ইফতেখারুজ্জামান

করোনাভাইরাস মহামারিকে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় দুর্যোগ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আর এই মহামারি মোকাবিলায় সব পর্যায়ে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় আরও বেশি উচ্চমাত্রার সুশাসন, দুর্নীতি প্রতিরোধ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি অপরিহার্য। আর এ বিষয়ে আমরা সংকটের শুরু থেকেই সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করে চলেছি। এর প্রতিফলনও দেখেছি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায়। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে এই দুর্যোগ মোকাবিলার কোনো কার্যক্রমে দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। অথচ দুর্যোগকালীন জাতীয় বাজেটে তার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী, সরাসরি দুর্নীতিসহায়ক একটি হতাশাব্যঞ্জক অবস্থান আমরা দেখলাম।

বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে সচল করা, রাজস্ব আয় বাড়ানো, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা ও কর্মসংস্থানের নামে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা সাদা করার যে সুবিধা বরাবর দেওয়া আছে, তা আরও বাড়ানো হলো। আবার অর্থ পাচারের মতো অপরাধকে ৫০ শতাংশ করের মাধ্যমে বৈধতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।

অর্থাৎ এ রকম এক গুরুতর অপরাধকে কেবল জবাবদিহি কর আদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে এ ক্ষেত্রে আইনের শাসন আর আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের কী দশা হবে বাজেট–প্রণেতারা ভেবেছেন বলে মনে হচ্ছে না। যেভাবেই এর পক্ষে ব্যাখ্যা দেওয়া হোক না কেন, এর ফলে নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে বরং অর্থ পাচারের এক মহোৎসবের সুযোগ তৈরি হবে। প্রস্তাবগুলো দুর্নীতিসহায়ক, স্ববিরোধী, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান-পরিপন্থী।

 আবাসন খাতের পাশাপাশি এবার জমি কেনা ও উন্নয়ন এবং শেয়ারবাজারের বিনিয়োগেও অনৈতিকতাকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। এর পরিসরই শুধু বাড়ছে না, বরং অর্থের বা সম্পদের উৎস নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের প্রশ্ন করার বিধানটিও অকার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। এই প্রস্তাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ‘শূন্য সহনশীলতার’ ঘোষণা আর ‘অপ্রদর্শিত আয়’–এর পোশাকে কালোটাকা ও এর মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ আর অর্থ পাচারকে বৈধতা দেওয়া শুধু পরস্পরবিরোধী নয়, বরং সরাসরি দুর্নীতিসহায়ক এবং সরকারপ্রধানের অঙ্গীকারের প্রতি অবমাননাকর।

 বছরের পর বছর এ ধরনের সুবিধা দিয়ে দেশের অর্থনীতির কোনো উপকার হয়নি, উল্লেখযোগ্য কোনো রাজস্ব আদায় হয়নি, কোনো বিনিয়োগ তো নয়-ই। অথচ অনৈতিকতা প্রশ্রয় পেয়েছে আর সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সংবিধানের ২০ (২) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী এই ব্যবস্থা সৎ পথে উপার্জনকারী নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক। যে খাতগুলোতে প্রত্যক্ষভাবে এই সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, সেখানে সৎ পথে উপার্জনকারী জনগোষ্ঠীর প্রবেশকেও বৈষম্যমূলকভাবে বন্ধ করা হচ্ছে। অন্যদিকে সরকার প্রকারান্তরে দুর্নীতি ও অবৈধতাকে লাইসেন্স দিয়ে জনগণকে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হতে উৎসাহ দিচ্ছে।

 সরকার এসবের বিশাল ঝুঁকি উপলব্ধি করে এই আত্মঘাতী অবস্থান থেকে সরে আসবে, এই আশা করতে চাই। বিশ্বাস করতে চাই, সরকার এখনো মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষীদের হাতে জিম্মি হয়ে যায়নি।

 অন্যদিকে, কোভিড-১৯ সংকটে দেশের স্বাস্থ্য খাতের দুর্বল অবস্থা অত্যন্ত করুণভাবে ফুটে উঠেছে। স্বাস্থ্য খাতের এমন ভঙ্গুর পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর স্বাস্থ্য খাতে অপর্যাপ্ত অর্থায়ন, সুশাসনের ব্যাপক ঘাটতি আর লাগামহীন দুর্নীতির কারণে এই বিপর্যয় নিয়ে এসেছে। ক্রয় ও অবকাঠামো খাতের বরাদ্দকে স্বার্থান্বেষী মহল যোগসাজশ করে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজেদের সম্পদ বাড়ানোর সহজ উপায়ে রূপান্তরিত করতে এতটাই তৎপর থেকেছে যে স্বাস্থ্য অবকাঠামো ও সেবার মান বাড়ানোর বিষয়টি নিতান্তই উপেক্ষিত ছিল। বরাদ্দের বিবেচনায় স্বাস্থ্য খাত যেমন উপেক্ষিতই থাকল, তেমনই বরাবরের মতোই সিংহভাগ আবারও গেল জনপ্রশাসনে।

সংকট উত্তরণে প্রাধান্যযোগ্য আলোচিত খাতে বাড়তি বরাদ্দের পাশাপাশি বাজেটে প্রত্যাশা ছিল স্বাস্থ্যসহ সব সরকারি ক্রয় খাতে কৃচ্ছ্রসাধন নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট পথনকশা। একইভাবে প্রত্যাশা ছিল হতদরিদ্র জনগণের জন্য সামাজিক সুরক্ষা এবং দুর্যোগের কারণে কর্মহীনদের কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে দুর্নীতি ও স্বার্থান্বেষীদের জবরদখল প্রতিরোধ এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার কার্যকর পথনির্দেশ।

 ত্রাণ কার্যক্রম ও হতদরিদ্রের নগদ সহায়তা কার্যক্রমে অমানবিক অনিয়মের পুনরাবৃত্তি দেশবাসী দেখতে চায় না; যেমন চায় না এন৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারি বা বালিশ-কেটলি-পর্দার মতো সরকারি ক্রয় খাতে দুর্নীতির মহোৎসব। মানুষ চায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার ঘোষণার কার্যকর বাস্তবায়ন। অথচ বাজেট ঘোষণা দিল দুর্নীতির অধিকতর সুরক্ষা ও তার অবারিত বিচারহীনতা। তাহলে কি ভাবতে হবে যে দুর্নীতিলিপ্ত, দুর্নীতিসহায়ক ও দুর্নীতি-সুরক্ষাকারী মহল এত বেশি ক্ষমতাবান যে তারা প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকারকে অর্থহীন প্রমাণ করতে দ্বিধা করে না?

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here