জাতি সংঘ’র মহাসচিব অ্যান্টনিও গুতেরেস ঠিকই বলেছেন যে, নারীর প্রতি ঘটতে থাকা হিংসা আসলে আমাদের সমাজেরই ‘কলঙ্ক’। তবে সেই কলঙ্ক নিয়ে সমাজ বা রাষ্ট্রের যেন তেমন মাথা ব্যথা নেই।
সেই কলঙ্ক ঘোচাতে বহু রাষ্ট্রেরই তেমন বিশ্বাসযোগ্য তৎপরতাও লক্ষ করা যায় না। আর এই ব্যাপারে ভারতের অবস্থা বোধহয় সব থেকে করুন। তা নাহলে, যুদ্ধদীর্ণ আফগানিস্তান নয়, সিরিয়া নয়, সোমালিয়া নয়, সৌদি আরবও নয়, মেয়েদের জন্য ভারতই পৃথিবীতে সব থেকে বিপজ্জনক দেশ বলে চিহ্নিত হবে কেন?
অন্তত ‘টমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন’র সমীক্ষায় তেমনটাই তো উঠে এসেছে। এই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল ২০১১ তেও। তখনকার চতুর্থ স্থানে থাকা ভারত নিজের রেকর্ড নিজেই ভেঙে ২০১৮ তে শীর্ষে পৌঁছে গেছে। বাকিরা যথাক্রমে রয়েছে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে।
অবশ্য এই ‘সুনাম’ অর্জনে ভারতকে তেমন বেগ পেতে হয়নি। কারণ সমীক্ষাই বলে দিচ্ছে যে, ২০০৭ থেকে ২০১৬ র মধ্যে ভারতে মেয়েদের প্রতি অপরাধ বেড়েছে ৮৩ শতাংশ! এবং দেখা যাচ্ছে প্রতি ঘণ্টায় চারটি ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে।
বলা বাহুল্য যে ওই নথির বাইরে থেকে যাচ্ছে অসংখ্য সংঘটিত অপরাধ।
সরকারি প্রতিনিধিরা অবশ্য প্রায়শই এই ধরনের সমীক্ষা রিপোর্টকে অস্বীকার করেন বা গুরুত্ব দেন না।
অথচ সরকারি দপ্তরের দ্বারাই প্রকাশিত ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের তথ্যে, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’র তথ্যে ধরা পড়ে যাচ্ছে ভারতে মেয়েদের ক্রমবর্ধমান শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের ছবিটি।
মনে হয় এই পৃথিবীতে বুঝি এমন কোনো জায়গাই নেই, যেখানে মেয়েরা নিরাপদ। কি ঘরের মধ্যে, রাস্তাঘাটে, কি স্কুল-কলেজে, কাজের জায়গায়, কি পাবলিক ট্রান্সপোর্টে। এমনকি হাসপাতালেও মেয়েরা নিরাপদ নয়। এই সবের সঙ্গে আবার নবতম সংযোজন – অনলাইনের হিংসা।
এখন এমন একটি সকালও তো আসে না যে, প্রভাতি সংবাদপত্রে একই দিনে পাতায় পাতায় পুড়িয়ে মারা সহ নানা ভাবে মেয়েদের ওপর নির্যাতন এবং যৌন অত্যাচারের বিবিধ ঘটনা চোখে পড়ে না, যেখানে শিশু থেকে প্রবীণা কেউই বাদ যাচ্ছে না। সব থেকে দুঃখের যে, যাবতীয় সহিংসতার বেশিরভাগই ঘটে ঘরের মধ্যে।
জানা যাচ্ছে যে, ভারতে প্রতি ৩ জন মেয়ের মধ্যে একজনই শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ঘরের ভিতর। যেমন ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’র রিপোর্টই বলছে, গত এক দশক সময়ের মধ্যে ঘণ্টায় ৩৯ অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছে।
এও দেখা গেছে সেই সব অপরাধের মধ্যে ৩৩ শতাংশই হল স্বামী ও তার পরিজনদের দ্বারা সংঘটিত। আর নথিভুক্ত ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। অথচ গত এক দশকে মেয়েদের প্রতি অপরাধের সাজা হয়েছে সব থেকে কম।
দেশের মধ্যে ২০১৬ সালে মেয়েদের প্রতি সংঘটিত অপরাধের হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ ছিল দ্বিতীয় স্থানে। কিন্তু রাজ্যে অপরাধীদের সাজা হয়েছে মাত্র ৩.৩ শতাংশ – যা সারা ভারতের মধ্যে সবথেকে কম। এই একটি ব্যাপারে কোনো পরিবর্তনই যেন লক্ষ করা যাচ্ছে না। যেন যুগের পর যুগ ধরে, প্রজন্মের পর প্রজন্মের জিন বাহিত ওই হিংসা প্রবণতা পরিবারে, সমাজে অকুতোভয় রাজ করে চলেছে।
কোনো জন-সচেতনতা, কোনো প্রচারণা কর্মসূচিই যেন তাকে স্পর্শ করছে না। করছে না, কারণ মনে হয় এই ব্যাপারে আইনগুলি প্রয়োগে সরকারের ব্যর্থতা প্রায় আকাশচুম্বী। কারণ, দোষী সাব্যস্ত করতে পারলে তবে তো সাজা। সেই পথে যে পাহাড় প্রমাণ বাধা।
অর্থসহ যত রকমের ক্ষমতা, যত ভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব, তা করা হয় অপরাধীদের ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য।
আসলে জন্ম-মুহূর্ত থেকেই মেয়েদের যেন এক অদৃশ্য যুদ্ধের দিকে ক্রমাগত ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। যখন সে নিতান্ত শৈশবে, যখন সে ‘হিংসা’, ‘নিরাপত্তা’ শব্দগুলির সঙ্গে কোনোভাবেই পরিচিত নয়, তখনই সেই যুদ্ধে ভয়ঙ্কর নৃশংসতায় আমাদেরই অসহায় শিশু কন্যারা প্রতিদিন বলি হচ্ছে।
অসহায় যে আমরাও।
কারণ আমরা তাদের রক্ষা করতে পারছি না।
কারণ আমরা বেশিরভাগই মনে করি ওই ঝোপে জঙ্গলে পড়ে থাকা ধর্ষিত, ক্ষতবিক্ষত, নিহত শিশুকন্যাটি আমার কেউ নয়।
কারণ আমরা মনে করি, আগুনে বা অ্যাসিডে পুড়ে যাওয়া মেয়ে বা বউটি আমার ঘরের কেউ নয়।
আমরা মনে করি এটা আমাদের দায় নয়, রাষ্ট্রের দায়। আমরা আসলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এক সংবেদনহীন সমাজের নাগরিক।
তা না হলে বিভিন্ন দেশের অন্তত ৬০ কোটি ৩০ লক্ষ মহিলা মনে করত না যে, গার্হস্থ্য হিংসা কোনো অপরাধই নয়। তা না হলে আমাদের জানতে হত না, গর্ভস্থ সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণে ১০ কোটিরও বেশি কন্যা ভ্রূণ হারিয়ে যাচ্ছে।
সারা পৃথিবীতে প্রায় ৬ কোটি নাবালিকাকেও বসতে হত না বিয়ের পিঁড়িতে। এবং বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বছরে যে প্রায় ৮ লক্ষ মানব পাচার হচ্ছে, তার মধ্যে ৮০ শতাংশই হত না নারী ও বালিকা।
জানি, এইসব তথ্যে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। তবু নারী ও কন্যাদের প্রতি দেশের সমাজের একেবারে বর্তমান প্রবণতা জানতে, বুঝতে এই সবের যে মুখোমুখি হতেই হয়।
আর রাষ্ট্র? তাতে থাকা ক্ষমতাসীনরা তো মনে করে এটা তত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুই নয়। কারণ আর যাই হোক, মেয়েদের প্রতি ক্রমবর্ধমান হিংসা অত্যাচার তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে না। এই নিশ্চিন্ততাতেই বোধহয় অপরাধ ঘটলেও কেন অপরাধীরা সাজা পায় না – তা নিয়ে তার ভ্রুক্ষেপহীন অসীম উদাসীনতা।
কিন্তু ইদানীং আমার মনে হচ্ছে, ওই উদাসীনতা দেশের মেয়েরা বোধহয় বেশি দিন আর সহ্য করবে না। বিশেষ করে যাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে।
মনে হচ্ছে, তারা যদি একবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে, তাহলে রাষ্ট্রশক্তিও মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। দিগন্তে তেমনই একটি সঙ্কেতের আভাস পাচ্ছি যেন।