মোঃ মঈনুদ্দিন চৌধুরী

বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষা নীতি -২০১০ প্রণয়ন করা হয়। শিক্ষার সকল বিষয়ের পাশাপাশি এমপিও শিক্ষক সংক্রান্ত বিষয়টিও উক্ত নীতিমালায়  সীমিত আকারে উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু শিক্ষা সেক্টরে অধিক অবদান  থাকা সত্তেও তারা একটি আদর্শ মান সম্পন্ন বা কাঙ্খিত মাত্রার বেতনভাতা ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শুধু তা-ই নয়, একই শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী এবং একই সিলেবাস ও বই অনুসরন করা সত্তেও সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের তুলনায়  এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকদের বেতনভাতা ও সুযোগ-সুবিধার রয়েছে  অকল্পনীয় পার্থক্য, যা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক বলে বিবেচিত। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের বেতনভাতা ও সুযোগ-সুবিধার এরূপ বৈষম্য মনস্তাত্তিকভাবে শিক্ষকদের পারফরমেন্সর উপর মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলছে বলে মনে হয়।তাছাড়া শিক্ষা ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্যের মাধ্যমে সরকারি শিক্ষকদের কার্যসন্তুষ্টি বৃদ্ধি পেলেও অন্যদিকে তাদের জাতিভাই এমপিও নিবন্ধিত  শিক্ষক সম্প্রদায়ের কার্য অসন্তুষ্টি   বৃদ্ধি পেয়েছে , যা ফ্রেডারিক হার্জবার্গের দ্বি-উপাদান তত্তের কথা স্মরন করিয়ে দেয়। এর ফলে তারা তুলনামুলকভাবে নিজেদেরকে অতি নগন্য মনে করায় তাদের মনোবল হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসও কমে যাচ্ছে। এটি বাংলাদেশের শিক্ষা সেক্টরের জন্য মোটেও সুসংবাদ নয়। কেননা আত্মবিশ্বাসের সাথে পারফরমেন্সের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এরূপ  বৈষম্যমূলক বেতন কাঠামোর উপস্থিতি চিন্তাও করা যায়না।এমনকি আমাদের দেশের জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০ এ সকল ধারার, সকল স্তরের  শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন স্কেল প্রবর্তনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অনেকে মনে করেন, আমলাতান্ত্রিক বাধার কারনে এ ব্যাপারে সরকারসহ সংস্লিষ্ট সকলেই  নিরব ভূমিকা পালন করছেন।

জাতীয় শিক্ষা নীতিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের উন্নয়ন নিয়ে কিছু কৌশল বা ব্যবস্থার কথা বলা হলেও এটির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় ভিন্নতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। অর্থাৎ শিক্ষানীতির কৌশলের সাথে বাস্তবায়নের মিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। এটি সত্য যে, জাতীয় শিক্ষানীতির কিছু অংশ সরকার চাইলে পরিবর্তন করতেই পারেন । কিন্তু  আমলাতান্ত্রিক   বাধার কাছে নতি স্বীকার করে  ,  শিক্ষক এবং  শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য অত্যাবশ্যক  স্পর্শকাতর  বিষয়ের বাস্তবায়ন  থেকে সরে আসা  সরকারের উচিত হবেনা বলে আমি  মনে করি।

জাতীয় শিক্ষা নীতি- ২০১০ এর কৌশল নং -৩ অনুসারে জাতীয় শিক্ষানীতির আওতাধীন ও এমপিও নিবন্ধিত সকল ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য, শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষন, বদলি ও পদোন্নতির বিষয়ে বিভিন্ন কৌশলের কথা বলা হয়েছে।

এসকল কৌশল সমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এমপিওভুক্ত বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার জন্য মেধাভিত্তিক ও উপযুক্ত শিক্ষক নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারি কর্ম কমিশনের অনুরূপ একটি বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন গঠন। উক্ত কৌশলে আরও বলা হয়েছে যে, পৃথক বেসরকারি শিক্ষক  নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলে বর্তমানে বিদ্যমান ‘এনটিআরসিএ র আবশ্যকতা থাকবেনা। অর্থাৎ এটিকে বিলুপ্ত করা হবে।

বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, পৃথক বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু  অনেক দিন অতিবাহিত হলেও,বর্তমান সময়ে এ সম্পর্কিত আর কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছেনা।

