ড. জাহাঙ্গীর খান

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, কাউকেই টিকা নেওয়ার জন্য রাষ্ট্র বাধ্য করবে না। এটাই স্বাস্থ্যব্যবস্থার নীতিতত্ত্ব। তবে এটা সত্য যে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে আইন কখনো কখনো ব্যক্তিকে বাধ্য করে। যেমন সিটবেল্ট ছাড়া গাড়ি চালানো অথবা প্রকাশ্যে ধূমপান দণ্ডনীয় অপরাধ। এমন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা শুধু ব্যক্তির নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থেই নয়, সমাজের অন্যদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে নেওয়া হয়ে থাকে।

মূল বিষয়টি হলো, মানুষের দেহে প্রয়োগযোগ্য যেকোনো স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেই তাঁর সিদ্ধান্ত নেবেন, অন্য কেউ নন; যতক্ষণ পর্যন্ত রোগী নিজে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। যদিও সংক্রামক ব্যাধির টিকা শুধু ওই টিকা গ্রহণকারী ব্যক্তিকেই নয়, তাঁর আশপাশে থাকা অন্যদেরও স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয়, তারপরও রাষ্ট্র ব্যক্তিকে টিকা নিতে বাধ্য করতে পারে না।

এটি মনে রাখা জরুরি যে বাংলাদেশ জাতীয় টিকা কার্যক্রমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সর্বাধিক সফল একটি দেশ ও টিকা দ্বারা পোলিওসহ নিয়ন্ত্রণযোগ্য বেশ কিছু রোগ প্রতিরোধে দেশটি কৃতিত্বের ছাপ রেখেছে। কিন্তু করোনার টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে এ দেশের মানুষের মধ্যেই আস্থাহীনতা লক্ষণীয়। বিশ্বের অন্য কোনো দেশেও যদি একই পরিস্থিতি হয়, তবে সেই দেশগুলো কীভাবে এই পরিস্থিতির সামাল দেবে? এমন একটি পরিস্থিতিতে নিশ্চয়ই কোনো সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো হতাশ হয়ে বসে থাকতে পারে না। যখন বাধ্য করার নীতিটি অনৈতিক, তখন আচরণ-অর্থনীতির তত্ত্বের আলোকে ভিন্ন কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণ বিজ্ঞান ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রিচার্ড থ্যালার ২০১৭ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান। অধ্যাপক থ্যালার ও ক্যাশ সানস্টেইন আচরণগত অর্থনীতির নজ থিওরি বা ‘মৃদু ধাক্কা’ তত্ত্ব নিয়ে ২০০৮ সালে ‘নজ ইমপ্রুভিং ডিসিশন অ্যাবাউট হেলথ, ওয়েলথ অ্যান্ড হ্যাপিনেস’ বইটি প্রকাশ করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এই তত্ত্ব অনুসারে, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কোনো বিশেষ লক্ষ্যে মৃদু ধাক্কা দিলে তাদের সেই গন্তব্যের দিকে ধাবিত হতে দেখা যায়। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ধাক্কা ভালোই কাজ করে।

যেমন ধরুন, রেস্টুরেন্টের মেনু থেকে কোন খাবারটা পছন্দ করবেন। আপনার পাশের বন্ধুটি কিছুক্ষণ আপনার এই অবস্থা দেখে মেনুটা নিজের হাতে নিয়ে একটু নেড়েচেড়ে দেখল ও তারপর বলল, ‘২০৫ নম্বর খাবারটা ভালো হবে। দেখো, এটাতে প্রচুর সবজি আছে, সঙ্গে মাছ। নিউট্রিশন ভ্যালু অনেক।’ আপনি বন্ধুর এই যুক্তি ব্যবহার করে তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিলেন যে এই খাবারই আপনি অর্ডার করবেন। এ ক্ষেত্রে আপনার বন্ধুটি মূলত আপনাকে একটা মৃদু ধাক্কা দিয়ে একটি সিদ্ধান্তের দিকে ঢেলে দিল। এটা মৃদু ধাক্কা তত্ত্ব যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে, সেটাকেই তুলে ধরছে।

আমার এই লেখার প্রেক্ষাপট এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও পত্রপত্রিকায় কোভিড-১৯ বা করোনার টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে বহুমুখী আলোচনাকে কেন্দ্র করে।

করোনার টিকা গ্রহণে বাংলাদেশের মানুষের অনাস্থার বেশ কিছু কারণ আছে। সে কারণগুলো অন্যান্য উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশেও দেখা যায়।

প্রথমত, বাংলাদেশিদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিটা পরিসংখ্যান অনুসারে ও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে কম বলেই মনে হয়। হয়তোবা বাস্তবের সঙ্গে সরকারি হিসাবের একটি ফারাক আছে, কিন্তু তা দেশের মানুষকে ভীতিকর কোনো পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়নি। এই তুলনামূলক কম ঝুঁকি এড়ানোর জন্য অনেকেই টিকা নিতে না–ও চাইতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা যা–ই বলুন, সাধারণ মানুষ আস্থা পাচ্ছেন না। কেননা এটা উপলব্ধি করার মতো যথেষ্ট সময় পার হয়নি। ইতিমধ্যেই নরওয়েতে টিকা নেওয়ার পর ২৩ জনের মৃত্যু বেশ অনাস্থার জন্ম দিয়েছে। এই ব্যক্তিরা যে ৭৫-৮০ বছরের চেয়ে বেশি বয়সী ও বৃদ্ধাশ্রমে চিকিৎসাধীন ছিলেন, সেটা সাধারণ মানুষের অনেকেই সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করেন না।

