বিদেশ ডেস্ক: ১৮৬৭ সাল। কানাডা কনফেডারেশন গঠিত হয়েছে। মোট চারটি প্রদেশ যুক্ত হয়ে সৃষ্টি করল ঐতিহাসিক এই অভিযাত্রা। ১৮৭০ সালে এই কনফেডারেশনে ম্যানিটোবার যোগদানের পরের বছর যোগ দিল ব্রিটিশ কলাম্বিয়া। দূর পশ্চিমের এই প্রদেশটি কনফেডারেশনে যোগদানের অন্যতম শর্ত ছিল দশ বছরের মধ্যে নতুন প্রদেশটির সঙ্গে কেন্দ্রের রেলযোগাযোগ তৈরি করে দিতে হবে। ইতিহাসের সত্য এই যে, সেই রেলপথ নির্মাণে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ শ্রমিক ছিলেন চীন দেশ থেকে আগত। ১৮৮০ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যে চীন থেকে এসেছিলেন মোট সতেরো হাজার শ্রমিক। রেলপথ নির্মাণকালে তাঁদের চার হাজার প্রাণ হারান। ১৯৮৯ সালে টরন্টোতে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ওই রেলশ্রমিকদের স্মৃতিতে নির্মাণ করা হয়েছে একটি স্তম্ভ। চীনা অভিবাসীদের অর্থায়নে নির্মিত ওই স্মৃতিস্তম্ভে নিয়মিত ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান নগরবাসী। চীনা রেলশ্রমিকদের অতীতকে নতুন করে জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন যে লেখক তিনি হলেন চীনা বংশোদ্ভূত পল ই -র জন্ম ১৯৫৬।
সেই ইতিহাসকে অনুধাবনের জন্য আমাদের জানা প্রয়োজন কানাডায় রেলের আদ্যোপান্ত। ঘোড়ায় টানা রেলগাড়ি কানাডাতে চালু হয়েছিল ১৭২০-এর দশকে। কানাডিয়ান এনসাইক্লোপিডিয়া বলছে, ১৮২০-এর দশকে, অর্থাৎ ঠিক এক শতক পর, স্টিম ইঞ্জিন চালিত রেল আসে। কিন্তু লোহার চাকার রেলগাড়ি যেটা লোহার পাতের ওপর চলে সেটা আসতে লেগে যায় আরও কিছু বছর। ১৮৩৬ সালের ২১ জুলাই আধুনিক সেই রেল কানাডায় প্রথম চালু হলো মন্ট্রিয়েল শহরে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সেন্ট্রাল কানাডায় রেল নির্মাণ একটি ম্যানিয়ার মতো হয়ে দাঁড়ায়। ছোট ছোট রেলপথ দিয়ে শুরু সেই উদ্যোগে ক্রমে ক্রমে বড় বড় রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প এসে যুক্ত হতে থাকল। এই ম্যানিয়ার প্রধান ফসল হলো নায়াগ্রা জলপ্রপাত থেকে উইনসর অবধি রেলপথ নির্মাণ। তবে কনফেডারেশন-পূববর্তীকালে সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প ছিল গ্রান্ডট্রাঙ্ক রেলওয়ে। মন্ট্রিয়েল থেকে অন্টারিও হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর সঙ্গে সংযোগ সাধন করেছিল ওই রেলপথটি। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এর পরেই এল কনফেডারেশন এল ট্রান্স কন্টিনেন্টাল রেলওয়ের প্রসঙ্গ যেটি কুইবেক-অন্টারিও হয়ে চলে যাবে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া পর্যন্ত। সেই ইন্টারকন্টিনেন্টাল রেলওয়ে নির্মাণ প্রসঙ্গেই একসময় চীনা রেলশ্রমিকদের এ দেশে আগমন।
১৯৬০ সালে প্রকাশিত জি আর স্টিভেনস রচিত ‘কানাডিয়ান ন্যাশনাল রেলওয়েজ: সিক্সটি ইয়ারস অব ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ গ্রন্থের ফরোয়ার্ডের লেখক কানাডিয়ান ন্যাশনাল রেলওয়েজের চেয়ারম্যান ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড গর্ডন লিখেছেন, কানাডায় রাজনীতি ও রেলওয়ে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কখনো রেলওয়ে একটি সরকারকে ধ্বংস করে দিয়েছে, কখনো একটি সরকার একটি রেলওয়েকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
২০১০ সালে দেড় শতাধিক বছর আগের ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার চীনা রেলশ্রমিকদের নিয়ে ‘ব্লাড অ্যান্ড আইরন’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশিত হয়। ১৯৯৬ সালে শিশু ও কিশোরতোষ গ্রন্থের জন্য গভর্নর জেনারেল পুরস্কার পাওয়া পল সে-গ্রন্থে অনেক প্রশ্ন তুলেছেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো চীনাদের এই আত্মদানের কথা কানাডার মানুষ ভুলে গিয়েছিল কেন! এই প্রশ্নের একটি উত্তর হচ্ছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ভ্যাঙ্কুভারে গোল্ডরাশের যে ডামাডোল সৃষ্টি হয়, যে-ডামাডোলে ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে লক্ষাধিক মানুষ সোনার খোঁজে ওই অঞ্চলে সমবেত হয়েছিলেন সেই-গোল্ডরাশ কানাডার মানুষকে তাঁদের দুঃখ ভারাক্রান্ত অতীতকে ভুলিয়ে দিয়েছিল।
ভ্যাঙ্কুভারের চীনা সমাজের অবদান নিয়ে পলের গবেষণা কিন্তু একদিনের নয়। সাস্কাচুয়ানে জন্ম নেওয়া পলের প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা ও ছবির সেই বইয়ের প্রেক্ষাপট ভ্যাঙ্কুভারের চায়নাটাউন। প্রথম বই প্রকাশের তেরো বছরের মাথায় এসে ১৯৯৬ সালে ‘গোস্ট ট্রেইন’ যা তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কারটি এনে দিয়েছিল। ওই বয়সীদের জন্য ক্রমে ক্রমে পল মোট তেইশটি বই রচনা করেন। এরই মধ্যে বড়দের জন্য তাঁর গবেষণাসমৃদ্ধ গ্রন্থও আসতে শুরু হয়। ‘চায়নাটাউন’ (২০০৫) এবং ‘সল্টওয়াটার সিটি: অ্যান ইলাস্ট্রেটেড হিস্ট্রি অব দ্য চাইনিজ ইন ভ্যাঙ্কুভার’ (২০০৬) পল ই-র গবেষণাকর্মের চূড়ান্ত।
‘গোস্ট ট্রেইন’ ছোটদের বই। অলংকরণ করেছেন হার্ভে চান নামের এক শিল্পী। কিন্তু বইটির গল্পে রয়েছে এমন সব উপাদান যা বড়দেরকেও মর্মমূলে স্পর্শ করে বলেই বিশ্বাস। চীনের দক্ষিণাঞ্চলে এক দরিদ্র পরিবারের গল্প নিয়ে এই বই। ওই পরিবারে জন্ম নিল এক মেয়ে—নাম রাখা হলো চুন-ই। চুনের বাবা চুনকে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু ভীষণ দুঃখের যে চুনের একটি হাত ছিল না। একটি যে হাত ছিল সেটি দিয়ে ছোটবেলাতেই সে অসাধারণ আঁকতে পারত। কিন্তু ওই যে দারিদ্র্য—কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। একসময় জানা