মুজতাহিদ ফারুকী: রাষ্ট্র ও সরকার এবং জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন ব্যক্তিবর্গের কারও কারও বক্তব্য বিবৃতি সম্প্রতি জনগণের উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ এদের কথায় বিব্রত বোধ করছে। অনেক সময় তাদের বক্তব্য মানুষের বিরক্তির কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে না, আমাদের নেতৃত্বের আসনে যারা বসে আছেন তাদের বোধ-বুদ্ধি, মেধা-মননে সত্যিই ঘাটতি আছে নাকি তারা কোনও বিশেষ স্বার্থবাদী মহল ও গোষ্ঠীর পক্ষ নিয়ে কথা বলছেন।
বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয়নি এবং তিনি নিজে ও অন্য সব সংসদ সদস্য বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন মর্মে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের একটি বক্তব্য নিয়ে সারাদেশে আলোচনা সমালোচনা চলছে। সবাই একমত যে, মন্ত্রিত্ব না পাওয়ার মনোকষ্ট থেকেই তিনি এসব কথা বলছেন এবং এর লক্ষ হলো সরকারকে চাপে ফেলে কোনভাবে মন্ত্রিত্ব বাগানো যায় কিনা সেই রাস্তা হাতানো।
মেনন ভুলে গেছেন, তিনি ওবায়দুর কাদেরের মতো আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত নেতা নন। ২০০৮ এর নির্বাচনের পর মন্ত্রিত্ব থেকে বাদ পড়া ওবায়দুল কাদের সরকারের সমালোচনার যে পথ ধরে মন্ত্রিত্ব বাগিয়ে নিতে সক্ষম হন সেই একই দাওয়াই তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাই দেখা গেল মেননের ওই বক্তব্যের পরই ক্যাসিনো থেকে তার মাসে ১০ লাখ করে টাকা নেয়ার খবর জাতীয় দৈনিকের গুরুত্বপূর্ণ খবর হয়ে বের হলো। এটা হয়তো ধারাবাহিকভাবে চলতে পারতো, কিন্তু মেনন সারেন্ডার করেছেন। রোববার রাতেই তিনি ভোল পাল্টে অ্যাবাউট টার্ন নিয়েছেন এবং নিজের আগের বক্তব্য থেকে সরে এসে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
এমনই আরেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মীজানুর রহমান। তিনি হঠাৎ করেই বলে বসলেন, আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হলে তিনি ভিসির পদ ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। তার এই বক্তব্য সারাদেশে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। একজন শিক্ষাবিদের মেধা ও মননের কতটা বিকৃতি বা অপরিপক্কতা থাকলে এধরণের চিন্তা মাথায় আসতে পারে ভেবে অনেকে উদ্বিগ্ন। সামাজিক মাধ্যমে অনেকে ছি ছি করেছেন , অনেকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ধামাধরা শিক্ষকদের রাজনৈতিক বিবেচনায় ভিসি নিয়োগের কুফল সম্পর্কে জাতিকে সতর্ক করেছেন।
কিন্তু সবচেয়ে গুরুতর ও বিপর্যয়কর মন্তব্যটি এসেছে একজন সাংবিধানিক পদাধিকারীর মুখ থেকে। তিনি আমাদের নির্বাচন কমিশনের প্রধান। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এমন নুরুর হুদা বলেছেন, ‘নাগরিকরা ভোট দিতে পারুক বা না পারুক সেটা বিষয় নয়, বিষয় হলো তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে হবে।’
মন্তব্যের প্রথম অংশটি লক্ষ্য করার মতো। তিনি প্রচ্ছন্নভাবে স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, নাগরিকরা ভোট দিতে পারেন না। তার সময়ে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ যতগুলো নির্বাচন হয়েছে তার সব কটিতেই এই সত্য প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং তার বক্তব্যের পরের অংশটিই সত্য হয়ে ওটে। নাগরিকদের অন্ততপক্ষে একটি ভোটার পরিচয়পত্র তো থাকুক! তারা বলতে পারবে, আমি একজন সম্মানিত ভোটার। রোববার ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমবিষয়ক এক কর্মশালার উদ্বোধনকালে সিইসি আরও বলেন, ভোট দেয়ার চেয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার গুরুত্ব বেশি।।
নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে একজন সিইসির উপলব্ধির মান যখন এই পর্যায়ে নেমে আসে তখন আর আশা করার কোনও কারণ থাকে না।
একই দিনে একই অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, যেসব জনপ্রতিনিধি অবৈধ উপায়ে বা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হন, তাদের নির্বাচনের কোনো বৈধতা থাকে না। তিনি বলেন দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া দুর্নীতির আওতামুক্ত নয়। মাহবুব তালুকদার বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই সব জাতির লক্ষ্য হয়ে থাকে। কারণ গণতন্ত্রহীন জাতির আত্মমর্যাদা বলে কিছু থাকে না।
উচ্চপদে আসীন ব্যক্তিদের নির্বোধ উচ্চারণ নিয়ে আমরা কোনই মন্তব্য করবো না। ভিসি বা সিইসি তিনি যে-ই হোন তাদেরকে সসম্মানে সালাম ঠোকাই আমাদের জাতির স্বোপার্জিত নিয়তি।
#