শিপন আলম :
‘ময়লা হাতে ওকে যেন ছুঁস না ওরে মন, পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন’। ১৯৬৮ সালে তপন সিংহ পরিচালিত জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাড়া জাগানো ছবি ‘আপনজন’- এর একটি গানের চরণের ন্যায় বর্তমান বিশ্বও করোনাভাইরাসের থাবায় গভীরতর অসুখের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যার আক্রমণে দরিদ্র রাষ্ট্র থেকে শুরু করে উন্নত বিশ্বের সবাই নিদারুণ অসহায় হয়ে পড়েছে। ১৯১৮ সালে সংঘটিত স্প্যানিশ ফ্লু’র পরে মানব সভ্যতার ইতিহাসে আঘাত হানা এটি দ্বিতীয় বিশ্ব মহামারী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিপর্যয়ের মধ্যেই দুই বছরব্যাপী আঘাত হানা সে ফ্লু’তে প্রায় দুই কোটি মানুষ মারা যায়। করোনা ভাইরাসের ন্যায় সে সময়ও মূল আক্রান্তস্থল ছিল ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা। জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটি সূত্রে করোনার তাÐবে এখন পর্যন্ত মৃত্যু প্রায় ২ লাখ ৮৫ হাজার এবং আক্রান্ত প্রায় ৪১ লাখ ৭৫ হাজার ২৮৪ জন। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা স্রষ্টা ছাড়া আর কেউ জানে না।
পরপর দুটি শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী এই যে মহা বিপর্যয়, তা থেকে বিশ্ববাসীকে অবশ্যই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে স্প্যানিশ ফ্লু ও করোনার ন্যায় সংঘটিত বিপর্যয়কে আমরা মোকাবেলা করতে পারি। করোনাভাইরাস থেকে বর্তমান বিশ্ব যেসকল শিক্ষা নিতে পারেঃ
(১) তথ্য-প্রযুক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রভৃতিতে মানুষ যতই শক্তিশালী হোক না কেন স্রষ্টার শক্তির কাছে সে বড়ই অসহায়। স্রষ্টা না চাইলে করোনার ন্যায় সামান্য একটি ক্ষুদ্র ও অদৃশ্য প্রাণীর মোকাবেলা করার সক্ষমতাও তার নেই।
(২) এটি আমাদের শেখালো যে আমরা আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে মানুষ নিধনের জন্য যতটা ব্যবহার করেছি, মানুষকে বাঁচাতে ততটা ব্যবহার করতে পারিনি। এজন্যই ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে প্রাণ-সংহারক অস্ত্র নয় বরং প্রাণ-রক্ষক স্বাস্থ্যসেবা অধিকতর গুরুত্ব পাবে।
(৩) করোনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে নিজেকে এবং নিজের চারপাশকে সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। যত্র-তত্র ময়লা আবর্জনা না ফেলা, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলা। শরীরের বাহ্যিক অঙ্গগুলো বার বার সাবান পানি দিয়ে পরিষ্কার করা। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা।
(৪) বেঁচে থাকার জন্য মানুষের জীবনের অত্যাবশক উপাদান হচ্ছে খাদ্য, পানি আর ওষুধ। জীবনের প্রশ্নে দামি গাড়ি, বিলাসবহুল বাড়ি, চাকচিক্যময় অলংকার, রঙ-বেরঙ এর পোশাক পরিচ্ছদের কোন মূল্য নেই। করোনভাইরাস আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে এটিও দেখিয়ে দিলো।
(৫) ছোটবেলা থেকে মানুষকে যদি আইন-কানুন মানতে অভ্যস্থ করা না হয় তাহলে বিপর্যয়ের সময় শুধু আইন-শৃঙখলা বাহিনী ব্যবহারের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব হয় না। আমরা স্বীকার করি বা না করি, মানুষকে শেখানোর কাজটা যে কত বড় দুরূহ কাজ তা করোনা পরিস্থিতি আমাদের নতুন করে শেখালো। এ কারণেই উন্নত বিশ্বের শিক্ষিত জনগণের তুলনায় আমাদের মত অশিক্ষিত দেশগুলোর জনগণকে করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝাতে ও স্বাস্থ্যবিধিসহ সরকার নির্দেশিত আইন-কানুন মানাতে এতোটা বেগ পেতে হচ্ছে। তাই ভবিষ্যৎ বিশ্বে অবশ্যই মৌলিক মানবীয় গুণসম্পন্ন ও আনুগত্যপ্রবণ শিক্ষাব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে।
(৬) আমরা যতই উন্নয়ন উন্নয়ন করি না কেন আমাদের উন্নয়নের দ্বারা যদি প্রকৃতি ও পৃথিবী ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাহলে সে উন্নয়ন টেকসই নয়। পৃথবীর অন্য সকল উপাদানকে বাদ দিয়ে দশকের পর দশক ধরে আমরা যে স্বার্থপরের মত আত্মকেন্দ্রিক উন্নয়নের পথ বেছে নিয়েছিলাম তা থেকে এ করোনাকালে পৃথিবীর কিছুটা হলেও উত্তরণ ঘটেছে। মানুষ লকডাউনে থাকায় কল-কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে না,গাড়ি চলছে না, ফলে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হচ্ছে না। তাই বাতাসের গুণগত মান বৃদ্ধি পেয়েছে, আস্তে আস্তে ফুলে ফলে শোভিত হয়ে উঠছে প্রকৃতি। এদৃশ্য দেখে পরিবেশবিদ জয়ন্ত বসু মনে করেন পৃথিবীকে যদি আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি, সেটাই হবে করোনা থেকে পাওয় সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
(৭) প্রকৃতির অভিয়োজন প্রক্রিয়া বজায় রাখার জন্য মানুষ যদি স্রষ্টা কর্তৃক নির্ধারিত বিধিনিষেধ না মেনে প্রকৃতির অন্য উপাদানকেও নিজের ভোগের সামগ্রী বানিয়ে ফেলে তাহলে তা মানুষকে খুব ক্ষতিগ্রস্থ করে সেটি অন্য সময়ের ন্যায় এই করোনাকালেও আরেকবার প্রতীয়মান হলো। বিষয়টি অনুধাবন করেই যে চীন করোনার পূর্বে বিষাক্ত সাপ-বিচ্চু থেকে শুরু করে গৃহপালিত কুকুর-বিড়ালকেও নিজেদের ডাইনিং টেবিলে আহারের সামগ্রী বানিয়েছিল সেই চীনই করোনা শেষ হওয়ার পূর্বেই তাদের খাদ্য তালিকা থেকে কুকুর-বিড়ালকে বাদ দিয়ে এগুলোকে গৃহপালিত প্রাণীর স্বীকৃতি দিয়েছে।
(৮) করোনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে তথাকথিত প্রগতিশীলরা অতি আধুনিকতা চর্চা করতে গিয়ে যে উলঙ্গপনা ও বেহায়াপনার রাজত্ব কায়েম করেছিল তা থেকে কিছুটা হলেও উত্তরণ ঘটবে। বিশেষ করে পাশ্চাত্য সমাজে হিজাব ও বোরকা পরিধানকে কেন্দ্র করে যে ইসলামোফোবিয়ার ঘৃণ্য উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল তা কিছুটা হলেও প্রশমিত হবে। যার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে চীন ‘বেইজিং বিকিনি’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
(৯) জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রভৃতিতে আমরা যতই সীমারেখা টানিনা কেন প্রকৃতপক্ষে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। যেকেউ যেকোন সময় যেকোন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে। সবারই অভিন্ন লক্ষ্য হচ্ছে বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকাই জীবনের প্রধান লক্ষ্য।
(১০) অর্থ-বিত্ত, সম্পদ আর প্রাচুর্যের অহংকারে ডুবে থাকা মানুষ পৃথিবীর নানা প্রান্তে (ফিলিস্তিনের গাজা, ভারতের কাশ্মীর, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, সোমালিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে) ছড়িয়ে থাকা নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের দুঃখ-কষ্ট অনুধাবন করতে চায় না। লকডাউন পরিস্থিতি তাদের মনোজগতে কিছুটা হলেও পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
পরিশেষে বিশ্ব ধনসম্রাট বিল গেটস-এর কিছু কথা দিয়ে শেষ করতে চাই। তার মতে, করোনা আমাদের দেখিয়েছে যে, আমারা সবাই একে অপরের সঙ্গে দারুণভাবে সম্পৃক্ত। জগতের সব কিছুই একটি বন্ধনে আবদ্ধ। সীমান্তরেখাগুলো আসলেই মিথ্যা। তিনি আরও মনে করেন- আমরা যা করি তার জন্যই আমাদেরকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়নি। আমাদের সৃষ্টির আসল কাজ হলো মানুষ মানুষের পাশে থাকা, পাশের মানুষকে রক্ষা করা।

লেখক :
প্রভাষক,হিসাববিজ্ঞান বিভাগ
রাজবাড়ী সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here