বিদেশ ডেস্ক: প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রে গন্ধকে চিকিৎসার কাজে বেশ ভালোভাবেই ব্যবহার করা হতো। আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যায় গন্ধের ব্যবহার আর আগের মতো অতটা বিস্তৃত নয়। তারপরও ডায়াবেটিসের মতো রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এখনো গন্ধকে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু স্নায়ু কিংবা মস্তিষ্কের রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গন্ধ ব্যবহার করা হচ্ছে—এমন উদাহরণ খুব বেশি নেই। তবে এবার পারকিনসন্স রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে চলেছে। গবেষকেরা বলছেন, গন্ধ দিয়েই নাকি নির্ণয় করা যাবে পারকিনসন্স।

পারকিনসন্স এমন একটি রোগ, যা মানুষকে শারীরিকভাবে ভারসাম্যহীন করে ধীরে ধীরে চলৎশক্তিহীন করে দেয়। ঘন ঘন কাঁপুনি, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নড়াচড়ার অনুপযোগী করে তোলা এবং স্মৃতিভ্রম—এগুলো হলো পারকিনসন্স রোগের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শতভাগ সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এমনকি আক্রান্ত ব্যক্তির জীবিত থাকার সম্ভাবনাও দিন দিন কমতে থাকে। পারকিনসন্স রোগের ওষুধ প্রচলিত থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা ততটা কার্যকর হয় না।

অন্য অনেক রোগের মতোই এই রোগ যত দ্রুত শনাক্ত করা যায়, ততই রোগীর জন্য মঙ্গল। কিন্তু পারকিনসন্সের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—এমন কোনো নির্দিষ্ট পরীক্ষা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি যা দিয়ে নিশ্চিত করে নির্ণয় করা যাবে এটি। স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞরা সাধারণত রোগীর দেহে বিদ্যমান উপসর্গগুলোর সঙ্গে পারকিনসন্স রোগের উপসর্গগুলো মিলিয়ে দেখেন। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, রোগীর দেহে পারকিনসন্স রোগ বাসা বেঁধেছে কি না। অর্থাৎ হাত–পা ভাঙলে যেমন এক্স–রে রিপোর্ট দেখে তা নিশ্চিত হওয়া যায়, পারকিনসন্সের ক্ষেত্রে তেমন উপায় নেই। রোগ শনাক্ত করার জন্য উন্নত প্রযুক্তির খোঁজ এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তবে সেই প্রযুক্তি যত দিন না আবিষ্কার হচ্ছে, তত দিন বিজ্ঞানীদের ভরসা রাখতে হচ্ছে মানুষের নাকের ওপরেই।

ভুল পড়ছেন না। আক্ষরিক অর্থেই পারকিনসন্স শনাক্তকরণের জন্য বিশেষ একজন মানুষের ঘ্রাণশক্তির দ্বারস্থ হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিশেষ সেই মানুষটি হলেন জয় মিলনে। মিলনে স্কটল্যান্ডের একজন অবসরপ্রাপ্ত সেবিকা (নার্স)। তাঁর একটি বিশেষ গুণ হলো—আর পাঁচজন স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় তাঁর ঘ্রাণশক্তি অনেক বেশি তীক্ষ্ণ। স্বাভাবিকের তুলনায় ঘ্রাণশক্তি তীক্ষ্ণ হওয়ার এই বিষয়টিকে চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় বলা হয় হাইপেরোসমিয়া। মিলনে তাঁর তীক্ষ্ণ ঘ্রাণশক্তির কল্যাণে এমন সব সূক্ষ্ম গন্ধও টের পান, যা আর পাঁচজন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে টের পাওয়া একপ্রকার অসম্ভব।

ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, মিলনের এই অস্বাভাবিক ঘ্রাণশক্তির প্রমাণ মেলে ১৯৭৪ সালে। একদিন হঠাৎ তিনি তাঁর নিজের বাড়িতে এমন একটি তীব্র গন্ধ টের পান—যেটি এর আগে কখনো পাননি তিনি। এই ঘটনার ১২ বছর পর, ১৯৮৬ সালে মিলনের স্বামী লেস মিলনের দেহে পারকিনসন্স রোগ শনাক্ত করা হয়। মাঝের এই দীর্ঘ ১২ বছর নিজের শরীরে ভয়ানক এই রোগ বহন করেছেন লেস। স্বামী পারকিনসন্সে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে বেশ কয়েকজন পারকিনসন্স রোগীর সঙ্গে পরিচয় হয় জয় মিলনের। আর তখনই বিস্ময়কর এক জিনিস আবিষ্কার করেন তিনি। ১২ বছর আগে নিজের স্বামীর শরীরে যে কড়া গন্ধটি পেয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে প্রত্যেক পারকিনসন্স রোগীর শরীর থেকেও সেই একই গন্ধ পান তিনি। এরপর থেকেই বিজ্ঞানীরা জয়ের এই অস্বাভাবিক গুণকে কাজে লাগিয়ে গবেষণা শুরু করলেন।

ইনিই সেই ব্যক্তি, যার ঘ্রাণশক্তি ব্যবহার করে পারকিনসন্স রোগ শনাক্ত করার গবেষণা করা হয়েছে। গবেষকেরা জয় মিলনকে কয়েকজন পারকিনসন্স রোগীর শার্ট এনে দিলেন। সেই শার্টগুলো শুঁকে তিনি আবিষ্কার করলেন, যে বিশেষ গন্ধ তিনি রোগীদের শরীর থেকে পাচ্ছিলেন, সেটি মূলত আসছে রোগীদের পিঠের উপরিভাগ থেকে। এর আগে গবেষকদের ধারণা ছিল, রোগীদের বগল থেকে বিশেষ এই গন্ধ নিঃসৃত হয়। জয় মিলনের অস্বাভাবিক ক্ষমতার প্রমাণ বিজ্ঞানীরা আরেকবার পান পৃথক একটি ঘটনায়। শার্টগুলোর মধ্যে একটি শার্ট ছিল পারকিনসন্স নেই এমন একজনের। কিন্তু ওই শার্ট থেকেও একই রকমের গন্ধ পান জয়। ৯ মাস পর ঠিকই সেই ব্যক্তির শরীরে পারকিনসন্স ধরা পড়ে!

মূলত এ ঘটনার পরপরই ব্রিটেনের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক পেরদিতা ব্যারেন নির্দিষ্ট এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণায় মন দেন। গবেষণা করে তিনি বের করতে চাচ্ছিলেন যে, রোগীদের শরীর থেকে জয় মিলনে যে বিশেষ গন্ধ পাচ্ছিলেন, সেটি ঠিক কী কারণে তৈরি হচ্ছিল।

এর আগে গবেষকেরা দেখেছিলেন, পারকিনসন্স রোগীদের পিঠের উপরিভাগে মোমের মতো একধরনের চিটচিটে পদার্থ অতিরিক্ত মাত্রায় উৎপন্ন হয়। চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘সেবাম’। পেরদিতার অনুমান ছিল, এই সেবামের মধ্যেই এমন কোনো উপাদান লুকিয়ে আছে—যা এমন গন্ধ সৃষ্টির জন্য দায়ী। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ব্যারেন ও তাঁর সহযোগীরা মিলে একটি পরীক্ষার আয়োজন করলেন।

ব্যারেন ও তাঁর দল মোট ৬৪ জন মানুষের শরীর থেকে সেবামের নমুনা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ৪৩ জন ছিলেন পারকিনসন্সে আক্রান্ত, বাকি ২১ জন ছিলেন সুস্থ। গজ কাপড়ে এই সেবামের নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলোকে উচ্চ তাপমাত্রায় রেখে দেন তাঁরা, যেন এর মধ্যে উদ্বায়ী কোনো পদার্থ থাকলে সেটি বাতাসে মিলিয়ে যায়। উদ্বায়ী কোনো পদার্থ আসলেই আছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ম্যাস স্পেকট্রোমেট্রি ও গ্যাস ক্রোমাটোগ্রাফি নামের এই দুটি বিশেষ কৌশল ব্যবহার করেন তাঁরা। এরপর জয় মিলনে সেবামের গন্ধ শুঁকতে শুরু করেন। কাঙ্ক্ষিত সেই উপাদানের গন্ধ পাওয়ামাত্র একটি বোতাম চেপে বিজ্ঞানীদের সেটি নিশ্চিত করে দেন তিনি।

এসিএস সেন্ট্রাল সায়েন্সে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে পেরদিতা ব্যারেন লিখেছেন, ম্যাস স্পেক্ট্রোমিটারে প্রবেশ করানো সেই সেবামগুলোতে চারটি বিশেষ উপাদানের অস্তিত্ব পেয়েছেন তাঁরা। এই উপাদানগুলো সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের দেহে যে পরিমাণে থাকে, পারকিনসন্স রোগীদের শরীরে থাকে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি। পরে নিশ্চিত হয় যে, জয় মিলনে যে গন্ধ পান, সেগুলো এই চারটি উপাদান থেকেই নিঃসৃত হচ্ছে।

ছোট আকারে হলেও পেরদিতা ব্যারেনের এই গবেষণাই প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণা, যেটি কি না পারকিনসন্স রোগীদের শরীর থেকে নিঃসৃত গন্ধের উৎপত্তিস্থল নিশ্চিত করল। এই গবেষণাকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে আরও বড় আকারের গবেষণায় নামতে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। সেখানে তাঁরা একটি ইলেক্ট্রনিক নাক ব্যবহার করবেন। এটি মানুষের পিঠের উপরিভাগের গন্ধ শুঁকে নিশ্চিত করে দেবে যে—কে পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত, আর কে সুস্থ। সাম্প্রতিক এসব গবেষণায় চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসে আরেকটি যুগান্তকারী অধ্যায়ের উন্মোচন হচ্ছে, এ কথা তাই বলাই যায়।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here