মোঃ মোশারফ হোসাইন: আসাম বা অসম ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত একটি রাজ্য। আসামের অধিবাসী বা আসামের ভাষাকে অসমীয়া বা ইংরেজিতে Assamese নামে আখ্যায়িত করা হয়। ১৮২৬ সালে ইয়াণ্ডাবু চুক্তির মাধ্যমে আসাম প্রথম ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় আসাম বেশির ভাগ অংশ ভারতের অংশ হয়। বাংলাদেশের বর্তমান সিলেট ঐ সময় আসামের অংশ ছিল, ১৯৪৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়। আজ মিডিয়া জুড়ে রয়েছে আসামের এনআরসি (National Registration of Citizens)। এর ফলে আসামের ১৯.৬ লক্ষ মানুষ আজ দেশ বিহীন। এখন যারা আসামের বাসিন্দা, তাদের প্রমাণ করতে হয়েছে যে তিনি নিজে অথবা তাঁদের পূর্বপুরুষরা ওই সময়ে অসমের বাসিন্দা ছিলেন।
ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে আসাম হলো একমাত্র রাজ্য, যেখানে ‘ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন অব সিটিজেন’ বা এনআরসি সম্পন্ন করা হলো। মূলত অসমিয়া তরুণদের একাংশের দীর্ঘদিনের জাতিবাদী রাজনীতির ফল এই নাগরিকপঞ্জি। এ বিষয়ে ভারতের বর্তমান প্রধান বিচারপতিরও ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করা গিয়েছে। তিনি আসামেরই নাগরিক এবং অসমিয়া পরিবারের সন্তান। কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার ও প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর ত্রিমুখী আগ্রহ থেকেই গত বছর এনআরসির চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশ হয়েছিল, আজ চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ পেল। একটু পেছনে তাকালে দেখা যায় দেশভাগের পর ১৯৫১ সালে জনগণনার ভিত্তিতে ভারতের আসামে প্রথম ন্যাশনাল রেজিস্ট্রি অফ সিটিজেন্স (NRC) তৈরি করা হয়। আসামের বাসিন্দা তাঁরাই যাঁদের নাম সেই তালিকায় ছিল অথবা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত যাঁদের নাম আসামের ভোটার তালিকায় ছিল।
১৯৭৯ সাল থেকে আসামে আন্দোলন শুরু করে অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়নও (আসু)। আসুর দাবি ছিল, আসামের নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষা করতে হবে, সে জন্য তারা আন্দোলন শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৫ সালের ১৫ অগস্ট একটি সমঝোতা সই হয় আসু, আসাম ও ভারত সরকারের মধ্যে। সই করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব, আসামের মুখ্যসচিব এবং আসুর তৎকালীন সভাপতি প্রফুল্লকুমার মহন্ত, সাধারণ সম্পাদক বিকে ফুকন, উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। এর পরে নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে মাত্র ৩২ বছর বয়সে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হন মহন্ত।
অসম অ্যাকর্ড অনুযায়ী ১৯৫১ সালে জনগণনায় যাঁদের নাম আছে তাঁরা দেশের নাগরিক, তার পরে ১৯৬১ সালের জনগণনায় যাঁদের নাম যুক্ত হয়ছে তাঁরা ভারতে থাকলেও নাগরিক হবেন না, সুযোগ-সুবিধা পাবেন। এমনকি বাংলাদেশ গঠনের সময় যাঁরা এসেছেন তাঁদের কথাও উল্লেখ করা হয়। দেশের অন্য অংশে অবশ্য নিয়ম, যাঁরা ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ের মধ্যে ভারতে এসেছেন, তাঁরা ভারতীয় নাগরিক।
এনআরসি নিয়ে কংগ্রেস সরকার ঢিমেতালেই চলছিল, কিন্তু ২০০৫ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত একটি জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে জানিয়ে দেয়, নির্দিষ্ট সময়েই মধ্যেই এনআরসি নবীকরণ করতে হবে। তার জেরেই এই তালিকা প্রকাশ।২০১৬ সালে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল এনে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে বদল করার প্রস্তাব করা হয়। সেই আইনে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে আগত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন ও পারসিক ও খ্রিস্টানদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হলেও ওই সব দেশ থেকে আগত কোনও মুসলমানকে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা উল্লেখ করা ছিল না। এই বিলের প্রতিবাদ করে বিজেপির সঙ্গে জোট ভেঙে দেওয়ার হুমকি দেয় অসম গণপরিষদ (অগপ)। প্রতিবাদ করে অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়নও (আসু)। যদিও অসম অ্যাকর্ডের নেপথ্যে ছিল আসু।
এই এনআরসি বিপদ ডেকে এনেছে ১৯.৬ লক্ষ মানুষের জীবনে। তাদের কোনো দেশ নেই কোথায় যাবে তারা? এদের একটা বড় অংশ বাংলাভাষী মুসলিম এবং হত দরিদ্র। বাংলাদেশ কী আবার পতিত হবে আরেক রোহিঙ্গা সমস্যায়? মিডিয়া সমাধান দেখাচ্ছে, যাদের নাম আসেনি তারা প্রথমে যাবে ফরেনার্স ট্রাইবুনাল এ পরে উচ্চ আদালতে। অভাবী আর হত দরিদ্র এত মানুষ কিভাবে যাবে আদালতের দরজায়?
আরেকটা মজার কথা, ইতোপূর্বে প্রকাশিত খসড়ায় বাদ যাওয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রাক্তন জওয়ান মহম্মদ সানাউল্লার নাম এবারও ওঠেনি। এছাড়া আসামের বিরোধী দলের বিধায়ক অনন্ত কুমার মালো আর তাঁর ছেলের নামও তালিকায় নেই। এই তালিকা অসম গণ পরিষদ, কংগ্রেস কাউকেই খুশি করতে পারেনি। অল ইন্ডিয়া মজলিশ ইত্তেহাদুল মুসলিমিন নেতা আসাউদ্দিন ওয়াইসিও এটির তীব্র সমালোচনা করেছেন।
বর্ণিত সব কিছুর জন্য দায়ী কে, সহজ উত্তর উগ্র জাতীয়তাবাদ Ultra-nationalism. এই মতবাদে বিশ্বাসীরা মনে করে তারাই Superior অন্যরা Inferior… জাতীয়তাবাদী আসামের অধিবাসীরা এর একটা বাস্তব প্রয়োগ ঘটালো।
লেখক: সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জয়পুরহাট।