রুহুল ইসলাম টিপু

৮ মার্চ ২০২১ বিশ^ নারী দিবস। এ বছরের শ্লোগান: নেতৃত্বে নারী করোনার পৃথিবীতে সমতার ভবিষ্যৎ। একই দিবস ৮ মার্চ ২০২১ এ বাংলাদেশ করোনার রোগী শনাক্তের এক বছর অতিক্রম করছে। গত একটি বছর বাংলাদেশে নারীদের চলমান বাঁধাসমূহের সাথে অতিরিক্ত যুক্ত ছিল বৈশি^ক করোনা ভাইরাসের লন্ড ভন্ড তান্ডব। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের পেশাজীবী এবং সকল নারী সাহসিকতা, দক্ষতা ও সফলতার সাথে করোনা এবং জীবনের নানাবিধ পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন।
বৈশি^ক করোনা পরিস্থিতি বাংলাদেশের নারীর ন্যায় সারা পৃথিবীর নারী সমভাবেই বাঁধা অতিক্রম করছেন। নারী দিবসে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ কনভেনশন নিয়ে একটু লেখা প্রয়োজন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর এConvention on the Elimination of all forms of Discrimination Against Women (CEDAW) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কনভেশনটি কার্যকারিতা লাভ করে। নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ কনভেনশন সবচেয়ে ব্যাপক ও আইনগতভাবে অবশ্য পালনীয় নারীর মানবাধিকার। নারীর আন্তর্জাতিক বিল অব রাইটস হিসেবে অভিহিত এই কনভেনশন বৈষম্যের অবসানে জাতীয় পর্যায়ে ব্যবস্থা গ্রহণের একটি এজেন্ডা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
কনভেনশনের শর্তানুযায়ী রাষ্ট্রসমূহের প্রতি নারীর মৌলিক মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; নারী পাচার ও পতিতাবৃত্তিতে নারীর শোষণ রোধ নিশ্চিত করা; রাজনৈতিক ও লোকজীবনে নারীর প্রতি বৈষম্যের অবসান; জাতীয়তা অর্জন, পরিবর্তন বা বহাল রাখার সমান অধিকার নিশ্চিত করা; শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক ও সমাজ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈষম্যের অবসান ঘটানোর জন্যে ব্যবস্থা গ্রহণের আহŸান জানানো হয়েছে। অন্যান্য ধারায় গ্রামীণ নারীর সমস্যা, আইনের দৃষ্টিতে সমতা এবং বিবাহ ও পারিবারিক জীবনের নারীর প্রতি বৈষম্যের অবসান সংক্রান্ত বিষয়গুলো রয়েছে। কনভেনশনে নারীর নিজ নিজ দেশে রাজনৈতিক ও লোকজীবনে অংশগ্রহণ এবং সরকারের সকল পর্যায়ে সকল কাজ করার অধিকারও নিশ্চিত করা হয়েছে। কনভেনশনের ধারা ১-এ নারীর প্রতি বৈষম্যের সংজ্ঞায় যা বলা হয়েছে তা হলো, ‘বৈবাহিক মর্যাদা নির্বিশেষে নারী ও পুরুষের সমতার ভিত্তিতে মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নাগরিক বা অপর যে কোন মৌলিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে নারীর স্বীকৃতি, ভোগ বা প্রয়োগকে ব্যাহত বা অকার্যকর করা।’

১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ চারটি ধারায় [১, ১৩(ক), ১৬(ক) ও (চ)] সংরক্ষণসহ এ সনদ অনুসমর্থন করে। ১৯৯৬ সালে ধারা ১৩(ক) এবং ১৬.১ (চ) থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করা হয়। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রায় সকল ফোরামে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ ও আন্তর্জাতিক সনদ ও দলিলসমূহে স্বাক্ষরের মাধ্যমে নারী উন্নয়নে বিশ^ ভাবধারার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত মিলেনিয়াম সামিটের অধিবেশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। একই সময় ঙঢ়ঃরড়হধষ চৎড়ঃড়পড়ষ ড়হ ঈঊউঅড- তে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে। গুরুত্বপূর্ণ এই সনদে স্বাক্ষরকারী প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এছাড়াও আঞ্চলিক পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষরকারী ও অনুসমর্থনকারী রাষ্ট্র হিসেবে নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণে দেশের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে।

আমাদের রাষ্ট্রীয় আইন মহান সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ ২৮(১) অনুচ্ছেদে রয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ ২৮(২) অনুচ্ছেদ এ রয়েছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।’ ২৮(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না।’ ২৮(৪) এ উল্লেখ রয়েছে যে, ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’ ২৯(১) এ রয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’ ২৯(২) এ আছে, ‘ কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারীপুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মের নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।’ ৬৫(৩) অনুচ্ছেদ এ নারীর জন্য জাতীয় সংসদে ৫০টি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। ৯ অনুচ্ছেদের অধীনে স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান সমূহের উন্নয়নে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।

২০২১ মুক্তিযুদ্ধের ৫০তম বছর। স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী আমরা উদযাপন করছি। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরুষের সাথে নারীরাও অসামান্য অবদান রাখেন। স্বামী-সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে মায়েরা রাখেন বিশাল দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের নিদর্শন। লক্ষাধিক মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের জঘন্যতম অপরাধ এটি। দেশ মা রাষ্ট্র সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণে রাখার জন্য ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিতে ভ‚ষিত করে। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ এ দারিদ্র্য প্রতিপাদ্যে দেখা যায়, দেশের শতকরা ৪০ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে দুই তৃতীয়াংশই নারী এবং এর মাঝে নারী প্রধান পরিবারের সংখ্যা অধিক। যদিও পরিসংখ্যানটি একই স্থানে অবস্থান করছে সেটি ঠিক নয়। অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বড় অংশ নারীকে নিচে রেখে নারী দিবস এবং মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের আনন্দের পরিপূর্ণতা দিতে পারে না। বিশ^ ওয়াকেবহাল যে, সহ¯্রাব্দ লক্ষ্য মাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ সাফল্যের রোল মডেল।

১২ ফেব্রæয়ারি ২০২১ এ প্রথম আলো’য় প্রকাশিত ‘রাস্তায় কিশোরীদের যৌন হয়রানি বেশি’ শীর্ষক কৈশোর স্বাস্থ্য ও সুস্থতা জরিপে উঠে আসে কিছু তথ্য; যেমন- সবচেয়ে ধনী পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য বেশি; ২৭% কিশোরী ২২ বছর বা তার বেশি বয়সে বিয়ে করতে চায়; প্রতি ৫ জন বিবাহিত মেয়ের একজন স্বামীর থেকে পৃথক থাকে; কিশোর-কিশোরীদের মধ্যেও বিষন্নতা; কিশোরীদের মধ্যে অল্প ওজন ও অতি ওজন- দুই সমস্যাই আছে। একই তারিখে একই পত্রিকার ভিতরের পৃষ্ঠার একটি সংবাদের শিরোনাম ‘সুদের টাকার জন্য গাছে বেঁধে মা-মেয়েকে নির্যাতন।’ নারী দিবসে এসব লুকিয়ে রাখার কোন বিষয় নয়।
আমরা টেকসই উন্নয়ন অভিষ্টের প্রায় মধ্যম সময় পার করছি। আমাদের প্রত্যাশা সাফল্য অর্জন। অভিষ্টের ৫ নম্বরে রয়েছে নারী-পুরুষের সমতা। এতে বলা হয়েছে, সর্বক্ষেত্রে নারীদের ওপর সবধরণের বৈষম্য দূর করা। ঘরের ভেতরে কিংবা বাইরে নারীদের ওপর সবধরনের সহিংসতা পরিহার করা। নারী পাচার ও যৌন নিপীড়নসহ সব ধরণের নির্যাতন বন্ধ করা। বাল্যবিবাহ, জোরপূর্বক বিবাহসহ সব ধরণের ক্ষতিকারক চর্চা পরিহার করা। সরকারি সেবা, অবকাঠামো ও সামাজিক নিরাপত্তা নীতিমালার মাধ্যমে অবৈতনিক ও গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন করা। পরিবার ও পারিবারিক দায়িত্ব বন্টনের বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে উপযুক্ত করে তুলে ধরা।
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও জনজীবনে নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পূর্ণ ও কার্যকরভাবে নারীর অংশগ্রহণ ও সমান অধিকার নিশ্চিত করা। আইসিপিডি’র প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন এবং বেইজিং প্লাটফর্ম অব অ্যাকশনের সমঝোতা অনুযায়ী যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের অধিকারে নারীদের সার্বজনীন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা। নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করতে জাতীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক সম্পদ, সম্পত্তির উপর অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক সেবা, ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিষয়ে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়া। নারীর ক্ষমতায়নে প্রযুক্তি-বিশেষ করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো। সর্বক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগ জোরদার করা।

আমার জন্ম এক নারীর পেটে। তিনি আমার মা। মা ছাড়া পৃথিবীর আলো দেখা সম্ভব ছিল না। মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা। আমার স্ত্রী এবং তিন কন্যা। তারাও নারী। তাদের প্রতিও শ্রদ্ধা। আমার বড় মেয়ে প্রতিবন্ধিতার শিকার, তিনি অটিজমে আক্রান্ত। নারীর সমস্যা, আমি ঘর হতেই বুঝি। সে আলোকেই আমি সমাজে অংশগ্রহণ করি। রাষ্ট্রে নারীর অংশগ্রহণ উপলব্ধি করি। নারীর অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্ব ব্যতীত আমরা অচল, সমাজ এবং রাষ্ট্র নিস্ক্রিয়। সমাজ এবং দেশের উন্নয়নে নারীর সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি ব্যতিত অন্য কোন পথ নেই। দেশের সকলের প্রতি অনুরোধ আসুন আমরা নারীর মর্যাদা বাড়ানোর ক্ষেত্রে পরিবারের ভ‚মিকা শক্তিশালী করি; সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে নারী শিশুর সচেতনতা বৃদ্ধি করি; নারী শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা নিমর্‚ল করি; শিশু শ্রমভিত্তিক অর্থনৈতিক শোষণ দূর করি এবং কর্মজীবী তরুণীদের নিরাপত্তা প্রদান করি; স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি বৈষম্য বিলোপ করি; শিক্ষা, দক্ষতার উন্নয়ন এবং প্রশিক্ষণে নারীদের প্রতি বৈষম্য বিলোপ করি; নারী সন্তানের অধিকার উন্নত ও নিরাপদ করি এবং তার চাহিদা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করি; নারীদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও তৎপরতা বিলোপ করি; নারী শিশুর বিরুদ্ধে সব ধরণের বৈষম্য বিলোপ করি; সকল মানবাধিকার ব্যবস্থা বিশেষভাবে নারীর বিরুদ্ধে সব ধরণের বৈষম্য বিলোপ সংক্রান্ত কনভেনশনের পূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারীর মর্যাদা রক্ষা ও উন্নত করি।

ফলশ্রæতিতে আমরা পাবো সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। নেতৃত্বে নারী করোনার পৃথিবীতে সমতার ভবিষ্যৎ আমরা এখনই দেখতে চাই। ৮ মার্চ ২০২১ বিশ^ নারী দিবস সফল হোক।

লেখক: মানবাধিকার সংগঠক ও অটিজম বিশেষজ্ঞ

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here