নিউজ বাংলা ডেস্ক:ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসেই গুরুত্ব দেন আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে। ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম বাজেটেই (২০১৪) এ প্রকল্পে ১০০ কোটি রুপি বরাদ্দ দেন তিনি। এরপর থেকে পুরোদমে শুরু হয় প্রকল্পের কাজ। গেল বছর প্রকল্প বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে দেশটির উচ্চ আদালত। বাংলাদেশের মতামত উপেক্ষা করে ভারতের উচ্চ আদালতের এ রায়ে সে সময় বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন অনেকেই।
বাংলাদেশের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিও উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল ভারতরে আদালতের ওই রায়ে। প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল ভারতের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যেও। এরপর আর কোনো আলোচনা নেই। নেই প্রতিবাদ, উদ্বেগও। কাজ চলছে পুরোদমেই। তিস্তা নিয়ে আলোচনায় থাকলেও বাংলাদেশ সরকার আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বন্ধে আর কোনো তৎপরতা দেখায়নি।
অজানা কারণে ঝিমিয়ে পড়েছে ভারত-বাংলাদেশের পরিবেশবাদীরাও। ধারণা করা হয়, সকল পক্ষের সঙ্গে বিশেষ বোঝাপড়া করেই প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে ভারত সরকার। তিস্তা চুক্তিতে গড়িমসি, টিপাই বাঁধ এ প্রকল্পের ধারাবাহিক কাজের ফল। ভারত এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে বা্ংলাদেশ অচিরেই মরুভূমিতে পরিণত হবে বলে পরিবেশবাদীদের আশঙ্কা। ক্ষতিগ্রস্ত হবে খোদ ভারতের নয়টি অঙ্গরাজ্য।এ প্রসঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষ উচ্ছেদ হবে। পরিবেশে মারাত্মকভাবে বিপর্যয় ঘটবে। এতে সমগ্র বাংলাদেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।তিনি বলেন, গঙ্গা বা তিস্তার পানি সঙ্কটের কারণে উত্তরাঞ্চল এমনিতেই মরুকরণের দিকে যাচ্ছে। ভারত অভিন্ন নদীগুলোর প্রায় প্রতিটিতে বাঁধ দিয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদে এখনও কোনো বাঁধ পড়েনি। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে ব্রহ্মপুত্র থেকে প্রায় দুই লাখ কিউসেক পানি পশ্চিম ভারতে স্থানান্তর করা হবে।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে নদী ও নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারত মহাপরিকল্পনা শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় পঞ্চাশের দশকে সমগ্র ভারতব্যাপী আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের প্রস্তাব করে।
১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু জল চুক্তি (আইডব্লিউটি) স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্কের টানাপড়নের মধ্যে কোনো প্রকার সমঝোতা ছাড়াই ভারত একতরফাভাবে গঙ্গা নদীর উপর বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে।
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে গঙ্গার উপর ফারাক্কা বাঁধের বিষয়টিতে ভারত আরও জোর দেয়। এরপর ১৯৭৪ সালে ফারাক্কা ব্যারাজ চালু করে ভারত পানি প্রত্যাহার শুরু করলে বাংলাদেশ ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকে। কিন্তু ১৯৭৭ সালে দু’দেশের মধ্যে প্রথম পানি বণ্টন যে চুক্তি হয়, তাতে বাংলাদেশের পানি পাওয়ার বিষয়টিও গুরুত্ব পায়। ওই চুক্তিতে বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি পাবে বলে উল্লেখ করা হয়। এরপরই ভারত ভিন্ন কৌশলের দিকে নজর দেয়। তারা ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পানি এনে গঙ্গাতে সরবরাহ করার প্রস্তাব দেয়। এটিই আন্তঃনদী-সংযোগ প্রস্তাব। কিন্তু সার্বিক বিচারে বাংলাদেশ তাদের প্রস্তাবে অসম্মতি জানায়। আন্তঃনদী-সংযোগ প্রস্তাবে বাংলাদেশের নারাজিতে গঙ্গার চুক্তি পাঁচ বছর পার হয়ে গেলে ভারত তা নবায়নে অনাগ্রহ দেখায়। এতে করুণ পরিণতি নেমে আসে গঙ্গায়।
