আবুল আহসান চৌধুরী
ছেলেবেলায় শিশুতোষ রচনার ছন্দে যাঁরা মন কেড়েছিলেন, সেই মদনমোহন, রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুলের পাশাপাশি আর-একটি নাম খুব মনে পড়ে, তিনি জসীমউদ্দীন। গ্রামীণ জীবনের এক মোহময় মায়াবী আবহ রচনা করে এই কবি শিশুমনে এক অপূর্ব সম্মোহন জাগিয়েছিলেন। তাই তাঁর সম্পর্কে কৌতূহল ও অনুরাগ জেগেছিল সেই অতি-দূর শৈশবেই।
শুনেছিলাম কুষ্টিয়ার সঙ্গে কবি জসীমউদ্দীনের একটা অন্তরঙ্গ যোগ ছিল। বেশ অনেকবারই তিনি এখানে এসেছেন। তখনও দেশভাগ হয়নি, সেই সময় থেকেই এই অঞ্চলে তাঁর আনাগোনা। সেই সুবাদে এক- দুইবার আমাদের বাড়িতেও নাকি এসেছেন। কবি ছিলেন লোকসংস্কৃতির একান্ত অনুরাগী। তাঁর কবিতা ও গানে এই অনুরাগের ছোঁয়া আছে স্পষ্টই। একসময়ে তাঁর গুরু ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেনের কল্যাণে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে গীতিকা-সংগ্রাহকের দায়িত্ব পান। পাশাপাশি তিনি বাউল-মুর্শিদি-জারি-রাখালি এইসব লোকগান সংগ্রহেও মন দেন। অবশ্য এই লোকগান সংগ্রহ ছিল তাঁর নিজেরই আগ্রহ ও প্রয়োজনে। পরে তিনি এই সংগ্রহ নিয়ে বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর মুর্শিদি গানের আলোচনা প্রকাশিত হয় ‘কল্লোল’ পত্রিকায়। পরে বই হয়ে বের হয়। বাউল বিষয়েও একটি বই প্রকাশ পায় তাঁর মৃত্যুর পরে।
এই লোকগান সংগ্রহ, সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও কখনও নিছক বন্ধু-স্বজনের সান্নিধ্য কিংবা বেড়ানোর উদ্দেশ্যেও কুষ্টিয়ায় এসেছেন। কবি ছিলেন বাউলগান, বিশেষ করে লালনের গানের খুবই ভক্ত। লালনচর্চার সেই আদিযুগে তিনি ‘বঙ্গবাণী’ (শ্রাবণ ১৩৩৩) পত্রিকায় লালনকে নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এই লেখার মাল-মসলা সংগ্রহের জন্য তিনি কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় এসেছিলেন, সে-কথা প্রবন্ধেই উল্লেখ করেছেন। ছেঁউড়িয়া ও কুষ্টিয়ার নানা অঞ্চল থেকে তিনি লালন সাঁইয়ের অনেক গান সংগ্রহ করেছিলেন।
কুষ্টিয়ায় কবি জসীমউদ্দীনের খুব ঘনিষ্ঠজন ছিলেন নট-নাট্যকার-কবি মহম্মদ নেজামতুল্লাহ। ‘শহীদ সেরাজ’ নামে নাটক লিখে খুব নাম করেছিলেন। তাঁর অনেক কবিতা সেকালের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। পরে ‘মাতবর ভাই’ নামে ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘বুনিয়াদি গণতন্ত্রের আসর’ পরিচালনা করে তাঁর পরিচিতি আরও বেড়েছিল। ‘মুখ ও মুখোশ’-সহ আরও অনেক চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছিলেন। নেজামতুল্লাহ তখনকার কুষ্টিয়ার তরুণ লিখিয়েদের ছিলেন গুরুস্থানীয় পরামর্শক ও প্রেরণাদাতা। আবুল হোসেন, গোলাম কুদ্দুস, আজিজুর রহমান উত্তরকালে খ্যাত এই তিন কবি নেজামতুল্লাহর কাছে বিশেষ ঋণী।
জসীমউদ্দীন কুষ্টিয়ায় এলে এই নেজামতুল্লাহরই আমলাপাড়ার বাড়িতে উঠতেন। কবি আবুল হোসেন তাঁর এক স্মৃতিচর্চায় উল্লেখ করেছেন, ‘বলতে দ্বিধা নেই, নেজামতুল্লাহর কাছেই ছন্দে আমার হাতেখড়ি। তাঁদের বাড়িতেই গোলাম মোস্তফা ও জসীমউদ্দীনের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ’ (প্রথম আলো, ঈদসংখ্যা ২০০২, পৃ. ৫০)। জসীমউদ্দীনকে ঘিরে তুমুল আড্ডা জমে উঠত নেজামতুল্লাহদের পৈতৃক প্রতিষ্ঠান ‘আসমতুল্লাহ লাইব্রেরি’তে।
