সৈয়দ আবদাল আহমদ
‘‘গারদের দরজা খুলে গেল। খর্বাকৃতি একটা অবয়ব আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি ততক্ষণে উঠে বসেছি। লোকটি দ্রুত পায়ে এসেই আমার শার্টের কলার ধরে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিল। তাকে চিনে ফেললাম, আমার মামলার আইও। কিছু বুঝে উঠার আগেই অন্য একজন পেছন থেকে দ্রুত আমার চোখ বেঁধে ফেলেছে। বোতাম খুলে শরীর থেকে শার্টটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতার ঘোর কেটে মাথা পরিষ্কার কাজ করছে। এরা আততায়ী, আমাকে শেষ করে দিতে এসেছে। একবার ভাবলাম, চিৎকার করি। পরক্ষণেই মনে হলো, বন্দিশালায় আমার সেই চিৎকার এই কাপুরুষদের আনন্দের খোরাকই কেবল জোগাবে।’’
‘জেল থেকে জেলে’ নামক গ্রন্থে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান তার ওপর ২০১০ সালের জুলাই মাসে ক্যান্টনমেন্ট থানায় হামলার ঘটনার বর্ণনা এভাবেই শুরু করেন। থানার গারদে সেদিনের নির্যাতনে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখতে পান থানার ডিউটি অফিসারের মেঝেতে তিনি শুয়ে আছেন, সর্বাঙ্গ ভেজা।
বইটিতে তিনি লিখেন, ‘‘সকাল সাতটা না বাজতেই ক্যান্টনমেন্ট থানার কর্মকর্তা, কনস্টেবল দল বেঁধে এসে আমাকে সহানুভূতি জানিয়ে গেলেন। রাতের হত্যা প্রচেষ্টার ঘটনা পুরো থানায় জানাজানি হয়ে গেছে। ওদের কাছ থেকে টুকরো টুকরো যে খবর পেলাম সেগুলো জোড়া দিয়ে গতরাতে কী ঘটেছিল সেই চিত্রটিই আমার মতো করে বিবৃত করছিÑরাত একটার পর একটি সিভিল গাড়িতে পাঁচজনের একটি দল ক্যান্টনমেন্ট থানায় প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা ছিল, যার একজনকে আমি চিনতে পেরেছি। অন্য কর্মকর্তার নাম জিজ্ঞাসা করে জবাব পেলাম না। সবাই এড়িয়ে গেল। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বাকি তিনজনকে থানার কেউ চিনতে পারেনি। কনস্টেবল, কর্মকর্তা এক বাক্যে বললো, ওই তিনজন পুলিশ বাহিনীর কেউ নয়। তাহলে তারা কারা? তিন আততায়ী। দলটি এসেই কর্তব্যরত এএসআই’র কাছ থেকে আমার সেলের চাবি নিয়ে থানার বাতি নিভিয়ে দেয়। সেলে ঢোকার সময় থানার কাউকে কাছে থাকতে দেয়নি। নির্যাতনে আমি অজ্ঞান হয়ে গেলে মৃত ভেবে এরা খানিকটা আতংকিত হয়ে আমাকে থানায় ফেলে রেখে চলে যায়।’’
মাহমুদুর রহমানের ওপর দ্বিতীয় আক্রমণের বিবরণ এটি। নিজের বর্ণনায় এভাবেই তিনি এর উল্লেখ করেন জেল থেকে জেলে বইয়ে। ২০১০ সালের জুনে প্রথম গ্রেফতার হওয়ার পর ক্যান্টনমেন্ট থানায় তার ওপর এই আক্রমণ হয়েছিল রিমা-ে থাকা অবস্থায়। অবশ্য তার ওপর প্রথম আক্রমণ হয় গ্রেফতার হওয়ার দু’ আড়াই মাস আগে একই বছরের এপ্রিলে। ঘটনার দিন তিনি কারওয়ান বাজার থেকে অফিস শেষ করে গুলশানের বাসায় যাচ্ছিলেন। তেজগাঁও সাত রাস্তার মোড় পেরিয়ে তার গাড়ি সামান্য উত্তরে একটি পেট্রোল পাম্পের কাছাকাছি যেতেই বোমা ও হাতুড়ি দিয়ে গাড়িতে আক্রমণ হয়। দুর্বৃত্তদের নিক্ষিপ্ত হাতুড়ি পেছনের কাঁচ ভেঙ্গে গাড়ির ভেতরে গিয়ে পড়ে। ভাঙা কাঁচে মাহমুদুর রহমান সামান্য আহত হলেও হাতুড়ির আঘাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পান। তার ওপর তৃতীয় আক্রমণটি হয় লন্ডনে ২০১২ সালে। প্রথম দফায় জেল থেকে মুক্তি লাভের পর তিনি লন্ডনে গেলে আওয়ামীলীগের প্রবাসী সমর্থকরা তাকে আক্রান্ত করে।
চতুর্থ দফায় মাহমুদুর রহমান আক্রমণের শিকার হলেন গত ২২ জুলাই রোববার কুষ্টিয়ার আদালত প্রাঙ্গণে। একটি মানহানির মামলায় তিনি সেখানে জামিন নিতে গিয়েছিলেন। জামিন লাভের পর তিনি ঢাকার উদ্দেশ্য ফেরার সময় সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ আদালতে তাকে ঘেরাও করে। এ প্রেক্ষিতে তিনি সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এমএম মোর্শেদের শরণাপন্ন হন এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ নিয়ে তার এজলাসে আশ্রয় নেন। সেখানে প্রায় চার ঘন্টা অবরুদ্ধ থাকার পর কোর্ট দারোগা ও ওসি এসে তাকে বের করে এনে একটি প্রাইভেটকারে তোলে দেয়। গাড়িটি কিছুদূর যেতেই আদালত চত্বরেই ছাত্রলীগের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী লাঠি, ইট ও পাথর দিয়ে আক্রমণ চালায়। তার মুখ, মাথা, ঘাড় ও চোখের নিচে আঘাত করা হয়। রক্তাক্ত হয় তার সারা শরীর। আঘাতে চোখের নিচে ক্ষতস্থানে চারটি, মাথার পেছনে তিনটি এবং পিঠের ক্ষতস্থানে দুটি সেলাই লেগেছে। রক্তনালী কেটে যাওয়ায় প্রচুর রক্তপাত হয়। এতে তার শার্ট-প্যান্ট রক্তে ভেসে যায়।
