নিউজবাংলা ডেস্কঃ বাংলাদেশে সাকার ফিশের পরিচিতি মূলত শহুরে লোকের কাছে। বাড়িতে বা অফিসে রাখা অ্যাকুরিয়ামে রঙ-বেরঙের মাছের মধ্যে কালো শরীরে হলুদ ছোপের এই মাছ দেখা যায় প্রায়ই। অনেকে একে চেনেন অ্যাকুরিয়ামে মাছের ময়লা খেকো মাছ হিসেবে, কারণ শোভা বর্ধনের পাশাপাশি মাছের বর্জ্য এবং অ্যাকুরিয়ামেরর অন্যান্য ময়লা খেয়ে ফেলে এই মাছ।কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উন্মুক্ত জলাশয়ে পাওয়া যাচ্ছে এই মাছ।
কিছুদিন আগে ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরের পেছনের পুকুরে বড় আকারের একটি সাকার ফিশ পাওয়া গেছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছিল।
কী করে শখের মাছ পালনকারীদের অ্যাকুরিয়ামের থেকে মুক্ত জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়লো এই মাছ তা স্পষ্ট নয় এখন পর্যন্ত, কিন্তু এরই মধ্যে এই মাছ জলাশয়ের মাছ চাষীদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাম আর পরিচয়
এই মাছের নাম সাকার মাউথ ক্যাটফিশ, অথবা কমন প্লেকো। ক্যাটফিশ মানে শিং-মাগুর জাতের এই মাছের বৈজ্ঞানিক নাম হিপোসটোমাস প্লেকোসটোমাস।
মুখের আকারে জলহস্তীর সাথে মিল থাকায় এই নামকরণ।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেছেন, এই মাছের অনেকগুলো প্রজাতি আছে, এর মধ্যে যেটি বাংলাদেশে পাওয়া যায়, সেটি আকারে বেশি বড় নয়।
১৬-১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয় এই মাছ।
ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেছেন, এ মাছটি শিকারি জাতের নয়, বরং এটি তার মুখ দিয়ে শুষে বা চুষে খাবার খায়। মিঠাপানির এ মাছটির শরীর অমসৃণ।
পিঠের উপরে ও দুই পাশে রয়েছে তিনটি বড় কাটার মত পাখনা, যা ধারালো।
মুখের মধ্যে রয়েছে ধারালো দাঁত।
এরা জলাশয়ের আগাছা, জলজ পোকামাকড় ও বিভিন্ন ধরণের ছোট মাছ খেয়ে থাকে।
পৃথিবীর কোনো দেশেই এই মাছ খাওয়ার জন্য প্রসিদ্ধ নয়, বরং এটি অ্যাকুরিয়ামের মাছ হিসেবেই পরিচিত।
কীভাবে এলো বাংলাদেশে?
মৎস্যবিজ্ঞানীরা বলছেন, মূলত নব্বইয়ের দশকে অ্যাকুরিয়ামের মাছ হিসেবে সাকার ফিশ আমদানি করা হয় বাংলাদেশে।
দেশে যে ধরণের সাকার ফিশ দেখা যায়, সেটা মূলত ব্রাজিল থেকে আনা হয়েছিল।
এরপর স্থানীয় অ্যাকুরিয়াম ব্যবসায়ীদের হাত ধরে দেশে এই মাছের চাষ প্রাথমিকভাবে শুরু হয়।
জলাশয়ে কীভাবে গেল?
অ্যাকুরিয়ামের শোভা-বর্ধনকারী এই মাছ কীভাবে দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়লো সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা নেই দেশে।
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওয়াহিদা হক বলেছেন, কীভাবে এ মাছ ছড়িয়ে পড়েছে, তার তথ্য তেমন জানা যায় না।
কিন্তু ধারণা করা হয়, স্থানীয়ভাবে কেউ কেউ চাষ করছিলেন, কেউ হয়ত অ্যাকুরিয়ামের জন্য সরবারহ করার জন্য, কেউবা শৌখিনভাবে করেছেন।
তিনি বলেছেন, হয়ত এসব জায়গা থেকেই কেউ অসাবধানে ছেড়ে দিয়েছে, যা পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়েছে মুক্ত জলাশয়ে।
এছাড়া এই মাছের মধ্যে লাফানোর প্রবণতা থাকায় তারা এক জলাশয় থেকে আরেক জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এক্ষেত্রে বর্ষার সময় যখন নদী ও অন্যান্য জলাশয়ে পানি বাড়ে সেখান থেকেও ছড়িয়ে পড়তে পারে এই মাছ।
মাছটি পানি ছাড়াই ২৪ ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে।
মৎস্য বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা বলছেন, শুরুতে মূলত উপকূলীয় কয়েকটি জেলার জলাশয়ে, অর্থাৎ পুকুর, খাল এবং নদীতেও এই মাছ দেখা গেছে।
কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে হবিগঞ্জ কিংবা রংপুরের মত জেলা যা উপকূল থেকে দূরে সেখানকার জলাশয়েও দেখা গেছে এই মাছ।
স্থানীয় হাটবাজারেও অন্যান্য মাছের সাথে বিভিন্ন সময়ে এই সাকার ফিস দেখা যায়।
মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট বলছে, অনেক সময়ই মাছ চাষিরা অভিযোগ করেন যে তাদের ঘেরে চাষের মাছ খেয়ে ফেলছে এই মাছ।
যে কারণে তাদের উদ্বেগের কথা স্থানীয় পর্যায়ে তারা জানিয়েছেন অনেক সময়।
জলাশয়ের মাছের কী ক্ষতি করে?
