নিউজ বাংলা ডেস্ক:

ত্রিশ লাখেরও বেশি ভোটারের নির্বাচন। ১২৯৫টি ভোটকেন্দ্রে কোনো আয়োজনের কমতি নেই। যথারীতি সকাল আটটায় শুরু হয় ভোটগ্রহণ। কিন্তু ভোটারদের  সাড়া নেই কোথাও। কোনো কেন্দ্রে ভোটার আছেন এক থেকে দুজন। কোথাও নেই। কেন্দ্রের বাইরে প্রার্থীর কর্মী সমর্থকদের যেমন ভিড় থাকার কথা তাও নেই। সকালে ঢাকার আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন।

কোথাও কোথাও ঝির ঝির বৃষ্টিও ছিল। নির্বাচনী কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন খারাপ আবহাওয়ার জন্য হয়তো ভোটারদের আসতে দেরি। তাই তারা অপেক্ষা করছিলেন অবস্থার উন্নতির। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উঁকি দেয় সূর্য। কিন্তু অবস্থা বদলায় না। ভোটারের সারি নেই কোথাও। মাঝে মধ্যে একজন-দুজন আসছেন। ভোট দিয়ে চলে যাচ্ছেন। আবার কোনো কোনো বুথে ভোটারের দেখা মিলেনি দুপুর পর্যন্ত। বেলা দুটায় ভোটশূন্য বুথ পাওয়া গেছে কয়েকটি। কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন দুপুরের নাওয়া-খাওয়া সেরে হয়তো কিছু ভোটার আসবেন।

বিকাল চারটা পর্যন্ত এমন আশা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু জোট বেঁধে ভোটার আসার আগেকার দিনের দৃশ্য আর দেখতে পারেন ভোট গ্রহণের কর্মকর্তারা। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির নির্বাচনে গতকাল দিনভরই কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটারের অপেক্ষায় থাকতে দেখা গেছে কর্মকর্তাদের। সকাল থেকে এমন চিত্র থাকায় হতাশা দেখা গেছে প্রার্থী ও রাজনৈতিক নেতাদের মাঝেও। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ও উপ নির্বাচন হওয়ায় ভোটারের সংখ্যা কম বলে সরকারি দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও সংসদের বিরোধী দলের প্রার্থী দাবি করেছেন অতীতের নির্বাচনের অনিয়মের কারণে এ ভোটে ভোটারদের আগ্রহ ছিল না।
এদিকে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও নির্বাচন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, অতীতে অনেক নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করলেও এমন নির্বাচন আর দেখেননি তারা। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন হলেও ভোটারদের এমন কম আগ্রহ আগের কোনো নির্বাচনে দেখা যায়নি। ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র ও ১৮টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন হয়। আর দক্ষিণে ১৮টি সাধারণ ওয়ার্ডে নির্বাচন হয়। দুই সিটির যে ৩৬টি ওয়ার্ডে নির্বাচন হয়েছে সেখানে ভোটারের উপস্থিতি তুলনামূলক বেশি ছিল।

এদিকে ভোটার উপস্থিতির বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা জানিয়েছেন কমিশন শুধু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করে। ভোটারদের কেন্দ্রে নেয়া দলগুলোর দায়িত্ব। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার নির্বাচন মূল্যায়ন করে জানিয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় এ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। এক বছরের কম মেয়াদের জন্য হওয়া এ নির্বাচনের শুরু থেকেই তেমন উত্তাপ-আমেজ ছিল না। প্রচার প্রচারণাও দৃশ্যমান হয়নি।

এছাড়া প্রধান বিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফন্ট এ নির্বাচনসহ সব ধরনের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। এ অবস্থায় আগে থেকে ধারণা করা হচ্ছিল নির্বাচন তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে না।
সকাল ১০টার দিকে মোহাম্মদপুরের আলহাজ মকবুল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে গিয়ে ভোটারদের তেমন কোনো উপস্থিতি দেখা যায়নি। কেন্দ্রের ভেতরে ও আশপাশে চোখে পড়েনি ভোটারদের অংশগ্রহণ। কেন্দ্রের ভেতরে একটি বুথে গিয়ে দেখা যায় অলস ভঙ্গিমায় বসে আছেন নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা। এদের কেউ মুখে হাত দিয়ে বসে ছিলেন, আবার কেউ মেঘলা দিনে ঝিমুচ্ছিলেন। ভোটার না থাকায় কেন্দ্রটিতে ছিল সুনসান নীরবতা।

সকাল আটটায় ভোটগ্রহণ শুরু হলেও সাড়ে ১০টা পর্যন্ত কেন্দ্রটিতে ভোট পড়ার হার ছিল একেবারেই কম। ভোটগ্রহণ শুরুর পর ২০ মিনিটে আটটি বুথের একটিতেও কোনো ভোট পড়েনি। ভোটার অনুপস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে একটি বুথের দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার আব্দুস সাত্তার বলেন, সকাল আটটা ২০ মিনিট পর্যন্ত কোনো ভোট পড়েনি। মেঘলা আবহাওয়া ও বৃষ্টির কারণে ভোটাররা সকালে কেন্দ্রে আসছেন না বলেও জানান তিনি। তবে, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়বে বলে আশার কথা জানান ওই নির্বাচনী কর্মকর্তা। মকবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কথা হয় একজন ভোটারের সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ভোটার  বলেন, সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে ভোট নিয়ে কোনো আওয়াজই পেলাম না। নির্বাচনের যে একটা আমেজ থাকে তার কোনো ছিটেফোঁটাও চোখে পড়ছে না। অন্য সময় নির্বাচনে ভোটার স্লিপ পেলেও এবার তিনি কেন্দ্রের তথ্য সম্বলিত কোনো কার্ড পাননি বলেও জানান।

এসব কারণে ভোট দিতে যাননি মোহাম্মদপুর এলাকার ওই ভোটার। ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের চারটি ভোটকেন্দ্র। এই চারটি ভোটকেন্দ্রে ভোটার ১১ হাজার ১২৩ জন। ৯৫৯ নম্বর মহিলা ভোটকেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার প্রকাশ কুমার দাস জানান, এখানে প্রথম দুই ঘণ্টায় একটি ভোটও পড়েনি। কেন্দ্রটির ৯৬১ নং পুরুষ ভোট কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো. ইকরামুল হোসেনও জানান, প্রথম দুই ঘণ্টায় কোনো ভোট পড়েনি তার ব্যালট বাক্সে। কিন্তু এর পরে ১০ থেকে ১২টি ভোট পড়েছে। তবে স্কুলটিতে অবস্থিত ৯৬২ নং পুরুষ ভোট কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো. আবু সাঈম জানান, তার এখানে কমবেশি পঞ্চাশটির মতো ভোট পড়েছ। অন্যদিকে বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ ৯৬০ নং পুরুষ ভোট কেন্দ্রটির প্রিজাইডিং অফিসার কামরুজ্জামান জানান, তার এখানে প্রায় শ’খানেক ভোট পড়েছে। সকালে আবহাওয়া খারাপ থাকায় ভোটাররা ভোট দিতে আসেনি। তিনি বলেন, এখন যেহেতু রোদ উঠছে, আশা করছি আরও লোকজন ভোট দিতে আসবে।

এদিকে এলাকাটিতে অবস্থিত আরো একটি ভোটকেন্দ্র মোহাম্মদপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়েও ভোটারের দেখা পাওয়া যায়নি। এখানে পুরুষ বুথ ছিল ১০টি। তবে প্রত্যেক বুথে ৫০ থেকে ৬০টি করে ভোট পড়েছে বলে দাবি করেন সেখানকার প্রিজাইডিং কর্মকর্তা। ‘ভোটার নেই, ভোট পড়ল কীভাবে’ জিজ্ঞাসা করলে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা বলেন, ‘মাঝে এসে দিয়ে গেছেন।’ একই চিত্র ছিল সেখানকার মহিলা বুথেও।

মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অবস্থিত আরো একটি ভোট কেন্দ্রে দেখা মেলেনি তেমন কোনো ভোটারের। একমাত্র নৌকা প্রতীকের পোলিং এজেন্ট থাকলেও অন্য কোনো এজেন্ট খুঁজে পাওয়া যায়নি এই দুটি কেন্দ্রের একটিতেও। এদিকে সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ১০টার ভেতরে মাত্র তিনজন ভোটার ভোট দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদপুর নূরজাহান রোডে অবস্থিত বেঙ্গল মিডিয়াম হাইস্কুল ভোটকেন্দ্রে থাকা পোলিং এজেন্ট মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, সকাল পৌনে ৯টার দিকে একজন, ১৫ মিনিট পরে একজন আর তার ত্রিশ মিনিট পরে একজন ভোটার ভোট দিয়েছেন।
ধানমন্ডি থেকে মোহাম্মদপুর এলাকায় প্রবেশ করতেই সরকারি গ্রাফিক্স আর্ট ইন্সটিটিউট ও সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজ। পাশাপাশি অবস্থিত এই দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও রয়েছে ভোট কেন্দ্র। সকালের দিকে দুটি কেন্দ্রই ভোটার শূন্য থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু ভোটারের আনাগোনা চোখে পড়ে এখানে। তবে তাও ছিল হাতেগোনা। কেন্দ্রটির প্রিজাইডিং অফিসার জানান, সকালে বৃষ্টি হওয়াই ভোটার উপস্থিতি কম। দুপুরের পরে এই সংখ্যা বাড়তে পারে। এসময় কেন্দ্রেটিতে ভোট দিতে আসা তানভির আহমেদ বলেন, এখানে শুধু মেয়র পদে ভোট হচ্ছে। তাই মানুষের মধ্যে এই ভোট নিয়ে আগ্রহ কিছুটা কম। আমিও ভোট দিতে আসছিলাম। কিন্তু লোকজন নেই। তাই ভাবছি আমার আর একটা ভোট দিয়ে কি হবে?
তাই ভোট না দিয়েই চলে যাচ্ছি। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরো এক ভোটার তানভিরের সঙ্গে সায় দিয়ে বলেন, এখন আর আমাদের ভোট দেয়া লাগে না। ভোট এমনিতেই হয়ে যায়। তাই মানুষ কষ্ট করে আর ভোট দিতে কেন্দ্রে আসে না।
নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকালে প্রিজাইডিং অফিসারসহ দুজনের মৃত্যু: ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের সময় প্রিজাইডিং অফিসারসহ ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন, প্রিজাইডিং অফিসার মোবারক হোসেন ও জাতীয় পার্টির (জাপা) কর্মী মো. বাদল (৫০)। অসুস্থতার কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা।

ডিএসসিসির রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন মণ্ডল জানান, দক্ষিণ সিটির ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করছিলেন মোবারক হোসেন। এ সময় হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর তাকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোবারক হোসেনের মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কারণ জানা নেই। তবে, মোবারক হোসেন আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। বিভিন্ন ধরনের ওধুষ খেতেন। এদিকে গতকাল বিকাল ৫টার দিকে কড়াইল বস্তি এলাকার মাদরাসা কেন্দ্রের ভোট গণনার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বাদল নামে এক জাপা কর্মীর মৃত্যু হয়েছে।  জাতীয় পার্টি থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ভোট গণনার সময় বিকাল ৫টার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হন বাদল। পরে তাকে উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বাদলের মৃত্যুর খবর শুনে জাপার মেয়র প্রার্থী শাফিন আহমেদ ও জাতীয় পার্টির আন্তর্জাতিক বিষয়ক যুগ্ম সম্পাদক হাসিবুল ইসলাম জয়সহ বেশ কয়েকজন নেতা হাসপাতালে ছুটে যান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here