কুষ্টিয়ায় জসীমউদ্দীনের বিশেষ অনুরাগী বন্ধু ছিলেন খান সাহেব হারুনুর রশীদ, রেজওয়ান আলী খান চৌধুরী, গোলাম রহমান, কবি আজিজুর রহমান, ফজলুল বারি চৌধুরী ও আরও কেউ কেউ। কুষ্টিয়ায় এলে আমার পিতা ফজলুল বারি চৌধুরীর আমন্ত্রণে জসীমউদ্দীন আমাদের বাড়িতে এসেছেন কখনও কখনও। সে অবশ্য আমার জন্মের অনেক আগের কথা। এ ছাড়া আমাদের নিকট-আত্মীয় কারও কারও সঙ্গেও জসীমউদ্দীনের ছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, যেমন আমার মাতুল ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন এবং আর-এক আত্মীয় ‘মোয়াজ্জিন’ পত্রিকার সম্পাদক ফরিদপুরের সৈয়দ আবদুর রবের নাম করা যেতে পারে এ প্রসঙ্গে। এভাবে অন্যের স্মৃতি-শ্রুতির ভেতর দিয়ে জসীমউদ্দীন আমার না-দেখা চেনা মানুষ হয়ে উঠেছিলেন অনেকখানি।
কবি জসীমউদ্দীনকে প্রথম দেখি ১৯৬৭ সালের ২৫ নভেম্বর আমার দ্বিতীয়বার ঢাকা সফরের সময়ে। কুষ্টিয়া থেকে আমার এক বন্ধু ও আমি ঐ দিনই সন্ধ্যায় ঢাকা পৌঁছাই। তখন অটোগ্রাফ-শিকারের নেশা ছিল প্রবল। রাত ৯টা নাগাদ দুই বন্ধু কমলাপুরে কবির বাড়িতে গিয়ে হাজির। অসময় হলেও কবি খুব আন্তরিকভাবে তাঁর এই খুদে অতিথি দু’জনকে সাদরে বরণ করে নিলেন। নামধাম-পরিচয়-উদ্দেশ্য সব জানলেন। তারপর ভেতরে গিয়ে নিজের হাতে আমাদের জন্য নিয়ে এলেন মুড়ি আর নারকেলের নাড়ু। খাওয়া শেষ করে তাঁর সামনে মেলে ধরলাম অটোগ্রাফের খাতা। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে খস্খস্ করে লিখে চললেন খাতায়। মুহূর্তে তৈরি হয়ে গেল আট পঙ্ক্তির একটি চমৎকার কবিতা। লেখা শেষ করে নিজেই পড়ে শোনালেন :
গহন রাতের পথিক তুমি
এমন সময় এলে
যখন পাখি গানের কুসুম
আকাশ পটে ফেলে;
বাসায় বসি নিশিঘুমের
করছে আয়োজন,
কি যে তোমায় দেব বন্ধু
রিক্ত দেহমন।
‘গহন রাতের পথিক’-এর মনটা আনন্দ, বিস্ময়, মুগ্ধতা আর প্রাপ্তির মিশ্র এক অনুভূতিতে ভরে গেল। কবির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় সস্নেহে হাসিমাখা মুখে আবার আসতে বললেন। এক অপার্থিব প্রাপ্তির আনন্দে অন্তর আপ্লুত হয়ে রইল।
এর বছরখানেক পরে কবির সঙ্গে আবার দেখা হয়। তাঁর নিজের একটি সাহিত্য-সংগঠন ছিল ‘সাহিত্য-সাধনা-সংঘ’ নামে। তাঁর বাড়িতে প্রতি সপ্তাহেই সাহিত্যবাসর হতো এই সংগঠনের তরফ থেকে। আমার ভাই আবদুর রশীদ চৌধুরী তখন ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র। তিনি ছিলেন এই সাহিত্যবাসরের প্রায় নিয়মিত সদস্য। তাঁর সঙ্গে একদিন সাহিত্যবাসরে গেলাম। প্রবীণ-নবীন সব বয়সী অনেক লেখকই সেখানে উপস্থিত। কবিকে প্রথম সাক্ষাতের কথা জানালে তিনি আমাকে স্মরণ করতে পারলেন।
প্রায় চার বছর বাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাই, ভর্তি হই বাংলা বিভাগে। কবি জসীমউদ্দীনের খুব প্রিয়জন ছিলেন আমার এক বন্ধু আমিনুল ইসলাম, ‘সাহিত্য-সাধনা-সংঘে’র সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তিনি এক দিন সাহিত্যবাসরে নিয়ে গেলেন। নতুন করে আবার পরিচয় হলো কবির সঙ্গে। এরপর থেকে প্রায় নিয়মিতই সাহিত্যবাসরে উপস্থিত থাকতাম। কবিতা কিংবা প্রবন্ধ পড়তাম, পঠিত লেখার ওপরে কখনও কখনও হয়তো আলোচনাতেও শরিক হতাম। এক সাহিত্যবাসরে ‘রবীন্দ্রনাথ ও লালন সাঁই’ এই বিষয়ে একটি প্রবন্ধ পড়ি। কবি এই প্রবন্ধের দীর্ঘ আলোচনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পরও অনিয়মিত সাহিত্যবাসর হতো মাঝেমধ্যে। আমার বন্ধু ‘কাশবন’ পত্রিকার সম্পাদক আমিনুল ইসলামের প্রস্তাবে সাহিত্য-সাধনা-সংঘের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হই। আমিনুল ইসলাম মূলত সাংগঠনিক বিষয়টি দেখাশোনা করতেন, আমারও যোগ থাকত তাতে। পরে ‘কবি জসীমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার সংসদে’র সদস্য হিসেবেও কাজ করি।
এক পর্যায়ে কবির খুব কাছাকাছি আসার সুযোগ ঘটে। সাহিত্যবাসর ছাড়াও মাঝেমধ্যে কবির সঙ্গে দেখা করতে যেতাম এবং লেখা কপি কিংবা প্রেসে যাওয়া- তাঁর ছোটখাটো ফাইফরমাশ খাটতাম। এক দিন যেতে বললেন তাঁর বইপত্তর গোছানোর জন্য। তাঁর সংগ্রহের গল্প শুনেছি অনেকের মুখে। এই সুযোগে তাই তাঁর বইয়ের সংগ্রহ দেখার লোভেই মূলত এক সকালে তাঁর বাড়িতে হাজির হলাম। অনেক দুষ্প্রাপ্য বইপুস্তক ও কাগজপত্র এলোমেলো অবহেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। তাঁকে নানান জনের উপহার দেওয়া বইও সেখানে দেখলাম। অনেকটা সময় ধরে মোটামুটি বইগুলো গোছানো হয়। তিনি খুশি হয়ে আমাকে একটি পুস্তিকা উপহার দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপিকা Miss. A. G. Stock সম্ভবত কবির অনুরোধেই বিদেশিদের জন্য তাঁর ওপরে ‘Jasim uddin, Poet of the Bangladesh countryside’ নামে এই পুস্তিকাটি রচনা করেন ইংরেজিতে। কবি জসীমউদ্দীনের জীবন ও সাহিত্যের পরিচিতির চুম্বক এই পুস্তিকাটি। এই সংক্ষিপ্ত অথচ মূল্যবান পুস্তিকাটির কোনো উল্লেখ কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
তাঁর অফুরান স্নেহ-প্রীতি-ভালোবাসা পেয়েছি। সেইসঙ্গে কমবেশি প্রশ্রয়ও। তাই কখনও কখনও অসংগত আবদার ও অনুচিত অনুরোধও উপেক্ষা করেননি, হাসিমুখে তা রক্ষা করেছেন। যেমন- আমাদের খুব কাছের একজন প্রিয় মানুষ ছিলেন মিজানুর রহমান, এখন আর তিনি বেঁচে নেই। পেশায় ছিলেন কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা ও পরে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক, নেশা ছিল কবিতা লেখার। তাঁর অনুরোধে কবি জসীমউদ্দীনকে ধরি তাঁর ‘রুবাইয়াৎ-ই-মিজান’ বইয়ের একটি ভূমিকা লিখে দেওয়ার জন্য। ভেবেছিলাম বিরক্ত হবেন, গালমন্দ করে ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু না, প্রসন্ন মনেই কবুল করলেন। তারপর কবিতাগুলো পড়ে শোনাতে বললেন। খুব মন দিয়ে শুনলেন। দু’এক জায়গায় আবার পড়তে বললেন। তারপর উনি বলতে থাকলেন, আর আমি লিখে নিলাম। প্রায় ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় মোটামুটি বেশ বড়ই একটি ‘ভূমিকা’ লেখা হয়ে গেল। নিচে সই করে দিয়ে শিশুর সারল্য নিয়ে মুখের দিকে তাকালেন। যেন সংকোচের সঙ্গে বলতে চান ‘চলবে তো?’
বার-তিনেক তাঁকে বেশ উত্তেজিত হতে দেখেছি। একবার সাহিত্য-সাধনা-সংঘের সাহিত্যবাসরে শিল্পী কাজী আবুল কাশেম একজন খঞ্জকে নিয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক গল্প পড়েন। কবি খুব রুষ্ট হন। স্পষ্টই তিনি বলেন, যারা শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী তাঁদের নিয়ে ব্যঙ্গ-কৌতুক করা অশোভন ও অমানবিক। যতদূর মনে পড়ে সত্তরের দশকের প্রথম দিকে সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’তে ধারাবাহিক তাঁর আত্মকথা বের হচ্ছিল। কোনো এক কিস্তিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘নিশীথে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা’ এই মরমি গানটি তাঁরই লেখা। কিন্তু কেউ কেউ এর প্রতিবাদ জানিয়ে ‘চিত্রালী’তে লেখেন, গানটির রচয়িতা মরমি কবি শেক ভানু। পদকর্তা-বিষয়ক বিতর্কটি কয়েক সংখ্যা ধরে চলে। এতে তিনি বেশ ক্ষুণ্ণ হন। ঘরোয়া আলাপে তিনি এই বিতর্ক উস্কে দেওয়ার জন্য একজন প্রবীণ লোকসংস্কৃতি-গবেষক দায়ী বলে ক্ষোভ জানান। আর একটি ঘটনার উল্লেখ পরে করছি।
লালন সাঁইয়ের দ্বিশতজন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ১৯৭৪ সালে আমার সম্পাদিত ‘লালন স্মারকগ্রন্থ’ বইটি প্রকাশ করে। গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক কথাশিল্পী সরদার জয়েনউদ্দীন ও সহকারী পরিচালক কবি কায়সুল হকের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনাতেই বইটির প্রকাশ সম্ভব হয়। গ্রন্থকেন্দ্র ৫ ডিসেম্বর ১৯৭৪ লালনের দ্বিশতজন্মবার্ষিকী উদ্?যাপন ও সেইসঙ্গে বইটির একটি প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করে কেন্দ্রের নিচের খোলা চত্বরে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কবি জসীমউদ্দীন আর প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন। আলোচক দুইজন- ডক্টর আহমদ শরীফ ও আমি। বিশিষ্ট শ্রোতা হিসেবে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে কথাশিল্পী আবু জাফর শামসুদ্দীন ও কবি শামসুর রাহমানের নাম মনে পড়ে। কথাশিল্পী শওকত ওসমান পরে এসেছিলেন কিনা ঠিক মনে করতে পারছি না। শামসুর রাহমান তখন দৈনিক বাংলায় কাজ করেন। অনুষ্ঠান সম্পর্কে তিনি ‘মৈনাক’ নামে যে কলাম লিখতেন তাতে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী আলোচনা করেছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষে লালনের গানের একটি আসর হয় মকসেদ আলী সাঁইয়ের পরিচালনায়। তো এই অনুষ্ঠানে ডক্টর আহমদ শরীফ আলোচনার এক পর্যায়ে লোকসংস্কৃতিকে পিছিয়ে পড়া সমাজের আর অমার্জিত-অনক্ষর মানুষের সংস্কৃতি বলে মন্তব্য করেন। তাঁর এই বক্তব্য সম্পর্কে কবি জসীমউদ্দীনের প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই তীব্র। অধ্যাপক মনসুরউদ্দীনও প্রতিবাদ জানান।
ঢাকা শহরের নাগরিক আবহে জসীমউদ্দীনকে মনে হয়েছে যেন একটি বৃন্তচ্যুত বনফুল। তাঁর মন-মনন-চিন্তা-চেতনা-স্মৃতিজুড়ে ছিল গ্রামীণ বাংলার রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধের আবহ। আলাপচারিতায় স্মৃতির ধূসর পথ ধরে বারবার চলে যেতেন সানাল শাহ ফকিরের আস্তানায়, নটাখোলার পদ্মার ‘মরাগাংদীর নৌকাবাইচের পাল্লায়, ফকির মেছের শাহের মরমি গানের বাসরে, নমঃদের রাখালি বাঁশির সুরের উৎস নদীপাড়ের বটের তলায়, অম্বিকাপুরের গাছগাছালির ছায়ায় ঘেরা ছোট্ট কুঁড়েঘরের নিকানো উঠোনে।
এক দিন তাঁর স্নেহ পেয়ে ধন্য হয়েছিলাম। তাঁর মতো মরমি ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যের স্মৃতি এখনও মনকে উতলা করে তোলে। অন্তরে বাজে বাউলের দীর্ঘশ্বাস- ‘কোথায় পাব তারে’। তাঁর লেখা একটি গ্রাম্য গানের স্মৃতিজাগানিয়া কয়েকটি পঙ্ক্তি সাজিয়েই তাঁকে নিবেদন করি অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা :
ও মোরে কান্দালি তুই মনের মত,
দেশ-বিদেশে তোর তালাসে
আর আমি ঘুরিব কত।
দেখে যাও হে কমল-আঁখি
এ প্রাণের কি আছে বাকি
পূর্ব কথা থাকি থাকি
মোরে দিনে দিনে করছে হত।