তাছাড়া এনটিআরসিএ  কর্তৃক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হলেও বিভিন্ন জটিলতার কারনে সংস্লিষ্ট    সুপারিশকৃত শিক্ষকগন পদায়নকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে যোগদান না করায় অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষকের পদ সমূহ শূন্য রয়েছে। পরিনতিস্বরূপ , উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পাঠদান কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অতীতে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিতর্ক বা প্রশ্ন উঠলেও   একথা বলা সমীচিন হবেনা যে, এজাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের সকল শিক্ষকই অযোগ্য । কেননা  এমপিওভুক্ত ইনডেক্সধারী সকল শিক্ষকই নির্দিষ্ট নীতিমালা  দ্বারা  নির্ধারিত একটি কাম্য বা নির্দিষ্ট মাত্রার শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী ও আইনানুগ নিয়োগবোর্ড কর্তৃক পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ন  হয়ে নিয়োগ প্রাপ্ত।

একজন শিক্ষক এক দিনে গড়ে ওঠেনা, এমপিওভুক্ত  শিক্ষকও তার ব্যতিক্রম নয়।। অনেক বছর   যাবত ক্লাসে  পাঠদানের  মাধ্যমে অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং সরকারি নিয়ম মোতাবেক বিভিন্ন প্রশিক্ষন গ্রহন করে তাদের  বেশিরভাগই এখন    উল্লেখযোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষকে পরিণত হয়েছেন।  কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়  সনদধারী, অভিজ্ঞ, ও প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত শিক্ষককে অযোগ্য শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করাটা  সঠিক নয়।

তাছাড়া  রাষ্ট্রপতির ১০% সরাসরি কোটার মাধ্যমে (পিএসসির মাধ্যমে সরকারি কলেজসমূহে বিভিন্ন উচ্চতর পদে) নিয়োগ পরীক্ষা এক যুগেরও বেশি সময় যাবত স্থগিত রয়েছে।  এর ফলে এমপিওভুক্ত কলেজসমূহে কর্মরত বিভিন্ন উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকগন  যেমন-এমফিল/পিএইচডি /প্রথম শ্রেনী প্রাপ্ত শিক্ষকগন  উচ্চতর পদে সরকারি কলেজে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

তবে শত শত উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষক এমপিওভুক্ত কলেজসমূহে আজও  নিরুপায় হয়ে কর্মরত থাকায় উক্ত কলেজসমূহের ছাত্র-ছাত্রীগন  যথেষ্ট পরিমানে উপকৃত হচ্ছে, যদিও সরকার থেকে তাদেরকে প্রনোদিত করার জন্য  কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি। অন্যদিকে আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারনে সংস্লিষ্ট কলেজসমূহ তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারছেনা।

কিন্তু সরকারি কলেজের চিত্র ভিন্ন। কেননা সেখানে উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের জন্য বিশেষ ইনক্রিমেন্ট, বিশেষ পদোন্নতিসহ প্রশাসনের উচ্চতর পদে  যাওয়ার সুবন্দোবস্ত রয়েছে, যা এমপিওভুক্ত উচ্চতর ডিগ্রিধারী গবেষক শিক্ষকগন কল্পনাও করতে পারেনা।

জাতীয় শিক্ষা নীতিতে এমপিওভুক্ত কলেজসমূহে বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট যোগ্যতার নিরিখে(উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন, মৌলিক গবেষনা কর্ম, শিক্ষাদান পদ্ধতি উন্নয়ন) প্রভাষক হতে সহকারী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক হতে  সহযোগী অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপক হতে অধ্যাপক  পর্যন্ত পদোন্নতি দানের কথা বলা হয়েছে।  কিন্তু বাস্তবে, এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামোতে এই সুবিধা শুধুমাত্র সহকারী অধ্যাপক পদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে।

তাছাড়া, ডিগ্রি কলেজে সহকারী অধ্যাপক পদ বহাল রাখা হলেও উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে এর নতুন নামকরন করা হয়েছে ‘সিনিয়র প্রভাষক’। এর কারন হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে বলা হয়েছে যে, এর মাধ্যমে তারা  ইন্টারমিডিয়েট কলেজ শিক্ষক এবং ডিগ্রি কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে পার্থক্য দেখাতে চেয়েছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইন্টারমিডিয়েট কলেজ শিক্ষকদের পদমর্যাদা  সিনিয়র প্রভাষক হিসেবে নামকরন করলেও তাদের  বেতনস্কেল ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপকদের সমান রাখা হয়েছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন করা হয়নি। এখন বিষয়টি নিয়ে অনেক শিক্ষকের প্রশ্ন হচ্ছে, এমপিওভুক্ত  বেসরকারি  ইন্টারমিডিয়েট কলেজে  সিনিয়র প্রভাষক থাকলে সরকারি  ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয় কেন?