এক হিসাবে দেখা যায়, পঞ্চাশের দশকে গঙ্গা নদীতে শুকনো মৌসুমে গড় পানি প্রবাহ ছিল প্রায় এক লাখ কিউসেক। কিন্তু ফারাক্কার প্রভাবে গঙ্গার পানি প্রবাহ এক-চতুর্থাংশে নেমে আসে। ১৯৭৭ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তিতে বাংলাদেশকে ন্যূনতম ৩৪ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি সরবরাহের নিশ্চয়তা দেয়া হয়। চুক্তি নবায়ন না হওয়ায় পরবর্তীতে সে নিশ্চয়তাও ভেস্তে যায়। এরপর ১৯৯৬ সালের চুক্তিতে সর্বনিম্ন ২৭ হাজার ৬৩৩ কিউসেক পানি দেয়ার কথা থাকলেও কোনো প্রকার নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি। এমতাবস্থায় ১৯৯৯ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এলে ভারতের আন্তঃনদী-সংযোগ পরিকল্পনাটি নিয়ে আবারও তৎপরতা শুরু হয়। অটল বিহারি বাজপাইয়ের সময় টাস্কফোর্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৬টি সংযোগ খাল দিয়ে ভারতের ৩৮টি নদ-নদীর মধ্যে আন্তঃসংযোগ ঘটানো হবে। পাশাপাশি ৩৪টি ছোট এবং ৭৪টি বড় জলাধার নির্মাণ করা হবে।
সংযোগ খালের মাধ্যমে গঙ্গা থেকে পানি নিয়ে যাওয়া হবে গুজরাট, হরিয়ানা, রাজস্তান ও তামিলনাড়ু এলাকায়। এতে গঙ্গায় যে পানি সঙ্কট হবে, তা পূরণ করা হবে ব্রহ্মপুত্রের পানি দিয়ে। এভাবে মোট ১৭৩ বিলিয়ন কিউসেক পানি খরাপীড়িত অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হবে। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের ১৬ লাখ হেক্টর জমিতে সেচের সুবিধা হবে। এটিই ভারতের বর্তমান আন্তঃনদী-সংযোগ প্রকল্প।কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এবং ভারতের বিহার, আসাম, পশ্চিমবঙ্গসহ অনেক রাজ্যের অধিবাসী সর্বোপরি সমগ্র ভারতের পরিবেশবাদী ও বুদ্ধিজীবীদের বিরোধিতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ স্থগিত করতে বাধ্য হয়। এরপর জনকল্যাণেরনিমিত্তে এবং প্রাক্কলিত ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে বিধায় ২০১২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের উচ্চ আদালত প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ প্রদান করে। প্রাথমিক অবস্থায় প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল পাঁচ লাখ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়ন করতে ৫০ থেকে ৬০ বছর সময় লাগবে বলে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়।
জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বিষয়টি গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন ধরে। তিনি বলেন, ‘ভারতে কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এ প্রকল্প হাতে নেয়া। তবে এটি হলে এ অঞ্চলে আরও অশান্তি দেখা দেবে। পানি নিয়ে ভারতের নিজেদের মধ্যেই হানাহানি সৃষ্টি হবে।’তিনি বলেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কয়েক বছর পর নদীর খালগুলো ভরাট হয়ে যাবে। তখন এর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় বহন করতেই ভারতকে হিমশিম খেতে হবে। কারণ প্রকৃতির নিজস্ব ধর্ম আছে। সেখানে বাধা সৃষ্টি করলে কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। সার্বিক বিবেচনায় ভারতের আন্তঃনদী একটি ব্যর্থ প্রকল্পে পরিণত হবে।