গুলতেকিন খান

রহমান মল্লিক :
গুলতেকিন খান এবং আবরার ফাহাদকে নিয়ে তসলিমা নাসরীনের সাম্প্রতিক বক্তব্যে কিছু না বলে পারলাম না । বিতর্কিত লেখিকা হিসেবে পরিচিত তসলিমা নাসরীন। তবুও তার লেখায় ভালো কোন দিকের উল্লেখ আছে কিনা তা খুঁজে খুঁজে পড়তে মাঝে মাঝে আগ্রহী হই। তার লেখা পড়ে ভাবি এই লেখিকা যদি বেগম রোকেয়ার মতো নারীবাদি হতেন কতই না ভালো হতো । তার সাহিত্য সাধনা দিয়ে দেশ জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন, সেই মেধা তার ছিল। বেগম সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, সেলিনা হোসেনের মতো সম্মানের জায়গা তিনি করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সত্যানুসন্ধানী হবার চেয়ে বিতর্কিত থাকাকেই বেশি পছন্দ করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য সমাজের অনেক গুণী মানুষই তাকে বিকারগ্রস্ত বলে চিহিৃত করেছেন।
যতটা বুঝেছি তসলিমার বিতর্কিত হয়েছেন মূলত ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ করায়। আমার বুঝে আসে না ধর্ম তার চলার পথকে কীভাবে বাধাগ্রস্ত করলো, অন্যদের তো করেনি । ধর্মের গোঁড়ামি তো আমরা কেউই পছন্দ করি না। সে ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার অধিকার তার নিশ্চয়ই রয়েছে। তিনি ধর্ম মানতে চান না, না মানুন কিন্তু কারো ধর্ম বিশ^াস নিয়ে যাচ্ছে তাই বলার অধিকারতো তিনি রাখেন না। শুধু ‘মোল্লাদের’ দোষ দিয়ে লাভ নেই কোনো যুক্তিবাদী মানুষও তার বক্তব্যকে গ্রহণ করেননি। বিজ্ঞান মনস্কতার দোহাই দিয়ে তিনি সত্যের অপলাপ করছেন।
একজন নামাজ কিংবা পুজা না করেও ধর্মের অনেক বিধান মানছেন। ধমের্র বিধান মেনে বিয়ে সাদী করছেন। বিজ্ঞানের কোথাও কি আছে আপন ভাইবোনকে বিয়ে করা যাবে না ? বিজ্ঞান সেটা বলেনি। সেটা বলেছে শুধুই ধর্ম । আর নৈতিকতার মূল উৎসও ধর্ম। প্রতিটি ধর্ম মানুষকে সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের পরামর্শ দেয়। যে ধর্ম মানুষকে পশুত্ব থেকে আলাদা করেছে। সে ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ কিংবা অবজ্ঞা করে ব্যক্তিই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তাতে ধর্মের কিছু আসবে যাবে না। ধর্ম তার চিরন্তনতা ও শাশ^ত আদর্শ নিয়ে টিকে থাকবে।
তসলিমা নাসরীন ধর্ম জানেন না বোঝেন না সেটা বলবনা । বরং ধর্মবিরোধীতাকে তিনি ফ্যাশন হিসেবে নিয়েছেন। পৃথিবীতে এতো এতো ভালো খাবারের উপাদান থাকা সত্তে¡ও কেউ কেউ মাদকাসক্ত। কেউ মাদকাসক্ত হলে সে নিজেই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তসলিমা নাসরীনের ধর্মবিদ্বেষ তাকে এখন কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। তিনি যে এখন অতিমাত্রায় হতাশাগ্রস্ত তা তার সাম্প্রতিক বক্তব্যে বোঝা যায়।
