রুহুল ইসলাম টিপু
নেলসন রুলিহলাহলা ম্যান্ডেলা, পরিচিত বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামের কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলা হিসেবে। রুলিহলাহলা এটি তার গোত্রীয় নাম। নেলসন নামটি ইংরেজি থেকে এসেছে, এটি দিয়েছেন তার স্কুল শিক্ষক। জন্ম ১৮ জুলাই ১৯১৮ সাল। আজ তার ১০৩ তম জন্ম দিন। জন্মস্থান সাউথ ইস্টার্ণ ক্যাপ অব সাউথ আফ্রিকার ছোট্ট গ্রাম নাম ট্রান্সকেই। মায়ের নাম নোসেকেনি ফানি, বাবা গাডলি হেনরি মফাকানিয়াস্বা। তার বাবা গ্রামের প্রধান এবং রয়েল ফ্যামেলি অব দি থিমবু উপজাতির সদস্য ছিলেন। ভাষা জোসা। উপজাতি গোত্রেই বেড়ে উঠছেন ম্যান্ডেলা। তিনি দেখেছেন শ্বেতাঙ্গদের নিষ্ঠুর আক্রমণাত্মক পরিবেশ। মানুষের নির্মম ভেদাভেদার অসাম্যের সংস্কৃতি।
ম্যান্ডেলা মেথোডিস্ট চার্চ স্কুলে পড়েন। আফ্রিকার উপজাতিতে বয়:জ্যৈষ্ঠদের সিদ্ধান্তে অনেকটা জোড়পূর্বক বিয়েতে বসানোর প্রথা থাকলেও তিনি সেটা পরিত্যাগ করেছিলেন। ছাত্র ধর্মঘটের নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ১৯৪০ সালে হেয়ার ইউনিভার্সিটি কলেজ তাকে বহিস্কার করেছিল। তিনি উইটওয়াটারস্ট্রান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রী নেন। ১৯৪২ সালে ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকা থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রী অর্জন করেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনৈতিক দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস এ ম্যান্ডেলা যোগ দেন ১৯৪৪ সালে। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস এর মূল উদ্দেশ্য হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উন্নয়ন এবং বর্ণ ভেদে সকল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা। অচিরেই তিনি এএনসি’র যুব লীগের নেতা হলেন। ১৯৫১ সালে লীগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
ডারবান বিচ, বাই ল’ এর সেকশন ৩৭ এ বলা হয়েছে, গোসলের এ অঞ্চল শ্বেতাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিত।
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণ বৈষম্য নীতি, বর্ণবাদ নীতি যাকে ইংরেজিতে অঢ়ধৎঃযবরফ বলে। বর্ণ বৈষম্য একটি পলিসি যেটা শ্বেতাঙ্গ সংখ্যা লঘু এবং অশে^তাঙ্গ সংখ্যা গুরুর মাঝে একটি সম্পর্ক। কর্তৃপক্ষের অনুমোদনপ্রাপ্ত বর্ণ পৃথকীকরণ পদ্ধতি যার মাধ্যমে সংখ্যা গুরু অশে^তাঙ্গরা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকসহ সকল বৈষম্যের শিকার। ১৯৫০ সালের পপুলেশন রেজিষ্ট্রেশন অ্যাক্ট অনুসারে ১৯৬০ সাল থেকে বলা হলো এটি পৃথক উন্নয়ন পদ্ধতি। যার শ্রেণিকরণ করা হয় বান্টু যারা সকল অশে^তাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গ , এখানে থাকবে অশ্বেতাঙ্গ ছাড়া অন্য সকল বর্ণের মানুষ- চতুর্থ তালিকায় আসে এশিয়ান বিশেষ করে ভারতীয় এবং পাকিস্তানীরা যুক্ত হয়।