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের শিক্ষক হালিমা জাহান বলেছেন, দেশীয় প্রজাতির মাছের ওপর সাকার ফিশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তিনি বলছেন, ‘এটি জলাশয়ের জলজ পোকামাকড়, শ্যাওলা এসবের সাথে সাথে অন্য ছোট ছোট মাছ বা মাছের পোনা খেয়ে ফেলে। ফলে চাষীদের সমস্যা হয়।’
আবার সাকার ফিশের পাখনা খুব ধারালো, দেখা যায় অন্য মাছের সাথে লড়াই করার সময় সেগুলোর শরীরে সহজেই ক্ষত তৈরি হয়।
এই ক্ষত দ্রুত পচন ধরিয়ে দেয়, এবং ফল হয় অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু। ফলে মাছের সংখ্যা অনেক কমে যায়।
মৎস্য আইন ২০১১ অনুযায়ী, বাংলাদেশে দেশীয় প্রজাতির মাছের ক্ষতি সাধন হয় এমন যে কোন বিদেশি মাছ চাষ দণ্ডনীয় অপরাধ।
তবে, মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেছেন, সাকার ফিশ শিকার করে না, বরং সে চুষে বা শুষে একসঙ্গে প্রচুর খাবার খায় এবং দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে।
তিনি বলেন, ‘যে কারণে যে কোন মুক্ত জলাশয়ে থাকা অন্য মাছের সঙ্গে আবাস এবং খাদ্যের যোগান নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা হয়। তাতে অনেক সময়ই দেশীয় জাতের মাছ টিকে থাকতে পারে না।’
সেটি একটি ক্ষতি, আর সে কারণে এই মাছের চাষে উৎসাহ দেয়া হয় না। কিন্তু ইয়াহিয়া মাহমুদ মনে করেন, চাষের মাছের ক্ষেত্রে এ মাছ উপকারী হতে পারে। কারণ ড্রাম বা হাপায় করে যখন মাছ চাষ করা হয়, তার গায়ে অনেক সময় যে শ্যাওলা জমে সেটি সাকার ফিশ খেয়ে পরিষ্কার করে ফেলতে পারে, তাতে মাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে না।
কীভাবে নিরাপদ থাকা যাবে?
সাকার ফিশের কারণে ইতোমধ্যে মিয়ানমার ও আরব আমিরাতের মৎস্য চাষিরা ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছে বলে জানা যায়।
কিন্তু মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেছেন, মিয়ানমারে যে জাতের সাকার ফিশ দেখা যায় সেটি আকারে অনেক বড়।কিন্তু বাংলাদেশে যে জাতের সাকার ফিশ দেখা যায় সেটি খুব আকারের নয়।
কিন্তু কোনো জলাশয়ে যদি সাকার ফিশ দেখা যায়, তাহলে সেটি জাল দিয়ে ধরে তুলে ফেলার পরামর্শ দেন তিনি।
তবে এটি ক্যাটফিশ জাতের হওয়ায় জলাশয়ের একেবারে নিচের স্তরে থাকে, ফলে সরিয়ে ফেলার কাজটি খুবই কঠিন।
গবেষকেরা বলছেন, যেহেতু দেশীয় মৎস্য খাতে গত কয়েক দশকে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছে, সে কারণে এ খাতে সুরক্ষা দেয়ার জন্য দেশীয় মাছের জন্য যা সহায়ক নয়, সে বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
সূত্র : বিবিসি