জয়িতা ভট্টাচার্য : বাংলা সাহিত্যে নারী কালি ও কলমের মতোই অনিবার্য।নারীরহস্যময়ী,ছায়াবৃত,তার দেহবল্লরী তার মায়াময় রূপ সবই সাহিত্যেরউপাদান।চর্যাপদ ও বৈষ্ণব পদাবলির মূল রাধা কৃষ্ণ প্রেমলীলাকে ভক্তিএকসঙ্গে দেখা হয়েছিলো।

যদিও বাংলা সাহিত্যের প্রাচ্যের মতো কোনো পর্ববিভাগ যথার্থরোমান্টিক যুগ,আধুনিক ও উত্তরাধুনিক যুগের স্পষ্ট বিভাজন নেই তবুলেখনশৈলীর ও ভাবগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আমরা প্রায় প্রথম নারীর গভীর ভূমিকা ও গুরুত্বদেখতে পেলাম।তাঁর নারী কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কল্পনার নারী নয়।তাঁরা তাঁর বাস্তব জীবনে ও মনোজগতে স্পষ্ট প্রভাব ফেলেছেন।

অনুপ্রেরণাদাত্রী কাদম্বরী দেবীকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন অনেককবিতা,কখনো স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর জন্য বিরহকাতর প্রেমের কবিতা।যাদের স্পর্শ তাঁকে একদ- শান্তি দিয়েছেন, লিখেছেন তাঁদের নিয়েওকবিতা।

“আঙিনাতে যে আছে অপেক্ষা করে

তার পরনে ঢাকাই শাড়ি,কপালে সিঁদুর “।

আবার চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে কবি নারীর মাধুর্য ও শক্তিশালী রূপের প্রকাশকরেছেন।কুরূপা ও সুরূপার মধ্যে অপূর্ব দোলাচল।

“পূর্বে উল্লিখিত কবিদের সৃষ্ট নারীরা সকলেই যেন স্বপ্ন।ফ্যান্টাসি।তাদের বাস্তবের শক্ত মাটিতে ,কষ্ট যন্ত্রণা র লেশমাত্র ছোঁয়না।কেবল মাধুর্য।জৈবিক ও জীবন জারিত নারীর কথা বলার ঝুঁকি কোনো কবি কিন্তু নেননি জনপ্রিয়তার বা বানিজ্যমূল্যের কথা ভেবে হয়তোবা!”

আরেকটু অগ্রসর হলে দেখা যায় কবি নজরুল ইসলাম নারীকে কবিতায়কখনো মাতৃরূপে পেতে আকুল হয়েছেন আবার প্রেয়সীর জন্য ব্যাকুলতাতাঁর বিরহের কবিতায় “প্রিয়া রূপ ধরে এতদিনে এলে আমার কবিতাতুমি/আঁখির পলকে মরুভূমি হয়ে গেল বনভূমি “।স্বয়ং কবিতাকেইনারীরূপের কল্পনা করেছেন।

 অন্যদিকে আধুনিক যুগে কবি জীবনানন্দ ভিন্ন মেরুতে থেকে নারীকেঅবলম্বন করে কবিতা লিখেছেন।নারী সেখানে ইমেজারি ওপরমাপ্রকৃতির দ্যোতক।কখনো সুপ্ত কামনার প্রতীক কখনো বা শূন্যহৃদয়ের প্রতিচ্ছবি।এভাবেই আজ বিশ্ব বাংলার এক ফ্যান্টাসি “বনলতাসেন” ক্লাসিক হয়ে গেছেন।

“কোথায় গিয়েছ তুমি আজ এই বেলা

মাছরাঙাটা ভোলেননি ত দুপুরের খেলা

শালিখ করেনা তার নীড় অবহেলা

উচ্ছাসে নদীর ঢেউ হয়েছে সফেন

তুমি নাই বনলতা সেন”

পরবর্তী কালে আরেক নারী বিখ্যাত হয়ে গেছেন কবিতার মাধ্যমে।তিনিসুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ” নীরা”।নীরাকে তিনি দেখেননি তাঁর দেখা বিভিন্ননারী সান্নিধ্যের কোনো কোনো মুহূর্ত দিয়ে গড়া এই আদ্যন্ত কাল্পনিকনারী।

“নীরার শরীর খারাপ হলে সবার মন খারাপ হয়”।

“…..আজই কি ফিরেছ?

