আবদুর রহমান মল্লিক
সচেতন যে কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয় বর্তমানে আমাদের জাতীয় সমস্যা কী? তিনি তাৎক্ষণিক জবাব দেবেন-‘দুর্নীতি’। দুর্নীতি সারাদেশে যেভাবে পত্রপল্লবে বিকশিত হয়েছে তাতে দুর্নীতিই যেন নীতি হয়ে দাঁড়িযেছে। অবস্থা এমন হয়েছে কেউ কেউ বিশ^াসই করতে চাননা সমাজে সৎ মানুষ আছে। তাদের মতে যাদের আমরা সৎ মানুষ বলি তারা নাকি সুযোগের অভাবে সৎ রয়ে গেছেন। সবাই হয়তো এ যুক্তি মানবেন না। কিন্তু এধরনের মতামত সমাজে দুর্নীতির ভয়াবহতাই তুলে ধরে। দুর্নীতি যে কতভাবে হতে পারে সেটার একটু বিশ্লেষণ না হলে এর ব্যাপকতা বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে ।
দুর্নীতি আসলে কী? দুর্নীতির ইংরেজি প্রতিশব্দ শব্দ Corruption| জ্ঞানীরা বলেছেন, দার্শনিক, ধর্মতাত্বিক, নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোন আদর্শের নৈতিক বা আধ্যাত্মিক অসাধুতা বা বিচ্যুতিকে বলা হয় দুর্নীতি। বৃহদার্থে ঘুষ প্রদান, সম্পত্তির আত্মসাৎ এবং সরকারি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করাও দুর্নীতির অন্তভ‚ক্ত। দুর্নীতি সম্ভবত সৃষ্টির শুরু থেকে আছে, সকল কালে, সকল যুগে ছিল। কিন্তু তা যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন তা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়ায়। যারা দেশ বা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত কিংবা রাষ্ট্রকর্তৃক দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত তারা যদি দুর্নীতি কিংবা অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হন তখন রাষ্ট্র দিন দিন গভীর সংকটে নিপতিত হয়। এর ভয়াবহ প্রভাব তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি বর্তমানে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। অর্থনীতিবিদ, সমাজচিন্তক, এমনকি সাধারণ মানুষও দুর্নীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত।
মন্ত্রণালয়ের কোনো সচিবের নাম শুনলে মনে শ্রদ্ধা আসে। কারণ বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে ওই পদে সমাসীন হন। তারা যদি ভুয়া সনদধারী হন তখন বিস্ময়ের কি কোনো সীমা থাকে? সে সনদ যদি হয় মুক্তিযোদ্ধা সনদ, তখন চক্ষু চরকগাছ না হয়ে পারে না। দেশটা এতটাা ঘটনাবহুল যে কে কয়টা মনে রাখে। ভুয়া সনদ গ্রহনের মতো মারাত্মক অপরাধের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন এক যুগ্ম-সচিবসহ পাঁচ জন সচিব। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ থাকলে কেউ কি একাজ করতে পারে? কিন্তু থোড়াই কেয়ার করে বেমালুম করে দেখালেন তারা। তাদের একজন মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব, বর্তমানে প্রাইভেটারাইজেশন কমিশনের সচিব। বুকের কত্তবড় পাটা প্রধানমন্ত্রীর আশেপাশে থেকে একাজ করেছেন। শুধু তাই নয় ধরা পরার পর যখন তার সনদ স্থগিত হয় তখন স্থগিতের বিরুদ্ধে আপিলও করেছিলেন। যদিও সে আপিল গৃহীত হয়নি। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়েছিলেন তৎকালীন স্বাস্থ্য সচিব এম নিয়াজ উদ্দিন মিয়া, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) তৎকালীন সচিব এ কে এম আমির হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী (বর্তমানে ওএসডি) এবং একই মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (ওএসডি) আবুল কাসেম তালুকদার। তাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করে গেজেট প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