১৯৫১ থেকে ১৯৬০ সাল ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা এবং এএনসি’র জন্য খুবই কঠিন সময়। এ সময় বর্ণ বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে যুব কর্মীগণ এবং ম্যান্ডেলা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। এতে কোন অগ্রগতি হয় না। বরং দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার আরো হিংসাত্মকভাবে আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধ করে। শান্তিপূর্ণভাবে বর্ণ বৈষম্য নীতি নির্মূলে ম্যান্ডেলার সব রকম প্রস্তুতিই ছিল। তিনি উপলব্ধি করলেন অহিংস আন্দোলনে কোন ফলাফল বয়ে আনবে না। আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করে ১৯৫২ সালে ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে এএনসি ৯ মাস কারাবরণের প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহণ করে। ১৯৫৬ সালে ম্যান্ডেলা এএনসি’র অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে গ্রেফতার হন। এ সময় অশে^তাঙ্গদের মুক্তভাবে দেশে চলাচলে বাধাদানের উপর একটি আইন পাস হয়।
শারপেভিল শহর, মৃত এবং আহাজারির খন্ড চিত্র, ছবি ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত
১৯৬০ সালে আন্দোলন শারপেভিল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে পুলিশ নিরস্ত্র জনগণের উপর গুলি বর্ষণ করে। ম্যান্ডেলা’র বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বিরোধী অভিযোগ আনা হয়। তাদেরকে ১৯৬১ সালে অবরুদ্ধ করা হয়। একই সময় দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার এএনসি দলকে নিষিদ্ধ করে। শারপেভিল শহর জোহানেসবার্গ হতে দক্ষিণ ৫০ কিলোমিটার দূরে, সরকারকে বুঝিয়ে দেয় অহিংস আন্দোলন শেষ। ২১ মার্চ ১৯৬০ সালের তান্ডব দেখেছে সারা বিশ্ব। এ দিবসকে দক্ষিণ আফ্রিকার মানবাধিকার দিবস বলা হয়। ১৯৬১ সালে বর্ণ বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা সেমি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়; গঠিত হয় অল আফ্রিকান ন্যাশনাল অ্যাকশন কাউন্সিল। ম্যান্ডেলা নির্বাচিত হন এর সম্মানিত সেক্রেটারি। পরবর্তীতে তিনি এটির প্রধান নির্বাচিত হন, এটি যুদ্ধ করে বর্ণ বৈষম্য নীতি’র বিরুদ্ধে।
১৯৬২ সালে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। তার ৫ বছরের জেল হয়। রাষ্ট্র বিরোধী অভিযোগে ম্যান্ডেলাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। ২৭ বছর কারাগারে থাকেন। বর্ণ বৈষম্য নীতির সরকারের নির্যাতন বেড়েই চলে। কারাগারে জনসাধারণের সাথে ম্যান্ডেলার আলোচনা নিষিদ্ধ করা হয়। যৎসামান্য কিছু ব্যক্তি দেখা করার সাক্ষাৎ পেতেন। এর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং সারা পৃথিবীতে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে বর্ণ বৈষম্য নীতির প্রতিবাদকারীর প্রতীক হয়ে উঠেন। ১৯৭৬ সালের ১৬ জুন বিদেশি ভাষায় স্কুল শিক্ষা প্রচলনের প্রতিবাদ বিক্ষোভে গুলি চালালে শিশুসহ ৭০০ নিহত হয়, আহত হয় ৪ হাজার। এর ফলে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রাম তীব্রতর হয়।
১৯৮৮ সালে তিনি খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যান। সুস্থ হওয়ার পর আবার কারাগারে; তবে কড়াকড়ির শর্তাবলি কিছুটা হলে শিথিল হয়। এসময় ক্ষমতাসীন শে^তাঙ্গদের মধ্যে দ্ব›দ্ব তীব্রতর হয়ে উঠে। প্রতিবাদ উঠে এবং আন্তর্জাতিকভাবে চাপ বাড়তে থাকে বর্ণ বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে। দক্ষিণ আফ্রিকা বর্ণবাদী রাষ্ট্র হিসেবে একাকী হয়ে পড়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট এফ ডবিøউ ডি ক্লার্ক বিশ্বাবাসীকে আশ^াস্ত করে জানান যে ম্যান্ডেলাকে ছেড়ে দিবেন। ১১ ফ্রেব্রুয়ারি , ১৯৯০ ম্যান্ডেলা কারাগার থেকে মুক্ত হন। পৃথিবী তাকে অভিনন্দন জানায়; স্বাগতম প্রিয় নেতা। ১৯৯১ সালে তিনি এএনসি এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং তার পার্টি রাজনীতি করার আইনী যোগ্যতা অর্জন করে।
বর্ণ বিরোধী নেতা নেলসেন ম্যান্ডেলা এবং ডি ক্লার্ক উপলব্ধি করেন অশ্বেতাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গ এর মিলন বড়ই প্রয়োজন; তারা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছে। অবসান হলো বর্ণ বৈষম্য বিরোধী নীতি বা অঢ়ধৎঃযবরফ । ফলশ্রæতিতে ১৯৯১ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নতুন একটি অধ্যায় জন্ম হলো দক্ষিণ আফ্রিকায়। গণতান্ত্রিক সরকার দেশের বর্ণ, গোত্র, রং এর ভেদাভেদ তুলে দিয়ে সকল মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করে।
১৯৯২ সালে ম্যান্ডেলা এবং ডি ক্লার্ক দুই নেতা নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেন। অবাধ ও মুক্ত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এসেম্বলী গঠিত হয়। নতুন নির্বাচিত সরকার গঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অস্থায়ী একটি সরকার থাকবে। ২৭ এপ্রিল ১৯৯৪ সালে প্রথম অবাধ মুক্ত নির্বাচনে এএনসি ৬২ ভাগ ভোট পেয়ে ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। জুন ১৯৯৯ সালে তিনি অবসরে যান।
তিনি বুরুন্ডির শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মেডিয়েটরের দায়িত্ব পালন করেন; যেখানে গৃহযুদ্ধে সহ¯্রাধিকের প্রাণ হানি ঘটে। পৃথিবীর শান্তি প্রতিষ্ঠায় সকল সন্ত্রাসী ও আগ্রাসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধেও রুখে দাড়ান তিনি। ১৯৯৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ম্যান্ডেলা। নভেম্বর ২০০৯ এ জাতিসংঘ শান্তির সংস্কৃতি এবং স্বাধীনতার অবদান স্বরূপ প্রতিবছর তার জন্মদিন ১৮ জুলাই এ মহান নেতার স্মরণে বিশ^ নেলসন ম্যান্ডেলা দিবস ঘোষণা করে। প্রত্যেক মানুষের পরিবর্তনের সক্ষমতা রয়েছে, দায়িত্বশীলতার সাথে এ সক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র এবং পৃথিবীর পরিবর্তন ঘটাতে পারে। নেলসন ম্যান্ডেলা দিবসে এটিই হোক আমাদের অঙ্গীকার। তিনি ৬৭ বছর মানবকল্যাণে ব্যয় করেছেন, একজন মানবাধিকার আইনজীবী, সচেতন কারাভোগী, আন্তর্জাতিক শান্তির বাহক এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। আমরাও তো প্রতীকিভাবে ৬৭ টি মিনিট অর্থ্যাৎ ১ ঘন্টা ৭ মিনিট ব্যয় করতে পারি নেলসন ম্যান্ডেল উপর আলোকপাত করে এবং এটি নিয়ে যেতে পারি আমাদের সমাজে, দেশ পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে।
বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন তার কন্যা জিন্দজি ম্যান্ডেলা। ম্যান্ডেলা বন্দী থাকার কারণে বাবার সাথে তার প্রথম দেখা হয় ১৫ বছর বয়সে। সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে মায়ের সাথেও নিয়মিত থাকা হতো না। লেখাপড়া করতে পারেন নি, জন্মস্থান সোয়েটেতে। ১৩ জুলাই জোহানেসবার্গে মৃত্যুবরণ করেন ম্যান্ডেলার কন্যা জিন্দজি ম্যান্ডেলা। তিনি ছিলেন ডেনমার্কে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত। হারাতে হলো আরেক অসমাপ্ত কর্মের সহযাত্রীকে।
জাতিসংঘ ২০১৯ থেকে ২০২৮ কে নেলসন ম্যান্ডেলা শান্তির দশক ঘোষণা করেছে। এ দশকের একজন মানুষ হিসেবে স্যালুট জানাই তার মানবতাবাদ, ক্ষমা প্রদর্শন এবং অসীম সহিষ্ণুতাকে, এতেই আসবে আগামীর শান্তিময় পৃথিবী। আমাদের প্রিয় নেতা অমর হোক।
বিশ্ব ম্যান্ডেলা দিবসে নেলসন ম্যান্ডেলার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা।