সিফাত আরা হুসেন: খুব বেশি সংখ্যক মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি নিম্নোক্ত ছবির ব্যক্তিকে চেনেন কিংবা তাঁর সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে জানেন। সমাজে আধুনিকতার দ্যুতি ছড়ানো, নারী শিক্ষার প্রসার,সমাজ সংস্কার এবং সমাজসেবী হিসেবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে যিনি অগ্রণী ভূমিকাগ্রহণ করেছিলেন এবং উপমহাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় যিনি প্রথম এবং শেষ মুসলিম মহিলা নওয়াব হয়েছিলেন তিনি হলেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী। এ মানব হিতৈষী ১৮৩৪ সালের ২৮মে কুমিল্লা জেলার লাকসাম থানার পশ্চিমগাঁওয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পূর্বসূরি মির্জা শাহজাদা আওরঙ্গজেবের বংশধর। তিনি ছিলেন জমিদার আহামেদ আলী চৌধুরী এবং আরাফান্নেসা চৌধুরীর কন্যা। আজ তাঁর ১৮৬ তম জন্মবার্ষিকী। তাঁর ছিল দুই ভাই :ইয়াকুব আলী চৌধুরী এবং ইউসুফ আলী চৌধুরী আর ছিল লতিফুন্নেসা চৌধুরী ও আমিরুন্নেসা চৌধুরী নামে দুই বোন। অন্যান্য ভাইবোনদের মত তিনিও রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে বেড়ে উঠেন যেখানে মহিলারা কঠোর পর্দাপ্রথা মেনে চলত। যাই হোক,এই পর্দাপ্রথা তাঁকে পৃথিবীর চারপাশ পর্যবেক্ষণ এবং পৃথিবীকে জানতে চাওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি। ফয়জুন্নেসা তাঁর চিন্তা চেতনায় ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং পুরোপুরি কুসংস্কারমুক্ত। সে সময়ে মেয়ে শিশুদের বাড়ির চার দেয়ালের বাইরে স্কুলে পাঠানো হত না।তাঁর পড়ালেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখে তাঁর পিতা তাঁর জন্য গৃহ শিক্ষক নিযুক্ত করেন। ফয়জুন্নেসার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি আরবি, ফারসি, বাংলা এবং সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। তিনি সে সময়ে অসাধারণ সৌন্দর্যের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। ১৮৬০ সালে তিনি এক জমিদার সৈয়দ গাজীউল হকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন যিনি তাঁর দু:সম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন। নানা কূট কৌশলের জালে পরাজিত হয়ে পূর্বে বিবাহিত গাজীউল হককে তিনি স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেন । তাদের আরশাদুন্নেসা এবং বদরুন্নেসা নামে দুটি কন্যা সন্তান ছিল।১৮৬৬ সালে তাঁদের সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর ফয়জুন্নেসা পশ্চিমগাঁওয়ে পিত্রালয়েই থেকে যান। জীবনের শেষ ত্রিশটি বছর তিনি এখানে থেকেই নারী শিক্ষা প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ তথা এই উপমহাদেশে তিনিই একমাত্র নারী যিনি সর্বপ্রথম চিন্তা করেছিলেন আধুনিক শিক্ষা না পেলে নারীরা পিছিয়ে পড়বে।তাই দু:সাহসিক উদ্যোগ নিয়ে মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া জন্মের সাত বছর আগে ১৮৭৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ফয়জুন্নেসা ইংরেজি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় যা আজ ফয়জুন্নেসা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। এটি উপমহাদেশে মেয়েদের জন্য স্থাপিত প্রাচীন স্কুলগুলোর অন্যতম । ১৯০১ সালে তিনি লাকসামে মাদ্রাসা স্থাপন করেন যা বর্তমানে লাকসাম নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারি কলেজ হিসেবে পরিচিত। তিনি লাকসাম পশ্চিমগাঁওয়ে বিএনও স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।নারী স্বাস্থ্য সেবায় ১৮৯৩ সালে তিনি নওয়াব ফয়জুন্নেসা মহিলা ওয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমানে কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের সাথে যুক্ত। নওয়াব ফয়জুন্নেসা ১৮৯৯ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ নির্মাণের কাজে সেই সময়কার দশ হাজার টাকা অনুদান দেন। তিনি ১৪ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দাতব্য হাসপাতাল,পুল, কালভার্ট,রাস্তাঘাট ইত্যাদি নির্মাণ করেন। পশ্চিমগাঁওয়ের নওয়াব বাড়ির সন্নিকটে ডাকাতিয়া নদীর পাড় ঘেঁষে তিনি স্থাপন করেন বালকদের জন্য একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা কালক্রমে ‘নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারি কলেজ ‘হিসেবে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত হয়।তিনি তাঁর নওয়াব বাড়ির অদূরে একটি ফ্রি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা “গাজীমুড়া আলিয়া মাদ্রাসা “হিসেবে বর্তমানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কুমিল্লার তদানীন্তন জেলা প্রশাসক মি.ডগলাস ওই জেলার জন্য জনহিতকর সংস্কার প্রকল্প নিয়ে অর্থাভাবে বিপদে পড়েন। তিনি তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের নিকট ঋণ হিসেবে আর্থিক সাহায্য কামনা করেন। কিন্তু অর্থের পরিমাণ শুনে সবাই অপরাগতা জানান।তিনি কোন মুসলিমের কাছে সাহায্যের আবদার করেন নি।তার বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে মুসলমানদের কাছে তিনি কোন সাহায্য পাবেন না কারণ তাদের রয়েছে ইংরেজ বিরুদ্ধ মনোভাব।তাছাড়া পশ্চিমগাঁওয়ের জমিদার ছিলেন একজন নারী। অবশেষে, কোন পুরুষের কাছে সহায়তা না পেয়ে নিরুপায় হয়ে তিনি ফয়জুন্নেসার সাহায্য কামনা করলেন। ফয়জুন্নেসা এই প্রকল্প কতটুকু জজনহিতকর তা পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য সময় নিলেন। এরপর তিনি প্রকল্পটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। এক পর্যায়ে তিনি প্রকল্পের পুরো অর্থই একটি তোড়ায় বেঁধে একখানি চিঠিসহ ডগলাসকে পাঠিয়েছিলেন। তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন -“আমি যেসব জনকল্যাণমূলক কাজ করতে চাই তা আপনার হাত দিয়েই হোক আশাকরি। ফয়জুন্নেসা যে টাকা দেয় তা দান হিসেবেই দেয়, কর্জ হিসেবে নেয়।” সুদূর বাংলাদেশের নিভৃত পল্লীর এমন জমিদারের পরিচয় পেয়ে ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞী অভিভূত হয়ে পড়েন। মহারাণী ভিক্টোরিয়া তার সভাসদদের পরামর্শক্রমে ডগলাসের মাধ্যমে ফয়জুন্নেসাকে “বেগম “উপাধি প্রদানের প্রস্তাব করেন কিন্তু ফয়জুন্নেসা তা সরাসরি নাকচ করে দেন। তিনি জানান জমিদার হিসেবে নিজ জমিদারিতে তিনি এমনিতেই বেগম হিসেবে পরিচিত। নতুন করে বেগম উপাধির প্রয়োজন নেই। ডগলাস মহারাণী ভিক্টোরিয়াকে সব খুলে বলেন এবং তিনি ফয়জুন্নেসার তেজস্বীয়তায় অভিভূত হন।১৮৮৯ সালে তিনি ফয়জুন্নেসাকে “নওয়াব “উপাধিতে ভূষিত করেন। ফয়জুন্নেসার ধর্মপরায়ণতার উদাহরণও ছিল অনন্য। তিনি জাতভেদ ঘৃণা করতেন। তাঁরই সাহায্য ও সহযোগিতায় নির্মিত হয়েছে লাকসামে অসংখ্য মন্দির ও উপাসনালয়। তিনি নওয়াব বাড়ির সদর দরজায় একটি দশ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৪ সালে তিনি হজ্জ পালন করতে যান। সেখানে তিনি মক্কায় হাজীদের জন্য একটি মুসাফিরখানা ও মদিনায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মক্কায় হাজীদের জলকষ্ট দূর করতে তিনি বহু অর্থব্যয়ে “নাহরে যুবাইদা”পুনঃ খনন করেন। হজে যাওয়ার আগে বসতবাটি সহ সকল সম্পদ তিনি জনকল্যাণে দান করে গিয়েছিলেন। শিক্ষানুরাগ এবং সমাজসেবা ছাড়াও ফয়জুন্নেসা ছিলেন সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর “রূপজালাল”নামক কাব্যগ্রন্থ। ওই সময় তাঁর কাব্যগ্রন্থটি মধ্যযুগের কবি আলাওলের রচনার সাথে তুলনা করা হয়েছিল। নওয়াব ফয়জুন্নেসা এমন সময়ে বাংলা ভাষার চর্চা করেন যে সময়ে বাংলার অভিজাত মুসলিমদের মাঝে এ ভাষা ব্যবহার হত না।নারী জাতিকে শিক্ষা দীক্ষায় আর আধুনিকতায় এগিয়ে নিয়ে যেতে যা করা হয়েছিল তা অকল্পনীয়! ফয়জুন্নেসা বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীর পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। বান্ধব, সুধাকর, ঢাকা প্রকাশ তাঁর আর্থিক সহায়তায় প্রকাশ লাভ করে। সংগীত সার ও সংগীত লহরী নামে তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। ১৯০৩ সালে তিনি প্রয়াত হন। শিক্ষা ও সমাজ সেবায় অবদানের জন্য তাঁকে ২০০৪ সালে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়। আমি সৌভাগবান ভাবি নিজেকে কারণ এমন একজন মানবহিতৈষীর গড়া স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়েছি বলে এবং আনন্দিত আমার এসএসসি পরীক্ষার সনদে ঐ স্কুলের নাম জড়িয়ে আছে বলে। তবে খুবই মর্মাহত হই যখন দেখি অনেকেই এই মহৎ ব্যক্তির নাম পর্যন্ত শোনেননি বলে।অবশ্য এর জন্য তাদের কোন দোষ নেই।আমাদের পাঠ্যপুস্তকে এবং শিক্ষাক্রমে এমন সমাজসেবীর নাম অন্তর্ভুক্ত না হলে অজ্ঞতা এবং অকৃতজ্ঞতা জন্ম নেবে-এটাই স্বাভাবিক। স্টিভ জবস, স্টিফেন হকিং, মাদার তেরেসা,ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল প্রভূত ব্যক্তিত্ব আমাদের পাঠ্যপুস্তকে স্থান করে নিলেও স্থান হয়নি ফয়জুন্নেসার।আরো অবাক হই বর্তমানে এই জমিদারের জমিদার বাড়ি ও বিভিন্ন এস্টেটের রক্ষণাবেক্ষণ এর বেহাল দশা দেখে ও সংরক্ষণে উদাসীনতা পর্যবেক্ষণ করে। নারী শিক্ষা প্রসারে অনন্য অবদান রাখার পরেও ফয়জুন্নেসাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ২০০৪ সালে যে একুশে পদক দেওয়া হয় তাও ছিল যৌথ। আন্তর্জাতিক নারী দিবসেও তিনি থেকে যান উপেক্ষিত। কিন্তু কেন? ফয়জুন্নেসাকে স্বীকৃতি দিতে আমাদের এত দীনতা কেন?যদিও কোন স্বীকৃতি পাবার জন্যে মহৎ ব্যক্তিরা কাজ করেন না তারপরেও আমরা সে কাজ এবং কাজের স্রষ্টাকে সম্মান প্রদর্শনের দায় এড়াতে পারি না। আজকে জন্মবার্ষিকীতে প্রার্থনা করছি আল্লাহ যেন তাঁকে মহৎ কাজের জন্য উত্তম পুরস্কার প্রদান করেন এবং তাঁর গোনাহ মাফ করে তাঁকে যেন স্বর্গবাসী করেন।
সূত্র: “রূপজালাল” গ্রন্থ ও ইন্টারনেট