তৃতীয়ত, অনেকেই মনে করেন, টিকার কোল্ড চেইন সঠিকভাবে মেনে চলার মতো সক্ষমতা অনেক দেশই রাখে না। তার ফলে টিকা কার্যকরতা হারাবে। চতুর্থত, অনেকেই ভাবছেন, আগে অন্যরা নিন, পরে বুঝেশুনে নিজে টিকা নেবেন।

একদিকে করোনার টিকা নিয়ে জনমনের শঙ্কা ও অনাস্থা, অন্যদিকে টিকা গ্রহণে বাধ্য করতে না পারার নীতিতত্ত্ব বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু উন্নয়নশীল দেশকে এক জটিল সমস্যায় ফেলেছে। তথাপি বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর অনেক কিছুই করার আছে সাধারণ মানুষকে টিকার আওতায় আনার জন্য। আচরণ অর্থনীতির ‘মৃদু ধাক্কা’ তত্ত্বের ব্যবহার করে বাংলাদেশ অনেকটাই অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারে। এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ ‘ঐচ্ছিক’ থেকে কিছুটা ‘বাধ্যবাধকতার’ দিকে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে টিকা গ্রহণের দিকে ঠেলে দেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে কারা ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্রমান্বয়ে টিকা পাবেন, তা সুনির্দিষ্ট করা ও গণমাধ্যমের সাহায্যে এটি সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা অপরিহার্য।

শিক্ষা ও প্ররোচনার মাধ্যমে জনগণকে মৃদু ধাক্কা দেওয়ার জন্য টিকা সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের বক্তব্য নিয়মিত গণমাধ্যমে তুলে ধরে এর কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জনগণকে অবহিত রাখার মাধ্যমে জনগণকে টিকার বিষয়ে আগ্রহী করে তোলা যায়। টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে কোনো ধরনের উদ্ভূত অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি না লুকিয়ে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা ও সেটির গুরুত্ব তুলে ধরাও এই প্রক্রিয়ার অংশ হতে হবে। এতে টিকা সম্পর্কে গুজব ছড়ানোর সুযোগও কমে আসবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন (তখন নির্বাচিত) স্বেচ্ছায় টিকা নিয়ে সেখানকার নাগরিকদের টিকা গ্রহণের দিকে কিছুটা ঠেলে দিয়েছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকেও আমরা একই কাজ করতে দেখেছি। সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের পাশাপাশি দেশের ও বিভিন্ন অঞ্চলের গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব, যেমন রাজনীতিবিদ (বৃহৎ রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতা, স্থানীয় সাংসদ, পৌর মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যান), সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষক, ইমাম, পুরোহিত, পাদরি এবং স্থানীয় সমাজপতিরা প্রথম টিকা গ্রহণের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘টিকা কর্মসূচির’ উদ্বোধন করতে পারেন।

উদ্দীপনা ও বাধ্যবাধকতা সৃষ্টির মাধ্যমেও জনগণকে টিকা নেওয়ার দিকে মৃদু ধাক্কা দেওয়া যায়। জনমনে উদ্দীপনা তৈরির জন্য টিকা গ্রহণকারী ব্যক্তিদের চাকরিস্থলে কিছু আর্থিক সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। এমনকি কিছু জবরদস্তি, যেমন ধরুন, হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য, উপাসনালয়ে যেতে হলে টিকা বাধ্যতামূলক করা যায়। এমনকি আন্তজেলা ভ্রমণ ও বিভিন্ন হোটেলে অবকাশ যাপনের জন্য যেতে হলে টিকা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।

পুরো টিকাদান পদ্ধতিকে কার্যকরী বা সক্ষম করার জন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি, যাতে করে জনগণের আস্থা তৈরি হয় ও তা বহাল থাকে। প্রতিদিন কী পরিমাণ মানুষ টিকা নিলেন, কোন এলাকায় কোন বয়স ও লিঙ্গের, সরকার তা প্রকাশ করবে গণমাধ্যমে। সরকার ছাড়া অন্য কেউ এই টিকা প্রদানের দায়িত্বে থাকতে পারবে না। নকল টিকা প্রতিরোধ করার সব ব্যবস্থা প্রথমেই নিতে হবে। একবার আস্থা হারালে, তা স্বল্প সময়ে ফিরে পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না ও টিকা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হবে। কোনো ধরনের অব্যবস্থা বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে সরকার নিজের ত্রুটি হিসেবে না দেখলে তা গণমাধ্যমে সঠিক ও স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করবে ও ভবিষ্যতে তা রোধ করার জন্য কী ব্যবস্থা নিল, তা পরিষ্কার করবে।

‘মৃদু ধাক্কা’ তত্ত্বকে সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, সহযোগী সংস্থা ও বিজ্ঞানীদের নিয়ে অতিসত্বর এক বা একাধিক কর্মশালার আয়োজন করে একটি নীতিমালা ও কার্যপ্রণালি তৈরি করা জরুরি। অন্যথায় বহুবিধ ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। সর্বোপরি, এটা না বললেই নয়, করোনা সংক্রমণ ও তাতে মৃত্যুর হার বাংলাদেশে যে অবস্থায়ই আছে, তাতে টিকাদান কর্মসূচি ছাড়া দেশের স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, অর্থনীতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপট; এমনকি বহির্বিশ্বের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। কেননা অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ থাকে না।

ড. জাহাঙ্গীর খান সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের স্বাস্থ্য-অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

সূত্র: প্রথম আলো

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here