স্বপ্নের সমুদ্রে সেকি ভয়ঙ্কর মেদহীন শব্দহীন যেন

তিনদিন পর আত্মঘাতী হবে

হারানো আংটির মতো দূরে

তোমার দিগন্ত দুই উড়ুক্কু ডুবে কোনো

জুয়াড়ির সঙ্গিনীর মতো

অথচ একলা ছিলে,

ঘোরতর স্বপ্নের ভিতর তুমি একা”

সুনীল নিজেই দুঃখ করে বলেছেন তিনি অনেকবার চেষ্টা করেছেননীরাকে রক্ত মাংসের মানুষী হিসেবে উপস্থাপন করতে কিন্তু তা প্রতিবারপেরিয়ে গেছে শিল্পীর সীমানা।

নীরা একটা কনসেপ্ট হয়ে থেকে গেছে।আবেগ বর্জিত ও কোনো শরীরীআবেদনবিহীন এক আইডিয়াল প্রেয়সী এবং তুমুল জনপ্রিয়।

 পূর্বে উল্লিখিত কবিদের সৃষ্ট নারীরা সকলেই যেন স্বপ্ন।ফ্যান্টাসি।তাদেরবাস্তবের শক্ত মাটিতে ,কষ্ট যন্ত্রণা র লেশমাত্র ছোঁয়না।কেবল মাধুর্য।কিন্তুএক প্রেয়সী সে বাস্তবিক তা হয় না।তারও পরাজয় আছে।

ক্লেশ,বেদনা মাটির সোঁদা গন্ধে ভরা তার শরীর।

সেই জৈবিক ও জীবন জারিত নারীর কথা বলার ঝুঁকি কোনো কবি কিন্তুনেননি জনপ্রিয়তার বা বানিজ্যমূল্যের কথা ভেবে হয়তোবা!

ফলে এইসব নারীকে ভাবতে গেলে কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়।ট্র্যাডিশনালএলিটিস্ট কোনো নারী যার গমের মতো রং ,মসৃণ আজানুলম্বিতকেশ,কাজল আঁখি এসব মনে করে নেওয়া যায় ।

ঠিক এই এলিটিস্ট কনসেপ্ট টাই ভেঙে দিয়েছেন হাংরি আন্দোলনে রপুরোধা পোস্টমডার্ন কবি ,সাহিত্যিকরা মলয় রায় চৌধুরী।

তার প্রেমিকা ” চুমু খেয়ে টিস্যু দিয়ে ঠোঁট মুছে নেয়” ,

“মাথা বেয়ে ওঠে বুনো মহিষের সিং

ঝড়ের মস্তি দিয়ে পাউডার মাখিয়ে দিস অবন্তিকা ” বা হরিণের নাচেরসঙ্গে কাতুকুতু ”এমন সব অতিবাস্তব নিত্য ব্যবহৃত শব্দ প্রয়োগ করারঝুঁকি,এমন অভিনবত্ব বাংলা প্রেমের কবিতায় মেটাফর ব্যবহার করারঝুঁকি বোধহয় একমাত্র মলয় রায় চৌধুরী নিতে পেরেছেন ।

 মলয় তাঁর কবিত্বের ভারী চোগাচাপকান ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পাঠকেরকাছে হয়ে উঠেছেন এক স্বাভাবিক কামার্ত প্রেমিক।তাঁর সাহিত্য সত্ত্বাবিলীন হয়ে গেছে মানবসত্ত্বায়।

আর তাই তাঁর প্রিয় নারী “অবন্তিকা”এক ব্যতিক্রমী উত্তরাধুনিক নারী।মলয় অনায়াসে লেখেন,

“বোঁটায় তোর গোলাপ রং অবন্তিকা

শরীরে তোর সবুজ ঢাকা অবন্তিকা

আঁচড় দিই আঠা বেরোয় অবন্তিকা

চাটতে দিস নেশায় পায় অবন্তিকা

টাটিয়ে যাস পেট খসাস অবন্তিকা “(পপি ফুল)

“কবিতায় নারীদের মধ্য ইমেজারি, ফ্যান্টাসি বা শুধু মাধুর্য ভেঙে দিয়েএকমাত্র মলয় রায় চৌধুরী সৃষ্টি করতে পেরেছেন উত্তরাধুনিকনারী”অবন্তিকা ” এক রক্ত মাংসের নারী তার যাবতীয়যৌনতা,রিরংসা,ক্রোধ …..তার কৃষ্ণকালো দেহ বল্লরী নিয়ে সে জৈবিককবিতা।যে কবিতা পুরুষ এমনকি নারী পাঠককে নড়িয়ে দেয়।

“অবন্তিকা”কোনো মিথ নয় সে পাশের বাড়ির র মেয়েটি ,সে ইমলিতলারনারী,সে অন্ত্যজ মুসলমান নারী অথবা লক্ষ্নৌ এর হারেম থেকেবিতারিত হতদরিদ্র নারী ,উপজাতি নারী।

।মলয় রায়চৌধুরীর অবন্তিকা তীব্র শরীরী।

এই প্রসঙ্গে বলাই যায় মলয় রায় চৌধুরী জীবনের বাস্তবতাকে সাহিত্যকরে তুলেছেন।তা ইচ্ছে মতো ম্যাজিক রিয়ালিজম এ উত্তীর্ণ হয়েও সেজীবন্ত এক শারীরিক নারী।

এর আগে কবিরা কাব্য সাযুজ্য শব্দ র বেড়া টপকে যাবার সাহস পাননি।কিন্তু অবন্তিকাকে মলয় রায়চৌধুরী টেনে হিঁচড়ে গেঁথে দিয়েছেন মাটিরগভীরে।

অবন্তিকা ‘শরীরেই সার্বভৌম মননে নয় মনে করে যেসব মহিলা, মলয়তাঁদের অনায়াসে ডাকতে পারেন ‘মুখপুড়ি’।

অথচ পরক্ষণেই পড়ি

“শ্বাস ভ্যাপসা চোখের তলায় যুদ্ধ চিহ্ন এঁকে ডেথ মেটাল মাথাদোলাচ্ছিস”এর মতো যাদুবাস্তবতা।

চ-ী তে যেভাবে দুর্গাকে বর্ণনা করা হয়েছে প্রায় সেভাবেই দুঃসাহসী এইকবি লিখেছেন,

“অবন্তিকা বললি তুই:

আর্কিমিডিস দিলেন দেহের ঘনত্ব।

রেঁধে দেকার্তে দিলেন শরীরের বাঁকগুলো।

ইউক্লিড দিলেন গোপন ত্রিভুজ!

লোবাচোভস্কি দিলেন সমন্বিত আদল!

ব্রহ্মগুপ্ত দিলেন মাংসময় বুকের নীঁখুত বাতুলতা!

শ্রীধর দিলেন আয়তন!

আর তুই কী দিলি?অক্ষরে সাজানো যত ফাঁকা মন্তর?

আমি বললুম :

আমি দিয়েছি প্রেম

অবন্তিকা তুই বললি

প্রেম ত আলো হয়ে বেগে আসে

আর তত বেগে চলে যায়”

অনবদ্য ভাষায় মলয় রায় চৌধুরী র অবন্তিকা তাই আল্ট্রামর্ডান একপরিপূর্ণ ও ইউনিভার্সাল নারী।কবিতা নারী।

পোস্টমডার্ন সাহিত্যে বাংলা কবিতায় নারীর এই ক্রম বিবর্তন কবিতাকেবিশ্ব সাহিত্য সম মানে উত্তোররণ করেছেন বিভিন্ন কবি যার পথিকৃত সেইআধুনান্তিক কবি রবীন্দ্রনাথ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here