গভীরভাবে বিশ্লেষন করলে বোঝা যায় যে, সরকারি-বেসরকারি বিভাজনের পাশাপাশি এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যেও সুকৌশলে বিভাজন তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ  আমলাতান্ত্রিক কৌশল হিসেবে এখানে ব্রিটিশ প্রবর্তিত ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ পলিসি  বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অনেকে মনে করেন, শিক্ষক সম্প্রদায় কর্তৃক   সকল ধারার  ও  সকল পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বা স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের বিষয়টি যেন সমবেতভাবে দাবি করার বা সামনে আনার সুযোগ না পায়  (যা জাতীয় শিক্ষা নীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে) সে জন্যই    মূলত ধারাবাহিকভাবে এরূপ বিভাজন করা হচ্ছে।

অন্যদিকে ২০১০ সালের এমপিও নীতিমালায় ডিগ্রি কলেজে সহযোগী অধ্যাপকের বিধান সংযোজন করা হলেও রহস্যজনক কারনে ২০১৮ এর নীতিমালায় তা বাতিল করা হয়, যা আজও অব্যাহত আছে। অর্থাৎ জাতীয় শিক্ষানীতির কৌশল মোতাবেক এমপিওভুক্ত করেজসমূহের  যোগ্যতাসম্পন্ন ও অভিজ্ঞ শিক্ষকগন সহকারী অধ্যাপক হতে সক্ষম হলেও সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে পদোন্নতি  প্রাপ্তি থেকে তারা বঞ্চিত।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারিপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিবর্গের কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির অধিকার থাকলেও এমপিওভুক্ত শিক্ষকগনের সে অধিকার থাকবেনা কেন? তারা কি স্বাধীন দেশের নাগরিক নয়? বাংলাদেশের সংবিধানকি তাদের  পদোন্নতি পাওয়ার অধিকার প্রদান করেনি?

জাতীয় শিক্ষানীতির কৌশলে বলা হয়েছে,‘‘ বেতন বৃদ্ধি সফল প্রশিক্ষন ও উচ্চতর যোগ্যতা অর্জনের সাথে সম্পর্কিত হবে। বৃহত্তর পরিসরে শিক্ষকদের মৌলিক সুবিধাদি নিশ্চিত করে অন্যান্য সুবিধাদি অর্জিত যোগ্যতার সাথে সম্পর্কিত করা হবে।’’

কিন্তু উচ্চতর ডিগ্রিকে, সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে  অন্যান্য মানদন্ডের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদ সৃষ্টি না হওয়ায় কর্মরত সহকারী অধ্যাপকগন এরূপ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

তাছাড়া পদোন্নতির  অন্যতম মানদন্ড হিসেবে জাতীয় শিক্ষা নীতির কৌশলে প্রশিক্ষনের কথা বলা হলেও এমপিও নীতিমালায় এটিকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি বা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

জাতীয় শিক্ষা নীতির কৌশলে,সরকারি প্রয়োজনে এমপিওভুক্ত শিক্ষকগনকে সমপর্যায়ের পদে বদলি করার কথা বলা হলেও বাস্তবে  আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছিনা।

এককথায় বলা যায়, জাতীয় শিক্ষা নীতিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষক সংক্রান্ত যে কৌশল প্রণয়ন করা  হয়েছে তার সাথে  প্রকৃত বাস্তবায়নের মিল খুবই নগণ্য।

সরকার    এমপিওভুক্ত শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষনের প্রতি কিছুটা গুরুত্ব দিলেও শিক্ষকদের বেতনভাতা, সুযোগ-সুবিধা, পদোন্নতিসহ অন্যান্য স্পর্শকাতর  বিষয়ে  তুলনামুলকভাবে কম গুরুত্ব দিয়েছেন, যা শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি  বৈষম্য নিরসনে সহায়ক নয়।

আমরা মনে করি, একবিংশ শতাব্দীর  যুগে শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষার সার্বিক মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরনের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন করা অতীব জরুরি। বিচ্ছিন্নভাবে নয়, সম্ভবত সকল এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একযোগে জাতীয়করনই হতে পারে এর অন্যতম মহৌষধ।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, শংকুচাইল ডিগ্রি কলেজ, বুড়িচং, কুমিল্লা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here