নিউজ বাংলা ডেস্ক:
গাজীপুরের বাঘেরবাজারে যাত্রী সালাহ উদ্দিনকে চাপা দিয়ে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন আলম এশিয়া পরিবহনের বাসের চালক ও কন্ডাক্টর। মঙ্গলবার বিকেলে গাজীপুরের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত ১-এর বিচারক শামীমা খাতুনের আদালতে তাঁরা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে দুই আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়।
জবানবন্দি দেওয়া দুজন হলেন আলম এশিয়া পরিবহনের বাসচালক ও ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার লতিফপুর গ্রামের রোকন উদ্দিন (৩৫) ও কন্ডাক্টর শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার পোড়াগাঁও গ্রামের আনোয়ার হোসেন (৩০)।
গাজীপুর আদালতের পুলিশ পরিদর্শক মীর রকিবুল হক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জয়দেবপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুর রহমান ভূঁইয়া জানান, বাসচালক রোকন উদ্দিনকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া থানা সীমান্ত এলাকা থেকে ও কন্ডাক্টর আনোয়ার হোসেনকে শেরপুরের নন্দী বাজার এলাকা থেকে সোমবার গ্রেপ্তার করে জয়দেবপুর থানার পুলিশ। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। পরের দিন আজ গ্রেপ্তারকৃতদের গাজীপুরের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত ১-এর বিচারক শামীমা খাতুনের আদালতে পর্যায়ক্রমে হাজির করা হয়।
পুলিশের ওই কর্মকর্তারা জানান, মামলার প্রধান আসামি চালক রোকন উদ্দিনকে দুপুর আড়াইটার দিকে ওই আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী জবানবন্দিকালে রোকন উদ্দিন পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন। তাঁর জবানবন্দির পর বিকেল সোয়া ৫টার দিকে একই আদালতে মামলার অপর আসামি গ্রেপ্তারকৃত কন্ডাক্টর আনোয়ার হোসেনকে হাজির করা হয়। আদালতে আনোয়ার হোসেনও ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন বিচারক শামীমা খাতুন।
রোকন উদ্দিন তাঁর স্বীকারোক্তিতে জানান, ঈদ শেষে গাজীপুরে ফেরার পথে গত রোববার দিন ময়মনসিংহের ফুলপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে স্ত্রীকে নিয়ে বাসে চড়েন সালাহ উদ্দিন। বাসে উঠার সময় সালাহ উদ্দিন দুজনের বাসভাড়া বাবদ মোট ৫০০ টাকা নির্ধারণ করেন। পথে তারাকান্দা এলাকায় পৌঁছালে কন্ডাক্টর সালাহ উদ্দিনের কাছে ভাড়া দাবি করেন। এ সময় নিজেকে গাড়িচালক পরিচয় দিয়ে সালাহ উদ্দিন নির্ধারিত বাসভাড়া থেকে ৫০ টাকা করে দুজনের মোট ১০০ টাকা কম দিতে চাইলে বাসের কন্ডাক্টরের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। বেশ কিছুটা সময় ধরে তাঁদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা চলে। এ সময় সালাহ উদ্দিনের সঙ্গে বাসের কন্ডাক্টর, হেলপার ও সহকারীদের ধাক্কাধাক্কি হয়। একপর্যায় বাসের অতিরিক্ত হেলপার সারোয়ারের হস্তক্ষেপে সালাহ উদ্দিন নির্ধারিত ভাড়া ৫০০ টাকার পুরোটা পরিশোধ করেন। এ ঘটনার পর বাসটি যাত্রী নামাতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের বাঘেরবাজার বাসস্ট্যান্ডে থামে। সালাহ উদ্দিন বাস থেকে নেমে তাঁর লোকজনকে নিয়ে বাসের সামনে দাঁড়িয়ে গতিরোধ করে শ্রমিকদের মারধর করতে থাকেন। এ সময় বাসটি নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে গিয়ে ডান পাশের সামনের চাকায় পিষ্ট হয়ে সালাহ উদ্দিন নিহত হন।
গাজীপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফজাল হোসেন বাসচালক রোকন উদ্দিনের বরাত দিয়ে জানান, আলম এশিয়া পরিবহনের ওই বাসটির মূল চালক ছিলেন আজিজুল ইসলাম। রোকন উদ্দিন তাঁর পরিবর্তে বদলি চালক হিসেবে প্রথমবারের মতো ঘটনার দিন ওই বাস চালাচ্ছিলেন। এর আগে রোকন উদ্দিন ইসলাম পরিবহন, ইমাম পরিবহনসহ ওই রুটের অন্যান্য পরিবহনের বাস চালাতেন। ঘটনার দিন রোববার বাসভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে বাসটি যাত্রী নামাতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের বাঘেরবাজার বাসস্ট্যান্ডে থামলে সালাহ উদ্দিন নামেন। এ সময় সালাহ উদ্দিন বাস থেকে নেমে পূর্ব থেকে স্ট্যান্ডে অপেক্ষমাণ তাঁর লোকজনকে নিয়ে বাসের সামনে দাঁড়িয়ে গতিরোধ করে বাসের শ্রমিকদের মারধর করতে থাকেন। এ সময় অবস্থা বেগতিক দেখে বাসের হেলপার বলেন, ‘ওস্তাদ গাড়ি টান দেন। মানুষ নিচে পইড়া মরলে আমি বুঝমু।’ হেলপারের এ কথায় কয়েকজন যাত্রীকে না নামিয়েই বাসটি নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে গিয়ে ডান পাশের সামনের চাকায় পিষ্ট হয়ে সালাহ উদ্দিন নিহত হন।
মায়ের প্রতি ভালোবাসায় রোকন গ্রেপ্তার!
মায়ের প্রতি ভালোবাসার কারণেই চালক রোকন উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে বলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জয়দেবপুর থানার এসআই আবদুর রহমান ভূঁইয়া জানিয়েছেন।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানান, ঘটনার পর বাসটিকে গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়া এলাকার ফুয়াং কারখানার সামনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে ফেলে রেখে চালক রোকন উদ্দিন ও তাঁর সহকারীরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান। যাওয়ার সময় রোকন উদ্দিন ভুলক্রমে তাঁর মোবাইল ফোনটি বাসে ফেলে রেখে যান। পুলিশ বাস থেকে মোবাইল ফোন উদ্ধার করে। তবে চালকের নাম পরিচয় অজ্ঞাত থাকে। পুলিশ ময়মনসিংহের বাস টার্মিনাল এলাকা ও তাঁর ভাড়া বাসাসহ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে চালকের সন্ধান করতে থাকে। পরে একটি মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলায় রোকন উদ্দিনের গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালাতে যায়। এ সময় রোকন তাঁর মাকে নিয়ে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে রোকন পাশের কংস নদীতে ঝাঁপ দেন। এ সময় পুলিশ এলাকাবাসীর সহযোগিতায় নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে রোকনকে গ্রেপ্তার করে। ঘটনার সময় রোকনের মা কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে যান।
এসআই আবদুর রহমান ভূঁইয়া আরো জানান, মায়ের প্রতি ভালোবাসার কারণেই চালক রোকন উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। ঘটনার পর তিনি মাকে সঙ্গে নিয়েই বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। মা তাঁর সঙ্গে থাকার কারণেই বাংলাদেশ সীমান্ত পার হতে বিলম্ব হওয়ায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা গেছে। তা না হলে তিনি দালালের মাধ্যমে ঘটনার পর পরই ভারতে পাড়ি জমাতেন।
জয়দেবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান ও নিহতের স্ত্রী ও ভাই জামাল উদ্দিন জানান, ঈদের ছুটি শেষে স্ত্রী পারুল আক্তারকে নিয়ে রোববার ময়মনসিংহের শ্বশুরবাড়ি থেকে আলম এশিয়া পরিবহনের একটি বাসে চড়ে গাজীপুরের বাসায় ফিরছিলেন স্থানীয় স্কটেক্স অ্যাপারেলস পোশাক কারখানার গাড়িচালক সালাহ উদ্দিন (৩৫)। পথে তাঁর সঙ্গে ভাড়া নিয়ে ওই বাসের কন্ডাক্টর, হেলপার, সুপারভাইজার ও চালকের বাকবিতণ্ডা হয়। নিজেকে গাড়িচালক পরিচয় দিয়ে সালাহ উদ্দিন কিছু টাকা কম দিতে চাইলে এ বাকবিতণ্ডা হয়। এ সময় বাসের কন্ডাক্টর ও সহকারীরা সালাহ উদ্দিনকে লাঞ্ছিত করেন এবং হুমকি দেন। বাসশ্রমিকরা মারধর করতে পারেন এ আশঙ্কায় সালাহ উদ্দিন তাঁর ভাই জামাল উদ্দিনকে মোবাইল ফোনে জানিয়ে গাজীপুরের বাঘেরবাজার বাসস্ট্যান্ডে আসতে বলেন। খবর পেয়ে জামাল উদ্দিন ওই বাসস্ট্যান্ডে এসে ভাই ও ভাবির জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। একপর্যায়ে বাসটি বাঘেরবাজার এলাকায় পৌঁছালে বাসের শ্রমিকরা লাথি মেরে সালাহ উদ্দিনকে বাস থেকে নিচে ফেলে দেন। তাঁর স্ত্রীকে না নামিয়ে চালক বাসটি নিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় সালাহ উদ্দিন ও তাঁর ভাই জামাল উদ্দিন গতিরোধের জন্য বাসের সামনে দাঁড়ালে চালক সালাহ উদ্দিনকে চাপা দিয়ে বাসটি নিয়ে পালিয়ে যান। এতে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে সালাহ উদ্দিন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। পরে সালাহ উদ্দিনের স্ত্রীকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে মহাসড়কের আমতলা এলাকায় বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এ ঘটনার পর বাসটিকে স্থানীয় হোতাপাড়া এলাকার ফুয়াং কারখানার সামনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে ফেলে রেখে বাসের চালক, কন্ডাক্টর, হেলপার ও সুপারভাইজারসহ অন্যরা পালিয়ে যান। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে বাসটিকে পরিত্যক্ত অবস্থায় জব্দ করে। এ ঘটনায় রাতে নিহতের ছোট ভাই জামাল উদ্দিন বাদী হয়ে জয়দেবপুর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় বাসের চালক, কন্ডাক্টর, হেলপার ও সুপারভাইজারকে আসামি করা হয়।