লেখিকা গুলতেকিন খান বিয়ে করায় কেন তার মাথায় কেন আকাশ ভেঙে পড়লো। গুলতেকিন একজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন তাতে তার ক্ষিপ্ত হবার কারণ কি। একজন লেখিকা কী করে এতটা কদর্য ভায়ায় কথা বলতে পারেন। তার রূচিহীনতাকে ধীক্কার না জানিয়ে পারা যায় না। পাঠক তার বক্তব্যকে কষ্ট করে পড়–ন:
‘ফেসবুক হুমায়ুনে টইটম্বুর। হুমায়ুনের বউ বুড়া বয়সে বিয়া করছে, তাতেও হাত্তালির সীমা নাই। আমার বয়সও তার মতই, কিন্তু আমি যদি এখন বিয়া করছি ঘোষণা দেই, আমার চামড়া ছিইল্ল্যা মাইনষে লবণ লাগাইবো,আর আমারে জ্যান্ত কব্বর দিবো, ফেসবুক ভাসাইয়া ফেলবো খাপসা গালি দিয়া, আমারে কুত্তা দিয়া কী করবো কইয়া আর আমার ইনবক্স গান্ধা বানাইবো তাগোর ইয়ের ছবি পাঠাইয়া।’ আরো বলেছেন-বিয়া করাডার নাম নারী স্বাধীনতা না। বরং উল্ডা। বিয়া না কইরা, ত্যাগ না কইরা, মাইনষের করুণার পাত্রী না হইয়া, পরনির্ভর না হইয়া, মাথা উচা কইরা বাচার নাম নারী স্বাধীনতা। ভুইলা গেলে চলবে না বিয়া জিনিস্টাই নারী বিরোধী।’
একজন লেখিকা কি এত নি¤œমানের ভায়ায় বলতে পারেন। আর তাও যদি সেটা যুক্তিসঙ্গত কোনো বিষয় হতো। তসলিমা নাসরীন বিয়ের ঘোষণা দিলে কেন মানুষ তাতে আপত্তি করবে । কেনই বা তার গুষ্টি উদ্ধার করবে। মানুষের কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই । বরং তিনি তো বিয়ের ঘোষণা দিতেই পারবেন না । কারণ বিয়ে একটি ধর্মের ব্যাপার । সে ধর্মতো তিনি মানেন না। যে কোনো একটা ধর্ম মতেই তো তাকে বিয়ে করতে হবে। আগে যে বিয়েগুলো করেছেন তা ভুলে করেছেন। তিনি তখনও অতটা বিজ্ঞানমনষ্ক হয়ে উঠেননি। তিনি বড়জোড় লিভ টুগেদারের ঘোষণা দিতে পারেন। তাছাড়া আফতাব আহমেদের মতো একজন ভদ্রলোককে তিনি কোথায় পাবেন। কোনো সম্ভ্রান্ত মানুষতো তাকে বিয়ে করার ঝুঁকি নেবেন না। কারণ শেষ বয়সে কেউ অপদস্ত হতে চাইবেন না। পূর্বতন স্বামীদের নিয়ে তিনি কি বলেছেন তা কমবেশি সবারই জানা আছে। তার বাবা নাকি তার মাকে কোনদিন ভালোবাসেন নি। এটি তার বইয়ে উল্লেখ করছেন। বাবাকেও অসম্মান করেছেন। গুলতেকিন পেয়ে গেলেন, উনি পাবেন না এই মনোবেদনা থেকেই বিয়ে নিয়ে তার খিস্তিখেউর।
তসলিমার সবচেয়ে নির্মম উক্তি ছিল আবরার ফাহাদকে নিয়ে। ফাহাদের মৃত্যুতে তিনি ব্যথিত নন। তার আপত্তি বুয়েটের ছাত্র কেন নামাজী হবে। তিনি বলেছেন ‘মেধাবী হওয়াটা নিশ্চয়ই গুণ কিন্তু ২১ বছর বয়সে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়াটা তো গুণ নয়, বরং দোষ। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে ব্রহ্মান্ডের উৎপত্তি, বিবর্তনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই! সাত আকাশের ওপর এক সর্বশক্তিমান বসে আছে, সে ছ’দিনে আসমান জমিন বানিয়েছে, আদম হাওয়াকেও মাটি দিয়ে বানিয়েছে, কথা শোনেনি বলে জমিনে ফেলে দিয়েছে, কেউ একজন ডানাওয়ালা ঘোড়ায় চড়ে তাকে এবং তার বানানো স্বর্গ নরক দেখে এসেছে-এসব আজগুবি অবিজ্ঞান আর হাস্যকর গাল গপ্প কোনও বুদ্ধিমান কেউ বিশ্বাস করতে পারে ?’
