সাঈদ এনাম:
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বিগত এক দশকে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ও তার চ্যালাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। মন্মথ, নোমান, রতন,ইকবাল – এদের মতো ছাত্র ইউনিয়ন ও মৈত্রী করা লোকজন সুকৌশলে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছে। বার বার পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যবই বদলিয়ে এবং মূল্যায়ন পদ্ধতি উন্নয়নের নামে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। বছরে তিনটি টার্ম পরীক্ষা, সৃজনশীল প্রশ্ন, ধারাবাহিক মূল্যায়ন, স্কুল ভিত্তিক মূল্যায়ন, পি ই সি, জে এস সি পরীক্ষা চালু এবং সব শেষে শিক্ষকদের আচরণ বিধিমালার নামে ২০১২ সালে একটি পরিপত্র জারি করে এরা বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেকটি মেরে দিয়ে গেছে। এদের কৌশলী অপকর্মের ফল জাতি নগদে পাওয়া শুরু করেছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা (তথা কথিত কোমলমতি)এখন তাদের সৃজনশীল কর্মকান্ড দেখানো শুরু করেছে! শিক্ষকের গলায় জুতার মালা, স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে শিক্ষক হত্যা ! ড. জাফর ইক বাল কোথায় ? তার পরামর্শে নবম- দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বই গুলো যুগোপযোগী করা হলো। এমন যুগোপযোগী করা হলো যে, শিক্ষার্থীরা পুরোটা বুঝে উঠতেই পারে না! ফলে কোচিং হয়ে উঠলো অনিবার্য। মাত্র এক যুগেই সেই যুগোপযোগী বই গুলো অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এখন নবম- দশম শ্রেণিতে আর বিজ্ঞান বিভাগই থাকছে না। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন – কী এমন হয়ে ছিলো যে, আগের বই গুলো বদলিয়ে বিশাল সাইজের তথাকথিত নতুন উন্নত বই করতে হয়ে ছিলো? কয়েক বছর যেতেই এখন কী এমন হলো যে, বিভাগ বিভাজনই আর লাগবে না? এ প্লাসের ছড়া-ছড়ি! জানি তো! ডজন ডজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকার পরেও উচ্চশিক্ষার সনদ বিক্রির দোকান খোলা (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়), কাস্টমার নাই। সুতরাং যাকে তাকে এ প্লাস দিয়ে কাস্টমার তৈরী করা হয়েছে। হাজার হাজার প্রাইভেট স্কুল ও তাদের কোচিং সেন্টার গুলো চালু রাখার জন্য বেশি- বেশি পাবলিক পরীক্ষা দরকার। পাবলিক পরীক্ষায় এ প্লাস রেজাল্টের লোভ না দেখালে তো অভিভাবকদের পকেট কাটা যাবে না। সুতরাং পি ই সি ও জে এস সি পরীক্ষা শুরু হলো। পাবলিক পরীক্ষায় এ প্লাসের নামে কোচিং না হয় শুরু হলো কিন্তু মাসিক ফি ও অন্যান্য বকেয়া আদায় করতে হলে বছরে ঘন-ঘন পরীক্ষা দরকার। তাও হয়ে গিয়ে ছিলো। হঠাৎ করে টার্ম পরীক্ষা দুটি থেকে তিনটি করে ফেলা হয়ে ছিলো। শুধুমাত্র পি ই সি, জে এস সি পরীক্ষা চালুর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে দেশে শতকরা ৫০ ভাগ কোচিং সেন্টার বৃদ্ধি পেয়েছে। গুণগত শিক্ষা? এই জিনিস পিছিয়ে গিয়েছে বহু দূরে ! বাংলাদেশের চিরায়ত পঠন- পাঠন পদ্ধতিতে একটা আদর্শিক বিষয় ছিলো। যার মধ্যে কোনো সন্দেহের জায়গা ছিলো না। পুরোটাই নিখাঁদ ছিলো। নানা রকম ভ্যাজাল ঢুকিয়ে সেই পদ্ধতিকে কলঙ্কিত করা হয়েছে। শিক্ষক আচরণ বিধিমালার নামে পরিপত্র জারি করে শিক্ষকদের অপমানিত করা হয়েছে। তাঁদের বানানো হয়েছে – ‘ঠু্ঁটো জগন্নাথ ‘। ঘটনা আরো আছে। এনজিও। ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির পরিবর্তে তারা এখন বিনাপূঁজির নতুন- নতুন প্রডাক্ট বাজারে এনেছে। এই যেমন – এওয়ারনেস, কোয়ালিটি এডুকেশন, হিউম্যান রাইটস, জেন্ডার এডুকেশন, গ্লোবাল সিটিজেনশিপ, সহপাঠ্যক্রমিক শিক্ষা, আরো কতো কি ! বাংলাদেশের শিক্ষার কোয়ালিটি আছে – এ কথা বললে দাতারা তো ফান্ড দেবে না। সুতরাং যতো পারো এদেশের শিক্ষার দুর্নাম করো এবং দোষ-গুণ এক করে শিক্ষার পশ্চাৎদেশে বাঁশ ঢুকাও। এবং সেই বাঁশ টেনে বের করার নামে ( কোয়ালিটি এডুকেশনের নামে) নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করো এবং দাতাদের কাছে ধারনা দাও। এদের সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করেছে, আমাদের মহাবিশেষজ্ঞ আমলারা। তারা একেক জন কয়েকটা করে প্রকল্পের পিডি হয়ে দু’হাতে কড়ি কামিয়েছেন। প্রশিক্ষণের নামে বিদেশে ফেমিলি টুর দিয়েছেন। এ সবের বেনিফিট কারা ঘরে তুলেছে ? উত্তর খুব সহজ। বেসরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজের মালিকেরা। আর গচ্চা গেছে সর কার ও জনগণের। দেশের কাঁধে বেড়েছে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির ঋণের বোঝা। আর জাতি পেয়েছে অন্তঃসারশূন্য শিক্ষিত কিন্তু নির্বোধ এক প্রজন্ম। সুতরাং নতুন শিক্ষানীতি ও কারিকুলাম করার আগে একটি কথা – যার বোঝা তাকে বইতে দিন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিষয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে ঐ পর্যায়ের শিক্ষকদের সুপারিশের মাধ্যমে নেওয়া হোক। এবং তাদের দিয়েই প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও উন্নয়নের রুপরেখা ও উপকরণ প্রস্তুত করা হোক। কোনো মতেই কোনো ভাড়াটিয়া বিশেষজ্ঞ দিয়ে নয়। ভাড়াটিয়া বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে অতীতে গৃহীত সমস্ত কার্যক্রম প্রায় ব্যর্থ হয়েছে। আর একটি কথা, শিক্ষক -ছাত্র কেউ কারো শত্রু না। এদের মধ্যে লেন-দেনের সম্পর্ক না। সম্পর্ক হচ্ছে – শ্রদ্ধা ও স্নেহের, গুরু ও শিষ্যের। শিক্ষকের আচরণ কেমন হবে তা – স্কুল পর্যায়ের প্রত্যেকে শিক্ষককে পিটিআই কিংবা বিএড -এ এক বছর ধরে হাতে কলমে শেখানো হয়। সুতরাং ২০১২ সালের পরিপত্রটি বাতিল করা হোক। শুভকামনা বাংলাদেশ।