অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল :
[সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: এই লেখাটি দেশের সত্যিকারের শিক্ষাবিদ ও নীতিবান ভাইস চ্যান্সেলরদের জন্য প্রযোজ্য নয়।]
এক.
যারা খবরের কাগজ পড়েন, তারা সবাই জানেন কিছুদিন দেশে দুই ধরনের দুর্নীতি নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড হচ্ছে। একটি হচ্ছে- যুবলীগ নেতাদের ক্যাসিনো ব্যবসা, অন্যটি ভাইস চ্যান্সেলরদের দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা। যুবলীগ কিংবা ছাত্রলীগের অপকর্মের কাহিনি শুনে কেউ বেশি অবাক হয় না। (তারপরও সরকারি ইঞ্জিনিয়ারদের হাজার কোটি টাকা ঘুষ দেয়ার খবরটি মনে হয় হজম করা যথেষ্ট কঠিন, টাকাগুলো ট্রাকে করে নিতে হয় কিনা ব্যাপারটা জানার আমার এক ধরনের কৌতূহল আছে।) যুবলীগ-ছাত্রলীগের অপকর্মের কথা শুনে দেশের মানুষ অবাক না হলেও ভাইস চ্যান্সেলরদের অপকর্মের কথা শুনে সবাই বুকের মাঝে এক ধরনের ধাক্কা খায়। একটি দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হচ্ছেন ভাইস চ্যান্সেলর। যখন তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি কিংবা অনৈতিক কাজকর্মের অভিযোগ আসে, তখন আমরা কার দিকে মুখ তুলে তাকাব, বুঝতে পারি না।
আমি এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পঁচিশ বছর কাটিয়ে বিদায় নিতে যাচ্ছি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুখ-দুঃখ, সাফল্য-ব্যর্থতা (এবং কখনও কখনও হীনতা-নীচতা) আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। তাই আমার মনে হয়েছে, কীভাবে দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কাজ করেন সে সম্পর্কে একটা ধারণা দেই। তবে কাজটা খুব গুছিয়ে করতে পারব বলে মনে হয় না। যেকোনো বিষয় বিশ্লেষণ করতে হলে প্রথমে বিষয়টা খুব ভালো করে বুঝতে হয়। আমি ভাইস চ্যান্সেলরদের একেবারে গোড়ার বিষয়টিই বুঝতে পারি না- কেন একজন শিক্ষক ভাইস চ্যান্সেলর হতে চান? একজন শিক্ষকের জীবন কত আনন্দের, আমি যখন আমার শিক্ষকতা জীবনের পঁচিশ বছরের কথা চিন্তা করি, তখন সেখানে কত মধুর স্মৃতি। সেই তুলনায় একজন ভাইস চ্যান্সেলরের জীবনে দাফতরিক কাজ ছাড়া আর কী আছে? স্যুট-টাই পরে একটির পর আরেকটি মিটিং, একটা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দেয়ার পর আরেকটা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ, এই জীবনের জন্য কেন একজন লালায়িত হয়?
কিন্তু আমি লক্ষ করেছি, শিক্ষকরা ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার জন্য খুব ব্যস্ত। সে জন্য লবিং করতে হয় এবং লবিং করে কাজ হয়। আমি নিজের কানে একজন ভাইস চ্যান্সেলরকে বলতে শুনেছি, ‘যদি কেউ দাবি করে লবিং না করে সে ভাইস চ্যান্সেলর হয়েছেন, তাহলে বুঝতে হবে তিনি চরম মিথ্যাবাদী (ড্যাম লায়ার!)’ এই বিষয়টি আমি কোনো একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম এবং সে জন্য ভাইস চ্যান্সেলরদের সংগঠনটি ক্ষুব্ধ হয়ে আমার বক্তব্যের বিরুদ্ধে একটা বিবৃতি দিয়েছিলেন। নিজের কানে যেটা শুনেছি সেটা বলেছি, সে জন্য আমার ওপর রাগ হয়ে লাভ কী? আমি ধীরে ধীরে টের পেতে শুরু করেছি ভাইস চ্যান্সেলরের পদটি এক ধরনের পুরস্কার। যারা খাঁটি শিক্ষাবিদ, তারা এই পুরস্কারের যোগ্য নন। যারা চুটিয়ে শিক্ষক রাজনীতি করেন শুধু তারা এই পুরস্কারের যোগ্য প্রার্থী। সাধারণত পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা এই পুরস্কারের অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে, এখানে যথেষ্ট অভিজ্ঞ শিক্ষক আছেন কিন্তু তারপরও অর্ধেক থেকেও বেশি সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাইস চ্যান্সেলর দেয়া হয়েছে। এখন যেহেতু আওয়ামী লীগের সরকার কাজেই শিক্ষকরা নীলদলের শিক্ষক, তবে তাদের কেউ কেউ দল বদল করে নীলদলে এসেছেন। ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার জন্য আদর্শটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, বর্তমান রঙটি গুরুত্বপূর্ণ। যারা শিক্ষক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন তাদের সামনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডালা খুলে দেয়া হয়, তারা সেখান থেকে কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা সাধারণত ঢাকাতেই স্থায়ীভাবে থাকেন। তাই তারা কোন বিশ্ববিদ্যালয়টি বেছে নেবেন সেটা অনেকটুকু নির্ভর করে ঢাকা শহরের সঙ্গে যোগাযোগ কী রকম তার ওপর। বিমান যোগাযোগ না থাকলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তারা আসতে চান না। মফস্বলের বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই-একদিন কাটিয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় বিমানে ঢাকা চলে যান। সেখানেই থাকেন, অন্য কাজকর্ম করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সম্মানিত শিক্ষক কেন ভাইস চ্যান্সেলরের মতো একটা পদের জন্য এত ব্যস্ত থাকেন, সেটা আজকাল একটু একটু করে বুঝতে শুরু করেছি। আমি নিজের কানে একজন ভাইস চ্যান্সেলরকে বলতে শুনেছি, ‘আগের ভাইস চ্যান্সেলর এখান থেকে কমপক্ষে ত্রিশ কোটি টাকা নিয়ে গেছেন।’ একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন ও সুযোগ-সুবিধার বাইরে একজন ভাইস চ্যান্সেলর নানাভাবে কত টাকা কামাই করেন, একবার আমার সেটা জানার কৌতূহল হয়েছিল। সেটা জানতে চেয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেছি, একজনকে চিঠি লিখলেই সে চিঠির উত্তর দিয়ে সব তথ্য জানিয়ে দেবে, সেটা কেউ আশা করে না। কিন্তু দেশে যেহেতু তথ্য অধিকার আইন বলে একটা আইন আছে সেটার সূত্র ধরে আমি চিঠি লিখেছিলাম। যখন কিছুতেই চিঠির উত্তর পাই না, তখন আমি বিষয়টা তথ্য অধিকার কমিশনে জানিয়েছি। তারা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে শুনানির জন্য ডেকে পাঠিয়েছিল কিন্তু ততদিনে ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয় চাকরি শেষ করে চলে গিয়েছেন। আমি আমার তথ্যটি পাইনি সত্যি কিন্তু তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করে যে তথ্য জানতে চাওয়া যায় সেই তথ্যটি পেয়েছি! সেটাই খারাপ কী?
যাই হোক ভাইস চ্যান্সেলর হলেই যে তিনি আর্থিক দুর্নীতি করবেন সেটি মোটেও সত্যি নয়, কিন্তু আজকাল ঘুরেফিরে এই কথাটি অনেক বেশি শোনা যায়। খবরের কাগজ খোলা হলেই কোনো না কোনো ভাইস চ্যান্সেলর নিয়ে একটা রগরগে খবর পাওয়া যায়। নিয়োগবাণিজ্য আজকাল বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ। তবে যারা চালাক-চতুর, তারা এমনভাবে সেটি করেন যে, তার কোনো প্রমাণ থাকে না এবং তাদের ধরা খুব কঠিন। কোনো কোনো ভাইস চ্যান্সেলর শুধু যে চালাক-চতুর তা নয়, একইসঙ্গে তারা দুঃসাহসীও। দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে তদন্ত করতে এসে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রিসীমায় ঢুকতে পর্যন্ত পারেননি, এরকম ঘটনাও আছে। তবে অর্থনৈতিক দুর্নীতি থেকেও অনেক বড় দুর্নীতি হচ্ছে প্রশাসনিক দুর্নীতি। একজন ভাইস চ্যান্সেলরের ক্ষমতা প্রায় সীমাহীন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে তারা একজন সম্রাটের মতো, ইচ্ছে করলেই তারা কারও পরোয়া না করে বিশ্ববিদ্যালয় চালিয়ে যেতে পারেন। তাদের সবচেয়ে পছন্দসই কাজ হয় পছন্দের মানুষকে নিয়োগ দেয়া। নিজের আত্মীয়-স্বজনকে নিয়োগ দেয়ার জন্য সাময়িকভাবে আইন পরিবর্তন করে আবার আগের আইনে ফিরে যাওয়ার উদাহরণ আমি নিজের চোখে দেখেছি।
যারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত না তারা মনে করতে পারেন, যেহেতু একজন ভাইস চ্যান্সেলর নিজের একক ইচ্ছায় যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন না, একাধিক কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে সবকিছু করতে হয়, তাই এখানে হয়তো এক ধরনের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ আছে। কিন্তু ব্যাপারটি পুরোপুরি সত্যি নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর, প্রভোস্ট, বিভিন্ন কেন্দ্রের পরিচালক-জাতীয় অনেক অর্থকরী পদ থাকে, ভাইস চ্যান্সেলর নিজের ক্ষমতা বলে সেগুলো বিতরণ করেন। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকদের দল থাকে, সব দলের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকদের এরকম অর্থকরী পদ দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে ফেলা যায়। চাটুকার-জাতীয় শিক্ষকরা নিজেরাই মুখবন্ধ রাখেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটিগুলো ভাইস চ্যান্সেলরের মুখের কথায় ওঠে-বসে। ভাইস চ্যান্সেলর একজন শিক্ষক ছাড়া কিছু নন, কিন্তু এরপরও তারা অনেক সময় অবলীলায় অন্য শিক্ষকদের প্রকাশ্যে ধমক-ধামক দিতে কিংবা অপমান করতে দ্বিধা করেন না। আত্মসম্মানহীন শিক্ষকরা দেখতে দেখতে কেঁচোর মতো হয়ে যান। ভাইস চ্যান্সেলররা তখন প্রবল প্রতাপে একাডেমিক কাউন্সিল কিংবা সিন্ডিকেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ সভাগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। সিদ্ধান্তগুলো কাগজে লিখে নিয়ে এসে একাডেমিক কাউন্সিলে কিংবা সিন্ডিকেটে ঘোষণা করেন, আধঘণ্টার মাঝে মিটিং শেষ হয়ে যায়, চা-সিঙ্গারা পর্যন্ত খেয়ে শেষ করার সময় পাওয়া যায় না।
একজন ভাইস চ্যান্সেলর ছলে-বলে-কৌশলে কিংবা প্রবল প্রতাপে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী- সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করলেও সবসময় ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। ছাত্রছাত্রীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে অনেক সময়েই নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখা হয়, কিন্তু অবস্থা যখন বাড়াবাড়ি হয়ে যায়, তখন হঠাৎ তাদের মাঝে বিস্ফোরণ ঘটে। অবাধ্য ছাত্রছাত্রীদের শায়েস্তা করার জন্য তখন ভাইস চ্যান্সেলরের আজ্ঞাবহ শিক্ষকরা সরকারি দলের ছাত্রদের নিয়ে মাঠে নামেন। ব্যাপক পিটুনি দিয়ে কখনও কখনও আসলেই সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের শায়েস্তা করে ফেলা হয়। কখনও কখনও অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যায়, সরকারের টনক নড়ে এবং শেষ পর্যন্ত সেই ভাইস চ্যান্সেলরকে সরিয়ে নেয়া হয়!
মোটামুটি এই হচ্ছে আমাদের দেশের বেশিরভাগ ভাইস চ্যান্সেলরদের জীবন কাহিনি!
দুই.
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে এই দেশের অনেক বড় একটা সম্পদ। এই সম্পদ যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। সেটা করার একটি মাত্র উপায় সত্যিকারের শিক্ষাবিদদের ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেয়া। ঘড়েল রাজনীতিবিদদের নয়, অর্থলোভী মানুষদের নয়, নীতিহীন চরিত্রদের নয়, ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য খুঁজে খুঁজে বের করতে হবে সেসব শিক্ষকের যারা শিক্ষাকে ভালোবাসেন, শিক্ষকদের ভালোবাসেন এবং সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন ছাত্রছাত্রীদের।
এ রকম শিক্ষক অনেকেই আছেন, অন্যদের লাফঝাঁপের কারণে তারা চোখের আড়ালে পড়ে থাকেন। তাদের খুঁজে বের করা এমন কোনো কঠিন কাজ নয়।