আবরারের মতো ধার্মিক ও পশ্চাদপদ(তার দৃষ্টিতে) একজন ছাত্রের মৃত্যুতে এমন কোনো ক্ষতি হয়নি। তার ভাবখানা এমন। তিনি কি একবারও ভেবেছেন,আবরারের মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন তার বক্তব্যকে কীভাবে নেবেন। কীভাবে তিনি বলেন, তাকে হত্যার উদ্দেশে পিটানো হয়নি। তাকে হত্যার উদ্দেশে পিটানো না হলেও কি খুনীদের অপরাধের মাত্রা কমে যাবে। বিশ^বিদ্যালয়ের অব্যবস্থাপনা,খুনীদের প্রতি ঘৃণা, ভিসির নির্বিকার ভ‚মিকা নিয়ে তার বক্তব্য নেই। যেখানে ধর্মকে আক্রমন করা যাবে সেখানে তিনি আছেন।
এক সর্বশক্তিমান, আদম হাওয়া কিংবা ডানাওয়ালা ঘোড়ায় তার বিশ^াস নেই, না করুন কিন্তু তসলিমা নাসরীন কি একটা বিষয়ের ব্যাখ্যা দিতে পারবেন? যাদের তিনি মা-বাবা বলে স্বীকার করেন সেটা কীসের ভিত্তিতে করেন। মা কিংবা বাবা ডাকটি যখন প্রথম দিয়েছেন সেটা কেমন করে দিয়েছেন,ওই শিশু বয়সে তার কাছে কি প্রমাণ ছিল। ডাক্তার হবার পরও কি তাদের ডিএনএ টেস্ট করে প্রমানের চেষ্টা করেছেন ? একজন মা ওনাকে পেটে ধারণ করেছেন । কিন্তু উনি কাউকে পেটে ধারণ করবেন না। কারণ মেয়ে হয়ে জন্মেছেন বলে তাকে দশ মাস কেন কষ্ট করতে হবে। এটা যদি পুরুষের ওপর চাপাতে পারতেন তাহলেই না তার শান্তি হতো । অথচ বিশে^র কোটি কোটি নারী মাতৃত্বের জন্য গর্ব অনুভব করে। সন্তানের জন্য সবকিছু বিলিয়ে দেয়।
তসলিমা নাসরীন আসলে তার স্বেচ্ছাচারীতা দিয়ে নিজেই নিজের চতুষ্পার্শে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করেছেন। তাকে বুঝবার মতো আপন জন তার আশে পাশে নেই। মানুষের ভালোবাসা আবেগ অনুভ‚তির কাছে বিজ্ঞানের সূত্র খুব একটা কাজ করে না। বিজ্ঞান কাউকে বিশ^াসী হতে শেখায় না। অথচ মানুষের জীবনটা বিশ^াস আর আনন্দ বেদনা ভালোবাসায় ভরপুর। এটা আসে মূল্যবোধ থেকে। এটা আসে অন্যের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেবার মানসিকতা থেকে। যারা মানুষের ভালোবাসাকে সম্মান দেয় না, পাত্তা দেয় না। এক সময় ভালোবাসবার মতো আর কেউ থাকে না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তসলিমা এই সত্যটি আরো বেশি করে উপলব্ধি করবেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

লেখক : সাংবাদিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here