আবদুর রহমান মল্লিক
জানাই আছে ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ এলে এক ধরনের প্রস্তুতি সবাই নিয়ে ফেলে। যে যার মতো করে সামর্থ অনুযায়ী ঈদ উদযাপন করে। চলছে কোরবানির ঈদ। মানে এটি ত্যাগের আনন্দ। ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত আনন্দ। একথা হামেশাই শুনে আসছি। বিশ্বাসও করি। প্রতিটি আনন্দের পেছনে কারো না কারো ত্যাগ থাকে। নয়তো আনন্দটা হতেই পারেনা। ধরুন মনে করে নিলাম ঈদের দিন সবাইকে নিয়ে রসনা মিটিয়ে মজাদার সব খাবার খাব। মনে করলেই কি সেটা হয়ে যায়। সেটা সম্ভব হয় রান্নাঘরে ঢুকে গৃহকর্ত্রীর ঘর্মাক্ত পরিশ্রমের মধ্যদিয়ে। তার ত্যাগ শুধু নয়, সবার তুষ্টিতে তারও একটা ভালো লাগা কাজ করে।
যার সামর্থ্য আছে তিনি পশু কোরবানি দেবেন। যার নেই তিনি বিভিন্ন উপকরণে তার মতো করে ঈদ উদযাপন করবেন। অথবা আত্মীয় স্বজনের পাঠানো উপঢৌকন দিয়ে রসনা নিবৃত করবেন। তবে আমাদের চোখের অন্তরালে এমন মানুষ থেকে যায়, ঈদের গোশত খেতে না পারলেও টু শব্দটি করেন না। তাদেরকে ঈদ আনন্দের মোকাবিলায় আত্মসম্মানকেই জয়ী করতে হয়। তবে যারা একেবারেই বিত্তহীন তারাতো কোরবানির গোশত সংগ্রহে নেমে পড়ে। ওই দিনের জন্য হলেও তাদের অতটা সমস্যা নেই। সবাই সমান ভাবে ঈদ আনন্দ করতে না পরলেও ঈদের গুরুত্ব অপরিসীম। এই দিনের উসিলায় সবাই কমবেশি ভালো খাবার ভালো পোশাক পরে থাকে।
ঘুরে ফিরে একটা কথাই সামনে চলে আসে। সারভাইবাল অব দ্য ফিটেস্ট। এই ফিটেস্টরাই পরিবার নিয়ে সর্বোচ্চ আনন্দটা করতে পারে। তর্কের খাতিরে কেউ বলতে পারে, সুখটা মনের ব্যাপার । সেটা অস্বীকার করিনা কিন্তু উপকরণের গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সে যাই হোক আমার আজকের নিবন্ধের উদ্দেশ্য সেটি নয়। আমাদের বলার বিষয় কিছু কোরবানি দাতাদের কোরবানি নিয়ে। কোনো কোনো ‘আলেমকে’ বলতে শুনি পুরো গোশত নিজেরা খেয়ে ফেললেও কোরবানি হয়ে যাবে। যদি অপরাধ না নেন তাহলে বলতে চাই-তাদের লক্ষ্য চামড়ার দিকে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকে প্রায় পুরো গোশত ডিপ ফ্রিজে সংরক্ষণ করেন আর সারাবছর ধরে খান। এই অভ্যাসটি কখনও কাম্য হতে পারেনা।
কোরবানি করতে কাউকে বাধ্য করা হয় না। নিজের গরজে সবাই কোরবানি করেন। স্ট্যাটাস সিমবল হিসেবে করলে এক বিষয় আর দরদী মন নিয়ে করা আরেক বিষয়। সৃষ্টিকর্তা মানুষের মনটাই দেখেন। একমাত্র সৃষ্টিকর্তারই কেবল ক্ষমতা আছে মন বোঝার। সৃষ্টিকর্তার যেমন নিজের কোনো প্রয়োজন নেই, তিনি চান মানুষের প্রতি মানুষ মমত্ববোধের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করুক। একজন বাবা যেমন চান তার সন্তানেরা মিলেমিশে থাকুক, একে অপরের বিপদে আপদে এগিয়ে আসুক। মানুষকে ভালো রাখার জন্যই পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তার এতো আয়োজন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার মানুষের কাছ কোনো চাওয়া নেই। চাওয়া শুধু তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা।
ইসলাম ধর্মমতে হ্যাভস আর হ্যাভ নটসের মধ্যে কোনো দ্ব›দ্ব নেই। বরং তাদের সম্পর্ক ভালোবাসাপূর্ণ। কোরবানি, জাকাত, ফেতরা, উসর তারই অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ। মহানবী তাই বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন,‘পৃথিবীর অধিবাসীদের প্রতি সদয় হও তাহলে উর্দ্ধলোকের প্রভু তোমার প্রতি সদয় হবেন।’ কাজেই ধর্মের মূল বিষয়টাই হচ্ছে মানুষের প্রতি ভালাবাসা-মমত্ববোধ। ইসলাম ধর্মের যে বিউটি (সৌন্দর্য) সেটা আমরা মুসলমানরাই ঠিকঠাক বুঝিনা। সেটা বুঝলে মুসলিমরাই হতো পৃথিবীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের নৈতিক আদর্শ ও চরিত্রিক সৌন্দর্য অন্যদের ওপর সেইভাবে প্রভাব ফেলছেনা। ধর্ম যেন বাহ্যিকতায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। মুসলমানদের ভেতরে স্বার্থপরতা, হিংসা, বিদ্বেষ, উচ্চাভিলাস, গর্ব, অহঙ্কার প্রবল হয়ে উঠেছে। কবি নজরুল বিষয়টি হৃদয় নিয়ে বুঝেছিলেন বলেই তিনি পরম মমতায় উচ্চারণ করেছেন-‘তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্বনিখিল ইসলামে মুরীদ।’
মানুষের মাঝে ভক্তি-শ্রদ্ধা, প্রেম-ভালোবাসার পরিবর্তে কোনো কোনো ‘ইসলামী’ বক্তা অনবরত বিদ্বেষ ছড়িয়ে যাচ্ছেন। তারা প্রতিপক্ষ তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে অবলীলায় নাস্তিক, মুরতাদ, কাফের, মুনাফেক শব্দগুলো প্রয়োগ করছেন। যে কোনো মটিভেশনাল স্পিস দিতে হয় খুব ধীর স্থির শান্ত মেজাজে। অথচ তাদের হুঙ্কার ও রাজনৈতিক নেতার মতো গর্জে উঠা দেখে মানুষের ভেতরে ভিন্ন মনোভাবের সৃষ্টি হয়। ফেসবুক ইউটিউবে ভিউ বাড়ানোর জন্য তারা নানা রং-এ নানা ঢং-এ হাসিয়ে কাঁদিয়ে বক্তব্য রাখেন। মানুষের মাঝে হঠাৎ আবেগ কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। তাই কোরবানির প্রাক্কালে সবার মাঝে ঐশী বাণী ও ধর্মের প্রকৃত শিক্ষার চর্চা হোক সেই প্রত্যাশা করি।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক