার আছে দেশের প্রচলিত আইন ও প্রথায়?

অরিত্রির মৃত্যুর অজানা কারণ যা-ই হোক, এই ঘটনা নিঃসন্দেহে আমাদের বিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ আরও গণতান্ত্রিক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা কথা বলছে। যেখানে শিক্ষার্থীরা আসামিতুল্য হবে না এবং অভিভাবকদেরও ‘ক্ষমা’ চাইতে নয়, সন্তানের উন্নয়নে পরামর্শ করতে ডেকে পাঠানো হবে। সূত্র:প্রথম আলো

আলতাফ পারভেজ: গবেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here