প্রশংসা সবাই শুনতে চায়। নিন্দা বা সমালোচনা শোনার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত নই। ভালো কাজের প্রশংসা বা স্বীকৃতি আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়, কাজে উদ্বুদ্ধ করে। শুধুই প্রশংসা কিংবা অতিপ্রশংসা ব্যক্তিকে বিপথে পরিচালিত করতে পারে। রাষ্ট্র কিংবা সরকার প্রধানকে হীরক রাজার মতো আত্মম্ভরিতার দিকে নিয়ে যায়। তাই কথায় বলে ‘মাত্রাতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়’।
কোনো বিষয়কে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখা বা পরখ করে দেখারও প্রয়োজন রয়েছে। কোনো বিষয়কে অন্ধের মতো গ্রহণ করার মাঝে নানা বিপদ আছে। বাজার করতে গেলেও পণ্যগুলো ঠিক আছে কিনা মেয়াদ আছে কিনা আমরা দেখে নেই। কাজেই প্রশংসা আর সমালোচনা একে অন্যের পরিপূরক। আমরা দেখেছি হীরক রাজার পারিষদ তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও সামান্য বালকের কাছে তিনি লজ্জিত হয়েছিলেন। কারণ ওই বালক তোষামদ করা শিখেনি। রাজার প্রশংসা করে নিজের আখের গোছানোর চিন্তা করেনি। অকপটে সত্যটিই সে তুলে ধরেছে।
মানুষ যখন দাম্ভিকভাবে কথা বলে সেটি আমরা ভালোভাবে গ্রহণ করিনা। কারো বিনীত কথায় আমাদের হৃদয় বিগলিত হয়। তার কথা কান পেতে শুনতে ইচ্ছে করে। সত্য আর বিনয় দুটির প্রয়োজন খুব সমাজে। ক্ষমতাবান হয়ে ক্ষমতা দেখানো খুব সহজ কিন্তু ক্ষমতাবান হয়েও সাধারণের মতো জীবন যাপন করা তত সহজ নয়। আর মহত্বটা এখানেই। বিত্তবান আর ক্ষমতাবান পরিবারের রবীন্দ্রনাথের জীবনাচরণ দেখে আমরা বিস্মিত হই। কথটা দ্বিধাহীনভাবে তার পক্ষে বলা সম্ভব-‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম সে কখনো করে না বঞ্চনা।’ সত্যিকার অর্থে সত্যই আমাদের কেবল বঞ্চনা থেকে রক্ষা করতে পারে। ভালো কথা বলা এক জিনিস আর তার সাথে একাত্ম হয়ে জীবন পরিচালনা আরেক জিনিস। বাংলা সাহিত্যকে রবীন্দ্রনাথ যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তার জন্য তার ভেতর কোনো আত্মম্ভরিতা তৈরি হয়নি। বিশ্বকবি হয়েও বিনয়ের সাথে তিনি বলে গেছেন,‘আমার কবিতা আমি জানি গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সর্বত্রগামী’। নিজের অপূর্ণতাকে নিজেই তুলে ধরেছেন।
সেদিন গিয়েছিলাম ঢাকা বিভাগ সাংবাদিক ফেরামের অনুষ্ঠানে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের আহবানে। কারো গুণকীর্তন শোনার জন্য সময় ব্যয় করা মোটেও পোষায় না। কাজের কথা হলে সেটা ভালো লাগে। অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক নেতা উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন জনাব কুদ্দুস আফ্রাদ, আবদুল জলীল ভ‚ইয়া ও ওমর ফারুক। ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক হয়েও তারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে খুব স্পষ্ট কথা বলেছেন। বক্তাদের কণ্ঠে সেদিন বেশ সত্যটাই উচ্চারিত হয়েছিল। তারা বলেছিলেন, সংবাদ মাধ্যম বা গণমাধ্যম হচ্ছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। ঘরের চার খুঁটির একটা না থাকলে ঘর টিকে না। সংবাদ মাধ্যমকে পাত্তা না দিলে সরকার টিকবেনা। সংবাদ মাধ্যম মন্ত্রী এমপিসহ সরকারের সকল কার্যক্রম তুলে ধরে অথচ কোনো সরকারই সংবাদপত্রের সত্যিকার স্বাধীনতা চায় না। বর্তমান সরকার এর ব্যতিক্রম নয়। সাংবাদিক নেতারা বলেন, আমরা ডিজিটাল আইনের যে সংশোধনী আমরা দিয়েছিলাম সরকার সেটা সংশোধন আজও করেনি।
সরকারের বিরোধীতা করা সাংবাদিকের কাজ নয়। অসঙ্গতি অনিয়ম তুলে ধরাই তার কাজ। রাষ্ট্রের প্রথম তিনটি স্তম্ভ সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও আইনবিভাগের কর্মকর্তারা যে সুযোগ সুবিধা ভোগ করে চতুর্থ স্তম্ভের মানুষগুলোকি তার ধারের কাছে আছে। যুগের পর যুগ অবহেলিত ও নিগৃহীত হচ্ছে। আর্থিক সুবিধা বাদই দিলাম। মালিকরা যেভাবে সাংবাদিকদের তার স্বার্থে ব্যবহার করছে তাতে সাংবাদিকতা সেই পেশার জায়গায় নেই। সাংবাদিকতা সত্যিকার অর্থে হাবুডুবু খাচ্ছে কর্পোরেট কালচারে নিমজ্জিত হয়ে। সংবাদপত্রের অনেক দায়দায়িত্ব থাকে অসত্য ও ভিত্তিহীন সংবাদ তারা ছাপতে পারে না। সেক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকলে অনেক কিছু বিকৃতভাবে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে সমাজে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। তাই সংবাদ মাধ্যম নিয়ে রাষ্ট্র, সরকার ও নাগরিকদের আরো ভাববার প্রয়োজনরয়েছে। স্বাধীনতার এই মাসে চেতনাকে আরো শানিত করি। দেশের জন্য একযোগে কাজ করি। (চলবে)