শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। শিক্ষার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষকের। একজন ছাত্রকে কেবল শিক্ষিতই নয়, বরং ভালো মানুষ করে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্বটাও থাকে শিক্ষকের ওপরই। তাই একজন শিক্ষককে হতে হয় অনেক বেশি সচেতন, অনেক বেশি ধৈর্যশীল। একজন আদর্শ শিক্ষক হতে হলে আপনাকে বিশেষ কিছু গুণের অধিকারী হতে হবে। শিক্ষাদানের প্রধান উদ্দেশ্যই হলো শিক্ষার্থীর পরিপূর্ণ জীবন বিকাশে সহায়তা প্রদান করা। এ লক্ষ্য অর্জনের পূর্বশর্ত হলো উপযুক্ত শিক্ষক। শিক্ষক-শিক্ষিকার পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, জ্ঞানের সমন্বয় সাধন, উন্নতি ও সঠিক পন্থায় বিতরণের জন্য প্রশিক্ষণ অপরিহার্য।

আদি শিক্ষক হলেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। তাই ফেরেশতারা বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি পবিত্র! আপনি যা শিখিয়েছেন তা ছাড়া আমাদের কোনোই জ্ঞান নেই; নিশ্চয় আপনি মহাজ্ঞানী ও কৌশলী।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ৩২)। আমাদের প্রিয় নবী (সা.)–এর প্রতি ওহির প্রথম নির্দেশ ছিল, ‘পড়ো তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানব “আলাক” থেকে। পড়ো, তোমার রব মহা সম্মানিত, যিনি শিক্ষাদান করেছেন লেখনীর মাধ্যমে। শিখিয়েছেন মানুষকে, যা তারা জানত না।’ (সুরা-৯৬ আলাক, আয়াত: ১-৫)। ‘দয়াময় রহমান (আল্লাহ)! কোরআন শেখাবেন বলে মানব সৃষ্টি করলেন; তাকে বর্ণনা শেখালেন।’ (সুরা-৫৫ রহমান, আয়াত ১-৪)।

আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধনই শিক্ষার উদ্দেশ্য। নৈতিক শিক্ষার সঙ্গে যেসব বিষয় সরাসরি সম্পর্কিত: সুশাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, দুর্নীতি দমন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি, সন্ত্রাস দমন, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা। আচরণে (কর্মে) অভীষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধনের জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তথ্য প্রদান বা জ্ঞান দান করাকে শিক্ষা বলে। খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর এক প্রশ্নের জবাবে হজরত উবায় ইবনে কাআব (রা.) বলেন, ‘ইলম হলো তিনটি বিষয়—আয়াতে মুহকামাহ (কোরআন), প্রতিষ্ঠিত সুন্নত (হাদিস) ও ন্যায় বিধান (ফিকাহ)।’ (তিরমিজি)।

হজরত ইব্রাহিম (আ.) দোয়া করলেন, ‘হে আমাদের প্রভু! আপনি তাদের মধ্যে পাঠান এমন রাসুল, যিনি তাদের সমীপে আপনার আয়াত উপস্থাপন করবেন, কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী স্নেহশীল ও কৌশলী।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১২৯)।

ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের যাবতীয় ক্ষেত্র এবং শিক্ষা–সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা দেয় ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআন। এই মহান গ্রন্থের নির্দেশনাকে বাস্তব ক্ষেত্রে রূপ দিয়েছেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি জগৎ ও জীবনের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক সব সমস্যার সমাধান নিজ জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেখিয়ে গিয়েছেন। এমন কোনো সমস্যা নেই, যা তিনি (হজরত মুহাম্মদ সা.) স্পর্শ করেননি এবং তিনি যা স্পর্শ করেছেন তা পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করেছেন। ইসলামে বিশেষ করে আল–কোরআন ও হাদিসে জ্ঞানার্জনের প্রতি কী নির্দেশ আছে, তা জানা আবশ্যক। পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধানের উৎস পবিত্র কোরআন হলো মুসলিম বিশ্বের মূল শিক্ষাগ্রন্থ। এ গ্রন্থের বিধান থেকে শিক্ষাও বাদ যায়নি; বরং এ গ্রন্থের প্রথম আয়াত অবতীর্ণ হয় শিক্ষার দুটি দক্ষতা উল্লেখ করে; তা হলো পড়া ও লেখা।

কোরআনে রয়েছে, ‘হে প্রভু! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও।’ (সুরা-২০ তহা, আয়াত: ১১৪)। শিক্ষা গ্রহণ ছাড়া জ্ঞান বৃদ্ধি পেতে পারে না। মানবাত্মার সঠিক বিকাশের প্রধান উপায় হলো শিক্ষালাভে জ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজের সত্তা উপলব্ধি করে জীবন সমস্যা সমাধানে দক্ষতা অর্জন করা। আল্লাহ তাআলা নবী ও রাসুলদের শিক্ষক হিসেবে পাঠিয়েছেন। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পূর্বে প্রেরিত নবীরা সবাই ছিলেন মহান শিক্ষক। শেষ নবী (সা.)–কে জগতের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকাস্বরূপ প্রেরণ করা হয়। আল্লাহ তাআলা স্বয়ং তাঁকে শিক্ষার বিষয়বস্তু ও পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন। শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘আমাকে শিক্ষক হিসেবেই পাঠানো হয়েছে।’ এ ক্ষেত্রে হজরত আদম (আ.)-এর শিক্ষাপদ্ধতিও উল্লেখ করা যায়। হজরত আদম (আ.) সরাসরি আল্লাহর তত্ত্বাবধানে প্রত্যক্ষভাবে প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন এবং ফেরেশতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে প্রথম হয়ে মানবের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন।

হজরত আদম (আ.) ছিলেন বিশ্বের প্রথম শিক্ষক। ধরায় অবতীর্ণ হয়ে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞান দ্বারা তাঁর পরিবার-পরিজনকে শিক্ষা দান করেন। তাঁর স্রষ্টা ও শিক্ষকের গুণাবলি ও নির্দেশনা প্রচার করেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন বিশ্বশিক্ষক।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here