দুর্নীতি প্রতিরোধে দুর্নীতি দমনে কমিশন(দুদক) নামের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও কার্যত তা ঠুটো জগন্নাথ বলে পরিচিত। পত্রিকায় শিরোনাম হয় ‘দুদকের জালে শুধুই চুনোপুটি’। অর্থাৎ বড় বড় রাঘববোয়ালদের ধারে কাছে যেন তারা ঘেষতে পারে না। রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয়ে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতির লাগাম টানতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারী ব্যাংক খাতে লুটপাট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পাচারের মতো ভয়ঙ্কর ঘটনার কোন সুরাহা করতে পারেনি দুদক কিংবা সরকারি কর্তৃপক্ষ। শেয়ার বাজার নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও, সে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। তখন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন এ রিপোর্ট প্রকাশ করা যাবে না। কারণ রাঘব বোয়ালরা জড়িত। রাষ্ট্রযন্ত্র যেন এই দুর্বৃত্তদের সাথে পেরে উঠছেনা । এরাই সরকারের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলছে। সরকারের ব্যর্থতা সামনে চলে আসছে কিন্তু প্রকৃত দুর্বৃত্তরা থাকছে ধরাছোয়ায় বাইরে। পক্ষান্তরে জাহালমদের মতো হতভাগ্যদের কল্পিত ঋণখেলাপী হয়ে কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠ দিন কাটাতে হয়।
শেয়ার বাজার ব্যাংক লুট ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ পাচারের ঘটনার কাছে ক্যাসিনো কিংবা জুয়া খেলার দুর্নীতি বলতে গেলে নস্যি। হাজার কোটি টাকা বাইরে পাচারের ঘটনা দৃশ্যমান হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে আমরা দেখিনি। যে দেশে ব্যাংক কান্ড করলে কিছুই হয় না সেদেশে ক্যাসিনো, কাথা বালিশ চার্জারসহ কতকান্ডই তো ঘটতে পারে। একের পর এক তা ঘটেও চলেছে। অপরাধের অভয়ারণ্যে ডিআইজি মিজানুরের মতো মানুষ তাই দাপিয়ে বেড়ায়। দুদক কর্তকর্তাকে ঘুষ দেবার কথা মিডিয়া ও জনসমক্ষে গর্বের সাথে বলে ফেলেন। ঘুষ দেওয়াও যে অপরাধ সেটা তিনি তার সারা জীবনের প্রশিক্ষণ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন নি। মহামান্য হাইকোর্ট তাই ক্ষোভের সাথে বলেছেন ডিআইজি মিজান পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ইমেজ ধ্বংস করে দিয়েছে।
দুদকের সীমাহীন ব্যর্থতার সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন দুদক চেয়ারম্যানের পদত্যাগ করা উচিত। তিনি তার বিরুদ্ধে শপথ ভঙের অভিযোগ এনেছেন। বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ও ক্যাসিনো স¤্রাটকে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না তা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন সুপ্রিমকোর্টের এই আইনজীবী।
একজন বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি কী তার পদমর্যাদাকে বুঝবেন না ? তিনি হাজার হাজার মেধাবী ছাত্রের অভিভাবক। রাষ্ট্রের সম্মানীয় নাগরিক। কীভাবে ছাত্রনেতাদের সাথে অবৈধ আর্থিক লেনদেনে জড়িয়ে পরেন। কেন তিনি সৎ জীবন যাপন করতে পারবেন না? যদি তা পারেন তবে পদত্যাগ করে নিজের নৈতিকতাটুকু বজায় রাখতে পারেন। আরেক ভিসি সাইফুল ইসলাম। তিনি বুয়েটের ভিসি। যে বিশ^বিদ্যালয়ে আবরারের মতো মেধাবীরা পৈশাচিক হত্যার শিকার হয়, যে বিশ^বিদ্যালয়ের হলে হলে চর্চার সেলে চাত্রদেও নির্যাতন করা হয় সেখানে তিনি নাকে তেল দিয়ে ঘুমান। বুয়েটের ঘটনায় তিনি যে অর্বাচীনের মতো কাজ করেছেন তাতে পুরো জাতি হতবাক হয়েছে। আরেক দাম্ভিক ভিসি একজন ছাত্রীকে নাজেহাল করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে পদ চেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। একর পর এক ভিসিরা যখন বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণে অপমানিত ও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন তখন জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালেয় ভিসি ঘোষণা দিয়েছেন, যুবলীগের দায়িত্ব পেলে ভিসি পদ ছেড়ে দেবেন। জাতীয় এই মহান শিক্ষকদের আর কিই বা বলার থাকে। এই অধঃপতন কোন সূচককে নির্দেশ করে তা সকলেই অনুমান করতে পারেন।
চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। ঘটনা ঘটার পর সবার দৌড়ঝাঁপ আর বাগাড়ম্বর শুরু হয়। মিডিয়ার সামনে যারা হামেশা কথা বলেন তারা ভাবেন তাদেও বক্তব্য মানুষ অবোধ শিশুর মতো গিলছে। ঘটনা যাতে না ঘটে তার আগাম ব্যাবস্থা না নিয়ে বলেন-আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। কোনো দায়ও শিকার করেন না। এসব যেন ঘটতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি আইনের নিজস্ব গতি আছে? তাহলে আরঙ এ অভিযানের কারণে একজন কর্মকর্তাকে কেন বদলী করা হয়েছিল। যেখানে প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। ক্ষেত্র বিশেষে আইনে উল্টোগতি দেখে আমরা বিস্মিত হই। নুসরাতরা কেন আইনের কাছে ধর্না দিয়ে নিরাপত্তা পায় না। আইনের এই নিজস্ব গতি তুফান, বদিউল, মানিকদের কাছে পৌঁছতে পারে না। আইনের নিজস্ব গতি বেপরোয়া গতির চালকদের ধরতে পারে না । অভিযোগ না পেলে আইন কোন ভিক্টিমের পক্ষে দাড়ায় না, আবার স্বত:প্রনোদিত হয়ে গায়েবি মামলা ঠুকে দিতে পারে। যত মামলা, তত প্রেপ্তার,তত প্রেপ্তার বাণিজ্য।
লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়, যখন একজন রিকশাওয়ালা রাজু ভাস্কর্যের সামনে দাড়িয়ে বলেন ছাত্রলীগের কি এতই টকার দরকার যে আমার মতো রিক্সাওয়ালার টাকা ছিনিয়ে নিতে হবে। প্রতিদিন ট্রাফিক পুলিশের কতিপয় সদস্য বাস কিংবা ট্রাক চালকের নিকট থেকে হাত উঁচিয়ে টাকা আদায় করতে দেখা যায়। যে চালক বা হেলপার আইনের লোকদের প্রতিদিন চাঁদা দেয়, সে কেনো আইন মান্য করবে। সে কেনো বৈধ লাইসেন্সের তোয়াক্কা করবে। একজন হেলপার ড্রাইভার এখন কাউকে গোণে না। বাড়তি ভাড়ার বিষয়ে কেউ কথা বললে তৎক্ষনাৎ বলে দেয়, আপনি নেমে যান, অন্য গাড়িতে যান, এ গাড়িতে যেতে হলে এই ভাড়াই দিতে হবে। আপনাকে ডেকে আনিনি ’। ইত্যাদি ।
বড়রা দুর্নীতি করলে ছোটদের তা থেকে বিরত থাকতে বলতে পারে না । সে পথ ধরেই বাড়ি গাড়ি টাকার পাহাড় গড়ে স¤্রাট, খালেদ, শামীমের মতো মানুষেরা। তাদের কাছে কারা কারা নিয়মিত মাসোয়ারা নিয়েছেন সে কথাও একদিন প্রকাশিত হবে। একটি নিবন্ধে দেশের দুর্নীতির চালচিত্রের ছিটেফোটাও তুলে ধরাও সম্ভব নয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে একজন প্রার্থীকে তার আয় ব্যয়ের হিসেব দিতে হয়। কিন্তু ৫ বছর কিংবা ১০ বছরে যখন একজন এমপি বা মন্ত্রীর সম্পদ কতগুণ বেড়ে যায় সে নিয়ে সে নিয়েও মাথা ব্যথা নেই দুদদের । কোনো স্বাভাবিক পন্থায় কি সম্পদের পরিমাণ শতগুণ বাড়তে পারে? দুদক যদি দেশের আইন প্রণেতাদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের পথ বন্ধ করে দিতে পারতো তা হলে আর কেউ দুর্নীতি করে পার পেতো না। রক্ষকরা অবতীর্ণ হয়েছে ভক্ষকের ভ‚মিকায়। তারপরও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সফলতা কামনা করি। দুর্নীতির অক্টোপাস থেকে বাঁচতে চাই। জেগে উঠুক বোধি ও বিবেক।
লেখক: সাংবাদিক
Mail. mallickmnj@gmail.com