সিফাত আরা হুসেন:
আহমদ ছফার লেখা “ওংকার ” এর পর “যদ্যপি আমার গুরু ” মূলত একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, জাতীয় অধ্যাপক এবং আহমদ ছফার খুবই ঘনিষ্ঠজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে লেখা। আব্দুর রাজ্জাক একজন জাতীয় অধ্যাপক, হয়তো অনেকের এ নামের সাথে পরিচয় থাকতে পারে বা তার চেয়ে বেশি কিছু জানতেও পারে। আবার এমনও হতে পারে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের নামও হয়তো কখনো শোনা হয়নি। “যদ্যপি আমার গুরু” বইটি পড়লে শুধু অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককেই চেনা যাবে এমনটি নয়,তাঁর ব্যক্তিত্ব,আচার-আচরণ, কথা-বার্তা, চলাফেরা সবকিছুর ব্যাপারে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন এবং পরবর্তীতে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে মনোনীত হন। আহমদ ছফা প্রথম তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন ১৯৭০ সালের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোয়ার্টারে তার পিএইচডি থিসিসের সুপারভাইজার হওয়ার অনুরোধ নিয়ে যদিও আহমদ ছফা শেষ পর্যন্ত তাঁর পিএইচডি সম্পন্ন করতে পারেননি। অবশ্য প্রথম সাক্ষাতের ব্যাপারটা যখন পড়লাম তখন সেই সাক্ষাতের দৃশ্য কল্পনা করে মনে মনে অনেক হাসলাম। প্রফেসর রাজ্জাক যে ঘরে বাস করতেন তার পরিসর বেশি বড় ছিল না। বইপত্রে ঠাসা ছিল। আর ছিল একটা চৌকি এবং এক পায়া ব্যতীত ভাংগা টেবিল। সেই পায়ার স্থলে বইয়ের ওপর বই রেখে পায়ার কাজ হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। আহমদ ছফা যখন ঘরে প্রবেশ করেন তখন প্রফেসর রাজ্জাক কাঁথা মুড়ে শুয়েছিলেন। আহমদ ছফার কথা শুনলেন কিন্তু কোন প্রতিউত্তর না দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। ছফা দুবার অনুরোধের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কিছুটা অপমানিত বোধ করেন। তারপরের ঘটনা আহমদ ছফা বর্ণনা করেছেন এভাবে,” এইভাবে অপমানিত হয়ে যদি আমি চলে আসি আমার নিজের কাছে ছোট হয়ে যাই।কিছু একটা করা প্রয়োজন, কিন্তু কী করা যায়!প্রফেসরের বইয়ের গুদামে যদি আগুন লাগিয়ে দেয়া যেতো, মনের ঝাল কিছুটা মিটতো।কিন্তু সেটিতো আর সম্ভব নয়। আমি দু’হাত দিয়ে তাঁর শরীর থেকে কাঁথাটি টেনে নিয়ে দলা পাকাতে পাকাতে বললাম, আমার মতো একজন আগ্রহী যুবককে নিয়ে কী করবেন? বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো তিনি চৌকির ওপর উঠে বসলেন। পরনের সাদা আধময়লা লুংগিটা টেনে গিটঠু দিলেন। তারপর চশমাটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে কাচ মুছে নাকের আগায় চড়ালেন। খুব সম্ভব বাইফোকাল গ্লাস। আমি তাঁর দৃষ্টিশক্তির তীব্রতা অনুভব করলাম।” সেই থেকে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের সাথে তাঁর যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। নানা প্রয়োজনে আব্দুর রাজ্জাকের বাড়িতে গিয়েছেন,খাওয়া দাওয়া করেছেন। সময়ে অসময়ে অর্থ সাহায্য চেয়েছেন এবং নির্দ্বিধায় তা তিনি তাঁর কাছ থেকে পেয়েছেন। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক নিজেই ছিলেন একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের পরিধি ছিল বিস্তৃত। তিনি রুশ বিপ্লবের অন্যতম নায়ক ট্রটস্কির “থিয়োরি অব পার্মানেন্ট রেভ্যুলেশন” এর বাংলা অনুবাদ এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “বাংলার ব্রত” ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। কিন্তু আহমদ ছফার মতো আমিও অবাক হই কেন তিনি সারা জীবনে একটি বই লেখেননি। দিল্লি থেকে প্রকাশিত ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অভ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদক তাঁকে গ্রিক দার্শনিক ডায়োজিনিসের সংগে তুলনা করেছিলেন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট ডিগ্রি দিয়ে সম্মানিত করে। অগাধ জ্ঞান, পান্ডিত্য আর প্রজ্ঞা নিয়ে তিনি কী সাদামাটা জীবনযাপনই না করতেন! অকৃতদার ছিলেন। ছোট ভাই,ভ্রাতৃবধূ এবং তাদের সন্তানদের নিয়ে একত্রে বসবাস করতেন। পাজামা-পাঞ্জাবী পরে বাজারে যেতেন। একেবারে সহজ সরল জীবনযাপন করতেন। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে সাধারণভাবে যেরকম কল্পনা করা হয় বাহ্যিক আবরণে তিনি তেমনটা ছিলেন না। মুখে ছিল সবসময়ই “ঢাকাইয়া ” বুলি। বাড়িতে তিনি কখনো কখনো আধময়লা লুংগি,পাঞ্জাবি পরিহিত থাকতেন। আবার কখনো কখনো এরকম বেশভূষায় বাহিরেও চলে যেতেন যার কারণে লেখক ছফার কর্মচারীরা তাকে অজ্ঞাতসারে নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে গণ্য করেছে বেশ কিছু ক্ষেত্রে অনেকটা শেখ সাদির গল্পের মতো। প্রফেসর রাজ্জাকের বাড়িতে বেশিরভাগ সময়ই নানা প্রয়োজনে নানা মানুষ যাওয়া আসা করত। তাঁকে দিয়ে নানা সুপারিশ করার বায়না বা কর্ম হাসিল করার চেষ্টা করত। আবার এমন অনেকেই ছিল স্বার্থ হাসিলের পর পিছে পিছে তাঁর বদনাম করত। আহমদ ছফাও নানা সময়ে তাঁর কাছে নানা সুযোগ সুবিধাদি প্রাপ্ত হয়েছেন এবং নানা জনের জন্য সুপারিশও চেয়েছেন। আজকে যে চিত্রশিল্পী এস.এম.সুলতানকে আমরা জানি বা চিনি তা মূলত আহমদ ছফার আবিষ্কার এবং বাকিটা প্রফেসর রাজ্জাকের অবদান। আহমদ ছফাকে জার্মান কবি গ্যোটে’র অমর কাব্য “ফাউস্ট ” অনুবাদ করতে অনুপ্রাণিত করেন। প্রফেসর রাজ্জাক ছিলেন পুরোদস্তুর একজন “ঢাকাইয়া”, এবং এর কৃষ্টি ধারক ও রক্ষক। এ বইটিতে আহমদ ছফা নানা সময়ে প্রফেসর রাজ্জাকের সাথে তাঁর সান্নিধ্য মূহুর্তের স্মৃতিচারণ করেছেন এবং নানা বিষয়ে প্রফেসরের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব সরাসরি ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া, এ বইটিতে রয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি ও নানা বিষয় সম্বলিত গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের নাম যা প্রাসংগিকভাবে উল্লিখিত হয়েছে। আহমদ ছফা ” যদ্যপি আমার গুরু” বইটি রচনা করেছেন প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাককে কেন্দ্র করে এবং ধরে নেওয়া যেতেই পারে এ বই রচনার মাধ্যমে তিনি শিক্ষাগুরুর মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
লেখক : শিক্ষক ও কথাশিল্পী