গেল উত্তর আমেরিকায় পাহাড়ের ভেতর দিয়ে রেলপথ বানাতে শ্রমিক নেওয়া হচ্ছে। সেই পরিবারের বাবাটি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি যাবেন। মেয়ে চুনকে চোখের জলে ভাসিয়ে বাবা চলে গেলেন। একদিন একটা চিঠি আর কিছু টাকা এল চুনের কাছে। আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে নর্থ আমেরিকাতে যাওয়ার জন্য বাবা চিঠি লিখেছেন। বাক্স-পেটরা গুছিয়ে রওনা হলো মেয়ে। পৌঁছাল বাবার কর্মক্ষেত্রে। গেটে পে-মাস্টার সব শুনে চুনকে জানায় আগের সপ্তাহে ওর বাবা মারা গেছেন দুর্ঘটনায়। হাতে তুলে দেয় বাবার শেষ মাসের বেতন। কাঁদতে কাঁদতে চুন এগোতে থাকে চীন-যাওয়ার জাহাজঘাটের দিকে। যে-রাতে জাহাজ ছাড়বে, তার আগের রাতে বাবাকে ও স্বপ্নে দেখে। স্বপ্নে বাবা যেন ওকে বলে, ‘মাগো, আমাকে একটা ট্রেন এঁকে দেখাও তো সোনা।’ মেয়ের যাত্রা গেল বন্ধ হয়ে। ঘুম থেকে উঠেই শুরু করল ট্রেনের ছবি আঁকা। কিন্তু সে কি যা-তা কাজ! কঠিন সে-কাজে ওর পাশে যেন এসে দাঁড়ালেন চুনের ‘বা’ (বাবা) বা তাঁর প্রতিচ্ছায়া। শেষ হলে চুন দেখল ট্রেনের প্রতিটি কামরার জানালায় যে মুখ দেখা যায় ওটা আসলে ওর বাবার মুখ।
হৃদয়স্পর্শী এই গল্প দিয়েই পল ই-র জয়যাত্রা শুরু। বিজয়ের এই সূচনা দিয়েই তিনি যেন নিজের কমিউনিটিকে, কমিউনিটির অতীতকে, কমিউনিটির ইতিহাসকে আরও সুচারুভাবে তুলে আনতে বদ্ধপরিকর হলেন। কানাডার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা চীনাদের ইতিহাস, কর্মকাণ্ড এবং সম্ভাবনাকে লিপিবদ্ধ করলেন। প্রকাশিত হলো ‘চায়নাটাউন’। ভিক্টোরিয়া, ভ্যাঙ্কুভার, ক্যালগেরি, উইনিপেগ, টরন্টো, অটোয়া, মন্ট্রিয়েল ও হ্যালিফ্যাক্সের চীনাদের নিয়ে রচিত পলের এই বই। পরের বছর অর্থাৎ ২০০৬ সালে শুধু ভ্যাঙ্কুভারের চীনাদের নিয়ে তিনি প্রকাশ করলেন আরও বড় কলেবরের ‘সল্টওয়াটার সিটি’। দুটি বইতেই পলের গবেষণা যে-কোনো পাঠককে মুগ্ধ করবে। কী-গভীর নিষ্ঠায় পল যে তাঁর জাতিগোষ্ঠীর অতীতকে নিয়ে খুঁজেছেন তা রীতিমতো বিস্ময়কর। পত্রিকার ক্লিপিং, বইপত্র, পোস্টার, চিঠি, সরকারি দলিল সবকিছুকেই পল প্রয়োজনমতো ব্যবহার করেছেন। তুলে দিয়েছেন পাঠকের হাতে।
কিশোর-বয়সীদের জন্য পলের শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘ব্লাড অ্যান্ড আইরন’। বইটির সাবটাইটেল হলো: বিল্ডিং দ্য রেলওয়ে। স্কলাসটিক কানাডা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এই বইটি ‘আই অ্যাম কানাডা’ সিরিজের একটি। সিরিজটি পরিকল্পিত হয়েছে কানাডার ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাকে উপন্যাসের ভেতর দিয়ে ৯ থেকে ১২ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের জানানোর প্রত্যয়ে। ২০১০ সালে যখন এই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়, প্রথম বছরে যে দুটি বই প্রকাশিত হয়েছিল তার একটির রচয়িতা পল। এখন পর্যন্ত মোট তেরোটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে এই প্রকল্পের অধীনে।