কুষ্টিয়ার আদালতে মাহমুদুর রহমানকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আগেই অনুরোধ করেছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই প্রথম আলোকে জানান, বিএনপি মহাসচিবের অনুরোধের প্রেক্ষিতে তৎক্ষণাৎ তিনি কুষ্টিয়ার এসপি মেহেদি হাসানকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ মানা হয়নি। পুলিশের উপস্থিতিতে প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত মানুষের সামনে রক্তাক্ত হলেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। আক্রমণকারীরা তার ভাড়া করা মাইক্রোবাসের চাবিও নিয়ে যায়। যশোরে ফেরার জন্য তার জন্য কোনো গাড়ি পাওয়া যায়নি, কুস্টিয়ায় চিকিৎসারও ব্যবস্থা হয়নি। অবশেষে একটি অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে তিনি ও তার সফরসঙ্গীরা যশোরে আসেন। বিমানবন্দরে যশোরের চিকিৎসকরা তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। বিমানে ঢাকায় আনার পর ইউনাইটেড হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়।
কুষ্টিয়ার এই ঘটনায় দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সাংবাদিকদের সংগঠন বিএফইউজে-ডিইউজেসহ পেশাজীবীরা এ ঘটনার প্রতিবাদে ধারাবাহিক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করছেন। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিবর্গ এ ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে দোষীদের বিচার দাবি করেছে। সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট সিপিজে, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস, এ ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি দাবি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রবার্ট কেনেডি ফাউন্ডেশনের প্রধান কেরি কেনেডি মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান। তিনি পৃথক দুটি টুইট বার্তায় বলেন, “এ হামলা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের ওপর আক্রমণ। সরকারকে এ জন্যে জবাবদিহি করতে হবে।” মানবাধিকার সংগঠন এশিয়ান হিউম্যান রাইটসও এ ঘটনায় উদ্বেগ জানায়।
দেশ-বিদেশে প্রতিক্রিয়া হলেও সরকার এ ব্যাপারে নির্বিকার। ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে এখনো গ্রেফতার করা হয়নি। উল্টো ঘটনাকে ভিন্নখাতে নেয়ার জন্য অপপ্রচারে নেমেছে সরকারি লোকজন। মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মানহানির মামলাটির বাদী কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি ইয়াসির আরাফাত তুষার। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী তার নেতৃত্বেই হামলাটি হয়। কিন্তু সংবাদ সম্মেলন করে তুষার বলেন, এ হামলার সঙ্গে ছাত্রলীগ জড়িত নয়। সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথাও বলেন যে, ছাত্রলীগ সকাল ১১টা থেকে বিকাল তিনটা পর্যন্ত ঘটনাস্থলে ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে মাহমুদুর রহমানের জামিনের আদেশ হয় বারোটায়। তাহলে ছাত্রলীগ তিনটা পর্যন্ত সেখানে অবস্থানের কারণ কি? আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও অসত্যের আশ্রয় নিয়েছেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, মাহমুদুর রহমানের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করেনি, এটা নাকি সাজানো নাটক!
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ ঘটনাকে অবশ্য অনাকাংখিত এবং অনভিপ্রেত উল্লেখ করে বলেছেন, এ ধরনের হামলা আমরা সমর্থন করি না। যারা হামলা করেছে তারা ছাত্রলীগ নামধারী দৃর্বৃত্ত। হামলা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য না করলেও প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছাসেবক লীগের অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রে জয়কে হত্যা প্রচেষ্টায় শফিক রেহমান ও মাহমুমুর রহমান জড়িত বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিএনপি আমলে মাহমুদুর রহমান বিদ্যুত মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে বিদ্যুতের সংকট হয়েছিল। অথচ মাহমুদুর রহমান বিদ্যুৎ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব কখনো ছিলেন না। তিনি জ্বালানি উপদেষ্ট হিসেবে ছিলেন, বিদ্যুৎ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে ছিলেন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।
এক মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে সরকার ও সরকার দলীয় লোকজন কেন এতো বেপরোয়া? গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র কেন তার বিরুদ্ধে? তার ওপর জুলুম তো কম হয়নি। তাকে দু’দফায় পাঁচ বছরের বেশি জেলে বন্দি রাখা হয়েছে। ৩৮দিন রিমা-ে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। ১২৫টি মামলা দিয়ে চরমভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। তার পত্রিকা আমার দেশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং পত্রিকা অফিস পুড়িয়ে ছাই করা হয়েছে। তার মা এবং স্ত্রীর নামেও দেয়া হয়েছে মামলা। তারপরও তার ওপর শারীরিক আক্রমণ কেন? এই যে চার দফায় তার ওপর হামলা হলো, এটা নিছক তাকে শারীরিক ভাবে নাজেহাল করার জন্য নয়। এই হামলার উদ্দেশ্য কি মাহমুদুর রহমানকে প্রাণে মেরে ফেলার জন্য নয়? অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন বলে, সত্যকথা তুলে ধরবেন বলে, দেশ ও জাতীয় স্বার্থের ব্যাপারে সোচ্চার বলে তাকে মেরে ফেলতে হবে? তার জীবন অতীষ্ঠ করে ফেলতে হবে? এটা কেমন কথা! না, তা হতে পারে না। এটা চরম অন্যায়।
মাহমুদুর রহমান ইতোমধ্যে বলেছেন, “দীর্ঘ বন্দিজীবন, রিমান্ডে নির্যাতন, পরিবারে হয়রানি এসব আমাকে আমার বিশ্বাস ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি, আমার মনোবলেও এতটুকু চিড় ধরেনি। শিখেছি, প্রকৃত মানুষের ধর্মই হচ্ছে জুলুম ও অবিচারের প্রতিবাদ করা। জুলুমের প্রতিবাদ করেই যাব।”
দেশবাসী বারবর তার এই বক্তব্যের প্রমান পেয়েছে। গত ২২ জুলাই কুস্টিয়ার আদালত চত্ত্বরে প্রাণনাশের হুমকীর মুখে, রক্তাক্ত অবস্থায়ও ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরেই তিনি বলেছেন, “এই দেশ ও ইসলামের জন্য প্রয়োজনে আমি একাই জীবন দেব”। তার এই সাহসী এবং দৃঢ় মনোবলে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার একটি উক্তির কথা মনে পড়ছে। ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘সাহসী তিনিই, যিনি ভয়কে জয় করেন।’ মুহমুদুর রহমানের শরীর থেকে অজ¯্র রক্ত ঝরেছে। তার রক্ত-মাখা শার্ট ঊনষত্ত্বরের আসাদের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। এই রক্ত বৃথা যাবে না। অন্যায় পরাভূত হবেই।
[লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক]