আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পুনরায় ক্ষমতায় এলে তাঁর সরকার নগরের ঘিঞ্জি এলাকা সংস্কারের পাশাপাশি বস্তিবাসীদের বসবাসের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ করে দেবে।
শেখ হাসিনা আজ সোমবার দুপুরে রাজধানীর ঢাকা-২ আসনের অন্তর্গত কামরাঙ্গীরচরে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আয়োজিত নির্বাচনী জনসভায় এ কথা বলেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেন, ‘কেবল বড়লোকেরাই ফ্ল্যাটে থাকবে এবং বহুতল ভবনে থাকার সুবিধা পাবে, তা হবে না। মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষেরাও যাতে দৈনিক, সাপ্তাহিক অথবা মাসিক মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে ফ্ল্যাটে থাকতে পারে, আমরা সেই ব্যবস্থাই করে দিচ্ছি, যেখানে সকলে সুন্দরভাবে বাঁচার সুযোগ পাবে। এই লক্ষ্যে আমরা ফ্ল্যাট নির্মাণ করে বস্তিবাসীদের থাকার ব্যবস্থা করে দেব।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘কামরাঙ্গীরচরের যারা ছিন্নমূল মানুষ, বস্তিবাসী, তারা যেমন ভাড়া দিয়ে থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই এই এলাকায় ১০ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিকল্পনা আমরা হাতে নিয়েছি। এই ফ্ল্যাটগুলোতে তারা দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং মাসিক নামমাত্র ভাড়ায় থাকতে পারবে।’ তিনি বলেন, ‘পুরো ঢাকা শহরকে ঘিরে আমরা একটা রিং রোড তৈরি করব। যেই রিং রোডটি হবে সম্পূর্ণ এলিভেটেড। যাতে দ্রুতগামী সমস্ত যানবাহন চলতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ঢাকা শহরকে ঘিরে যে পাঁচটি নদী আছে, সেই নদীগুলো খনন করে এর নাব্যতা ফিরিয়ে এনে সেগুলোর আরও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হবে। এ সময়ে তিনি কামরাঙ্গীরচর খালটি শুকিয়ে ক্ষীণকায় হয়ে আসার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ‘জলাধার আমাদের রক্ষা করতে হবে। এই খাল বন্ধ হওয়া উচিত নয়।’ তিনি জনসভায় উপস্থিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনকে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে খালটি উদ্ধার করে খালে যাতে আরও ভালো পানি থাকে, তার ব্যবস্থা করতে বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি ময়লা ফেলে ফেলে এই খালটি বন্ধ করা হচ্ছে এবং ভূমিখেকোরা এখানের অনেক অংশ দখল করে নিয়েছে। আমি মনে করি কোনো জলাধার বন্ধ করা উচিত নয়, বরং এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা, দুই পাড় বাঁধিয়ে দেওয়া, পানিটা যাতে নিষ্কাশন হয় তার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তাহলে পরিবেশটা ভালো হবে, বাতাসটাও স্বাস্থ্যকর থাকবে এবং মানুষের বসবাস আরও আরামদায়ক হবে। আমরা সেই ব্যবস্থাটা করতে চাই।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা এই খাল দখল করছে, এই দখল করা বন্ধ করতে হবে।’
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ দক্ষিণের সভাপতি আবুল হাসনাতের সভাপতিত্বে সমাবেশে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনসহ ঢাকা দক্ষিণের সাংসদ প্রার্থীরা বক্তব্য দেন।
ঢাকাকে নিয়ে তাঁর সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ঢাকায় আমরা পাতাল রেল করব। তার সমীক্ষার কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। আর নদীগুলো খনন করে এর নৌপথটাও আমরা সচল করে দেব। এই ভাবে ঢাকার যেমন সৌন্দর্য বৃদ্ধি হবে, যোগাযোগ ব্যবস্থাও উন্নত এবং যানজটও মুক্ত হবে। সেদিকে লক্ষ রেখেই আমরা মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। আর বাংলাদেশব্যাপী পরিকল্পনা তো আমাদের রয়েছেই।’
ঢাকার অতীত দুরবস্থার কথা স্মরণ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘পানির জন্য হাহাকার ছিল, ওয়াসার দেড় শ টাকার পানির গাড়ি ১৫ শ করে টাকা দিয়ে কিনতে হতো। দিনভর চলত বিদ্যুতের লোডশেডিং, বিদ্যুৎই ছিল না। রাস্তাঘাট আরও করুণ অবস্থা ছিল, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা বলতে গেলে ছিলই না, একটি অসহনীয় অবস্থা ছিল। যে কারণে বিএনপির এমপিরা জনগণের রুদ্ররোষে পতিত হয়েছিল। এমনকি তাঁদের ধাওয়া খেয়ে বিএনপির এমপিরা পালাত। যার জন্য এক এমপির নামই হয়ে গেল দৌড় সালাহউদ্দিন।’ গত ১০ বছরে তাঁর সরকার পানি ও বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যেমন উৎপাদন বাড়িয়ে মানুষের খাদ্য সংস্থান করেছি, তেমনি সঞ্চালন লাইন তৈরি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়ে গ্রাম পর্যন্ত আমরা মানুষকে বিদ্যুৎ দিয়েছি এবং দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আমরা করেছি। এই কামরাঙ্গীরচর একটি চরম অবহেলিত এলাকা ছিল, যার জলাবদ্ধতা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘এর ১৭টি ইউনিয়নকে আমরা ঢাকা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি করেছি।’ তিনি তাঁর সরকারের সময় কামরাঙ্গীরচরের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘কামরাঙ্গীর চরের ব্যাপক উন্নয়ন আমরা করেছি, সুলতানগঞ্জকে সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছি। তা ছাড়া এখানে আমরা শেখ জামাল সরকারি উচ্চবিদ্যালয়সহ সরকারি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। ৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন ভবন নির্মাণ করে দিয়েছি। আগে এখানে এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল না, তারও ব্যবস্থা করেছি। ৬টি স্কুল-কলেজ এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ এবং শাক্তা উচ্চবিদ্যালয়কে আমরা জাতীয়করণ করেছি এবং ৩১ শয্যাবিশিষ্ট একটি হাসপাতালও করে দিয়েছি। তারানগরে আমরা একটি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করছি এবং এই কামরাঙ্গীরচরে আমরা একটি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় করে দেব। ৯৯ কিমি রাস্তা এবং ৯৫ কিমি পাইপলাইন স্থাপন এবং ড্রেনেজ সিস্টেম চালু করা হয়েছে। ফলে বৃষ্টিতে এখানে আর কোনো জলাবদ্ধতা নাই। ১৯৯টি সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে এবং সব সড়কে এলইডি বাতি সংযোজন করা হয়েছে। ৩৯টি ছোট-বড় কালভার্ট এবং উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে।’
আগামী নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অতীতে যারা ক্ষমতায় ছিল সেই বিএনপি-জামায়াত জোট জনগণের কল্যাণে কিছু দিতে পারে নাই কিন্তু নিজেরা অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছে, বিদেশে অর্থ পাচার করেছে এবং এই পাচার করতে গিয়ে ধরাও পড়েছে। তারা (বিএনপি) এ দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। অগ্নিসন্ত্রাস করে মানুষ হত্যা করেছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে মানুষ হত্যা করেছে।
সরকারপ্রধান বলেন, এই ১০ বছরে যা উন্নয়ন হয়েছে আর ভবিষ্যৎ যা পরিকল্পনা রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারের ধারাবাহিকতা একান্তভাবেই প্রয়োজন। তিনি জনগণের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের কাছে আমার আবেদন থাকবে এই ঢাকা দক্ষিণে আমরা আওয়ামী লীগ এবং মহাজোট থেকে যাঁদের প্রার্থী করেছি, তাদেরকে জয়যুক্ত করতে হবে।’ এ সময় তিনি এই সভার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের প্রার্থীদের জনগণের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
প্রার্থীরা হলেন ঢাকা-২ আসনে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম (নৌকা), ঢাকা-৩ (কেরানীগঞ্জ) আসনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ(নৌকা), ঢাকা-৪ আসনে মহাজোটের প্রার্থী সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা (লাঙ্গল), ঢাকা-৫ আসনে হাবিবুর রহমান মোল্লা (নৌকা), ঢাকা-৬ আসনে মহাজোটের প্রার্থী কাজী ফিরোজ রশীদ (লাঙ্গল), ঢাকা-৭ আসনে হাজি সেলিম (নৌকা), ঢাকা-৮ আসনে মহাজোটের প্রার্থী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন (নৌকা), ঢাকা-৯ আসনে সাবের হোসেন চৌধুরী (নৌকা) এবং ঢাকা-১০ আসনে শেখ ফজলে নূর তাপস (নৌকা)।
এ দেশের কৃষক, শ্রমিক এবং মেহনতি মানুষের জন্যই তাঁর রাজনীতি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনাদের কাছে আমরা ভোট চাই। ভোট দিয়ে আমাদেরকে জয়যুক্ত করুন। বাংলাদেশকে আমরা ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্তভাবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলব। সেই সোনার বাংলাদেশ গড়ার জন্যই ৩০ ডিসেম্বর নৌকা মার্কায় ভোট চাই।’
প্রধানমন্ত্রী জনসভায় নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার জন্য জনগণের প্রতিশ্রুতি চাইলে উপস্থিত জনতা দুই হাত তুলে তাতে সম্মতি জানায়। বঙ্গবন্ধু-কন্যা জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আমি আছি আপনাদের সেবায়। কারণ আপনাদের সেবা করাই আমার কাজ।’