‘আই অ্যাম কানাডা’ সিরিজের অন্যান্য উপন্যাসের মতো ‘ব্লাড অ্যান্ড আইরন’ও কল্পিত এক দিনলিপির ভঙ্গিতে লেখা। দিনলিপির লেখক চৌদ্দ বছর বয়সী হীন গঙ। দিনলিপি লেখা শুরু হয়েছে ১৮৮২ সালের ১৩ মার্চ। শুরু জায়গাটি হলো চিনের গুয়ানডঙ প্রদেশ। চীন থেকে বাবার সঙ্গে হীনকে কানাডায় আসতে হয়েছে রেলপথ বানানোর কাজে। পাহার কেটে রেল বানানোর এক কঠিন কাজে ওদের সংযুক্তি। সব সময় জীবন যেন হাতের মুঠোয়। এর সঙ্গে রয়েছে অন্য জ্বালাও। হীনের বাবার আবার রয়েছে বদঅভ্যাস—জুয়া খেলে কষ্ট করে আয় করা টাকাগুলো ধ্বংস করে। অন্যদিকে বাড়ি থেকে চিঠি আসে মায়ের—সংসারের টানাপোড়েন নিয়ে চিঠি।
এ কথা সত্য হীনের দিনলিপি কল্পিত। কিন্তু এটাও সত্য সে-গল্প দেড় শতাব্দী আগে ভ্যাঙ্কুভারে আসা এক কিশোরের লিখে যাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই রচিত। লেখক পল সে-কথা জানিয়েছেন বইয়ের শেষে—এপিলগে। সৌভাগ্য এই যে পরিবারে থেকে যাওয়া সে-তথ্য হীনের প্রপৌত্র সংরক্ষণ করেছেন যার ওপর ভিত্তি করে পল ই তাঁর উপন্যাসটি দাঁড় করিয়েছেন।
কানাডা অভিবাসীদের দেশ। ফরাসিরা বাসা গেড়েছিল আদিবাসীদের সরিয়ে। ফরাসিদের সরিয়ে ইংরেজরা দেশটি দখল করে। পরে এসেছে আরও বহু দেশের মানুষ। পরে যারা এসেছে তাদের দরকার হয়নি অন্যদের সরিয়ে দেওয়ার। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, এ দেশকে গড়ার কাজে সবাই অবদান রাখলেও নতুন অভিবাসীরা বৈষম্যের শিকারও কম হননি একসময়। কানাডায় যুগান্তকারী রেলযোগাযোগ তৈরিতে যাঁরা ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন তারা হলেন চীনা বংশোদ্ভূতরা। ১৭৮৮ সাল থেকে সুদূর চীন দেশ থেকে কানাডার উদ্দেশে মানুষ আসতে শুরু করেন। ১৮৫৮ সালে প্রথমবারের মতো আসেন বিশাল এক দল। শুধু রেলপথ নির্মাণের কাজে যুক্ত ছিলেন সতেরো হাজারের বেশি চৈনিক। দৈনিক মাথাপিছু ১ ডলার পারিশ্রমিকের ওই শ্রমিকদের ওপর ১৮৮৫ সালে রেলপথ নির্মাণের কাজ শেষ হতেই নেমে আসে নিপীড়নের খড়্গ। প্রতিজন চীনা অভিবাসীকে মাথাপিছু ৫০ ডলার ট্যাক্স ধার্য করা হয়। সেটি বাড়তে বাড়তে ১৯০৩ সালে পাঁচ শ ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়।
কানাডায় চীনাদের অবদানের কথা এখানকার মানুষ ভুলে গিয়েছিলেন। শতাব্দী পূর্বে চীনাদের ওপর করা নির্যাতনের কথাও তাঁদের স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছিল। পূর্বপুরুষের অতীতকে গবেষণা ও রচনার ভেতর দিয়ে যে নিবেদিতপ্রাণ লেখক সবার সামনে তুলে এনেছেন তিনি পল ই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here