ওমর ফারুক শামীম:
ভাবতে পারেন-খালাম্মাদের কাছে অমিও ভিক্ষা চাইছি! হ্যাঁ চাইতেই পারি। এমন দুঃসময়ে ভিক্ষা চাওয়াটা স্বাভাবিক। এতে লজ্জার কিছু নেই। দিন বিশেক আগে এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী আমার জন্য একটি ত্রাণের প্যাকেট নিয়ে এসেছিল। আমি নিতে চাচ্ছিলাম না। সে বলল তাহলে কি করবো? হঠাৎ সে-ই মনে করিয়ে দিলো আমাদের এক সাপোর্ট স্টাফের কথা। দেরি না করে প্যাকেটটি আামাদের সাপোর্ট স্টাফকে ডেকে দিয়ে দিলাম।
এরপরেও কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী জানতে চেয়েছিল ত্রাণের তালিকায় নাম দিবে কি না। না করে দিয়ে বলেছি, পারলে অমুক-তমুকের নাম দাও। তবে অনুমাণ করে বুঝতে পারি- যে হারে তালিকা হয় সে হারে ত্রাণ পৌঁছে না। পরিস্থিতি এমন যে, এসব বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া এখন অনেক দূরহ ব্যাপার।
নিরাপত্তার কারণে আামাদের অফিস সাময়িক বন্ধ। লকডাউনে গৃহবন্দী হয়ে জীবন অতিষ্ঠ। অর্থ-কড়ির কথা তো এখানে বলতেই পারছি না। বললে সুনাম ক্ষুন্ন হবার অভিযোগ যেতে পারে। এত্তসব গ্যাঁড়াকলের বেড়াজালে জীবন আর কুলাতে পারছে না। আজকালের মধ্যে পাওনা না পেলে অলি-গলিতে হেঁটে হেঁটে আমাকেও হাঁকছেড়ে বলতে হবে- খালাম্মারা ভিক্ষা দেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অনেক সহকর্মী ভিক্ষা চাওয়ার অবস্থায় পৌঁছেছে আরো আগে। এখনো ধার-দেনায় চলছেন তারা। আমিও চলছি সেভাবেই। মিথ্যে অহংকারের চেয়ে সত্য বলে ছোট থাকা ভাল মনে করি।
এবার আসি এ গল্পের মূল কথায়।
লকডাউনের সকালটা শুরু হয়-ঝপঝপ, খটখট শব্দ আর ময়লা-ময়লা চিৎকারের আওয়াজে। এরপর ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে ‘ছাই নিবেন ছাই’ অ্যাইই মাছ লাগবেএএ-মাছ-ছোট মাছ। আবার বড় বড় ইলিশের ডাকের পাশাপাশি আছে মুরগিওয়ালার নান্দনিক হাঁক। অ্যাই মুরগীইইইইএহ… মুরগীইইইইএহ…। আবার আছে কাগুইইইজজ, অ্যাই কাগুইইইজজ। মাঝেমধ্যে হাতমাইকে কর্কট আর বেরশিক শব্দে শুনতে হয় পুরোনো মনিটর কম্পিউটারসহ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের প্রয়োজন আর জীবিকার তাগিদে ওরা ফেরি করে চলে নগরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। এরা ফেরিওয়ালা, জীবনের ফেরিওয়ালা। এসবের মাঝে কিছু ভিক্ষুকরাও মাঝেমধ্যে ভিক্ষা চাইতে আসে। এরা পেশাদার ভিক্ষুক। বেশিরভাগই নারী। কেউ পায়, কেউ না পেয়ে চলে যায়।
বাইরের চেঁচামেচি আর অন্দরের গুমোট ভালোলাগা-ভালোবাসা দিয়েই পার করছি লকডাউনের দিন-রাত্রি। এসবের সঙ্গে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। তবে আপনি কি এসবের মধ্যে আরেকটি নতুন সংযোজন দেখেছেন? হয়তো দেখেছেন। আমি বা আমরাও দেখেছি। তারা হলো এক শ্রেণির নতুন ভিক্ষুক। এরা বিবর্ণ চেহারার সুস্থ পুরুষ ভিক্ষুক। লুঙ্গি, জামা অথবা পুরোনো পাঞ্জাবি পরা, মাথায় থাকে গামছা জড়ানো। এরাও জীবনের ফেরিওয়ালা। এরা জীবনটাকেই ফেরি করে চলছে বেঁচে থাকতে। ‘খালাম্মারা ভিক্ষা দিবেন’- খালাম্মারা ভিক্ষা দিবেন’। এক-দুবার বলে এরা ডানে বাঁয়ে ওপরে তাকিয়ে অপেক্ষা করে। এরা ভিক্ষা চেয়ে বেশিসময় অপেক্ষা করে না। চলে যায় অন্যত্র।
গত তিন-চার দিন থেকে ‘খালাম্মারা ভিক্ষা দিবেন’ এই নতুন ডাকটি আমাকে ভাবিয়ে তোলে। এই কৌতুহল থেকে আজ ওদের দেখলাম ওয়াশরুমের ভেন্টিলেটর খুলে। মিনিট পাঁচেকের ব্যবধানে এমন দুজনকে দেখতে পেলাম আমাদের বাসার গলিতে। এরা সুস্থ-সবল, তবে বিবর্ণ চেহারার মানুষ। চোখেমুখে লজ্জাভাব আছে। ভিক্ষা চেয়ে না পেলে ঘ্যান ঘ্যান করে না। দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। এদের ভিক্ষা চাওয়ার চিত্র দেখে আমার ভেতরটা দুমড়ে- মুচড়ে উঠেছে।
আপনারা নিশ্চয়ই জানেন-ওয়াশরুম বড় শান্তির জায়গা। ওখানে বসলে অনেক কঠিন কর্মের প্ল্যানও তৈরি হয়ে যায় মূহুর্তে। নিবিড় ভাবনায় অনেক জটিল সমস্যার সমাধানও খুঁজে পাওয়া যায়।
আজ আমিও ওয়াশরুমে বসে নতুন ভিক্ষুকদের নিয়ে নিবিড় ভাবনায় মুষড়ে পরেছি। কারণ এদের মত পরিস্থিতি হয়ত আমাদের অনেকের জন্য অপেক্ষা করছে। এরা পেশাদার ভিক্ষুক নয়। করোনা পরিস্থিতির শিকার, কর্মহীন বেকার মানুষ। এই মূহুর্তে বেঁচে থাকাই তাঁদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারের হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা এঁদের কাছে পৌছাবে কি না জানি না। বিশ্বব্যাপি চরম খাদ্যমন্দা দেখা দিচ্ছে। আমাদের দেশও বাদ যাবে না এই নাজুক পরিস্থিতি থেকে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা আগাম সতর্কতা দিয়েছে খাদ্যমন্দার। সে পরিস্থিতির শিকার হলে আমি বা আপনিও হতে পারি এমন ভিক্ষুক। তাই আগাম ভিক্ষা চেয়ে রাখলাম-‘খালাম্মারা ভিক্ষা দিবেন – খালাম্মারা ভিক্ষা দিবেন’।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক।