মাহফুজুর রহমান মানিক
সোমবার প্রকাশিত মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় প্রকাশিত ফলে আমরা দেখছি, এবার জিপিএ ৫ বা সর্বোচ্চ ফলধারী বেড়েছে। এ বছর জিপিএ ৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন। গত বছর পেয়েছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার শিক্ষার্থী। এ বছর অবশ্য গড় পাসের হার গত বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। জিপিএ ৫-এর ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে ভালো লক্ষণ। কিন্তু এ বিষয়টি সমাজে যেভাবে ব্যবহার হচ্ছে, সেটি ভালো লক্ষণ নয়। জিপিএ ৫ নিয়ে একটা চতুর্মুখী লড়াই আমরা দেখছি।
প্রথম লড়াই শিক্ষার্থীদের মধ্যে। শিক্ষার্থীদের পরস্পরের মধ্যে জিপিএ ৫ তথা ভালো ফলের প্রতিযোগিতা ইতিবাচক। সবাই যদি এ লক্ষ্যে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষার খাতায় সঠিক উত্তর করতে পারে, তাতে সবার আগে শিক্ষার্থীই লাভবান হবে। এটি দোষেন নয়।
দ্বিতীয় লড়াই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে। জিপিএ ৫ পাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি লড়াই লক্ষণীয়। ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খেতাব পাওয়া এবং পরে শিক্ষার্থী ধরার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যকার এ প্রতিযোগিতাও খারাপভাবে নেওয়ার কিছু নেই। যদি শিক্ষকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুনামের লক্ষ্যে পরীক্ষায় ভালো ফলের জন্য শ্রেণিকক্ষে সঠিকভাবে পাঠদান করেন এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার আগ্রহ তৈরি করতে পারেন, নিঃসন্দেহে তা ভালো। কিন্তু এখানে বিপদ হলো, শিক্ষক কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানকে দমানোর চিন্তা করে? সবাই এগিয়ে যাক, এই মনোভাব গ্রহণযোগ্য। কিন্তু আমিই সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবো- এ চিন্তা থাকলে অন্য প্রতিষ্ঠানকে দমানোর জন্য অসদুপায় অবলম্বনের আশঙ্কা থাকে।
তৃতীয় লড়াই অভিভাবকদের মধ্যে। জিপিএ ৫ এখন অনেকের কাছে সামাজিক ‘স্ট্যাটাস’-এর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে কারণে অভিভাবকরা চান, যেভাবেই হোক তাঁর সন্তানকে সর্বোচ্চ ফল পেতে হবে। জোর করে চাওয়ার ফলে অনেক সময় পরীক্ষার্থী চাপের মধ্যে থাকে। এবারের ফলেও আমরা দেখছি, যারা জিপিএ ৫ পেয়েছে প্রধানত তাদের অভিভাবক সন্তানের প্রশংসা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি দিচ্ছেন কিংবা খবর জানাচ্ছেন। অন্যরাও তাঁদের অভিনন্দনের সাগরে ভাসাচ্ছেন। বাকি যাঁদের সন্তান জিপিএ ৫ পায়নি, তাঁরা সে খবরটি দিতে আগ্রহ বোধ করেন না। উল্টো সেসব অভিভাবক এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগেন এবং তাঁর ক্ষোভ সন্তানের ওপর ঝাড়েন। এখানে বিপদ হলো, সন্তান বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারে না। সে জন্য অঘটন ঘটিয়ে বসে। সোমবারই খবরে আমরা দেখেছি, ময়মনসিংহে এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। কারণ, তার মা জিপিএ ৫ না পাওয়ায় তাকে বকঝকা করেছেন।
চতুর্থ লড়াই প্রশাসনের মধ্যে। জিপিএ ৫ কিংবা পাসের হার যাতে না কমে, এ ব্যাপারে প্রশাসনের মধ্যেও লড়াই চলে। ক্ষমতাসীন সরকার চায় যাতে আগের সরকারের তুলনায় জিপিএ ৫ না কমে। সে জন্য পরীক্ষকদের প্রতি নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার অলিখিত নির্দেশনার কথাও প্রচলিত। আবার আন্তঃবোর্ডের মধ্যেও জিপিএ ৫ কিংবা পাসের হার নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকে। এমনকি সামষ্টিকভাবে এ বছর যেমন ফল হলো, পরের বছর যেন তার চেয়ে জিপিএ ৫ না কমে কিংবা পাসের হার পড়ে না যায়, সেটিও দেখা হয়। দিন দিন উন্নতির প্রত্যাশা অবশ্যই ভালো। কিন্তু সেখানে হস্তক্ষেপ করার বিপদ অনেক। কোনো শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পাওয়ার যোগ্য না হলেও বোর্ডের নির্দেশনার কারণে শিক্ষক যদি তার নম্বর বাড়িয়ে দেন, সেটি যেমন অন্যায্য, তেমনি শিক্ষাব্যবস্থারও বিপদ ডেকে আনতে পারে। ইতোপূর্বে জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মান নিয়ে যে বিস্তর অভিযোগ উঠেছে, তা প্রত্যাশিত নয়।
শিক্ষার্থী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা শিক্ষক, অভিভাবক ও প্রশাসন- ফলের সঙ্গে সরাসরি জড়িত এ চার অংশীজন সবাই ভালো ফল এবং সর্বোচ্চ ফল জিপিএ ৫-এর প্রত্যাশা করবে- এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু এ নিয়ে যখনই আমরা প্রতিযোগিতা করছি, তখনই বিপদ ডেকে আনছি। বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে সেটিই দেখা যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক পরীক্ষার্থীই গুরুত্বপূর্ণ। যে গ্রেড পেয়েই শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হোক, তাকে যেমন অভিনন্দন জানানো প্রয়োজন, তেমনি যারা উত্তীর্ণ হয়নি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে, সমস্যার আলোকে সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তাতে পাবলিক পরীক্ষার ফল অন্তত কারও আত্মহননের কারণ হবে না।
মাহফুজুর রহমান মানিক :জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক, সমকাল
mahfuz.manik@gmail.com