সালেম সুলেরী

রাজনীতিক মতিয়া চৌধুরী ‘অগ্নিকন্যা’ উপাধি পান ১৯৬৭-তে। ছিলেন তৎকালীন পাক-শাসক জে. আইয়ুবের কট্টর সমালোচক। আন্দোলনকামী ছাত্র-জনতা তাই ‘অগ্নিকন্যা নামে ডাকতো। ১৯৬৫-তে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হন। অবশ্য এর এক বছর আগে শুভবিবাহ ঘটান। জন্ম ১৯৪২-এর ৩০ জুন, পিরোজপুরে। তবে বরাবর এমপি হয়েছেন স্বামীর এলাকা শেরপুর থেকে। স্বামী বজলুর রহমান পরে সংবাদ-এর খ্যাতিমান সম্পাদক। জন্ম ১৯৪১-এর ৩ আগস্ট, দেহাবসান ২০০৮-এর ২৬ ফেব্রুয়ারি।

প্রিয়দিন জন্মদিনে তেমন কোন ঘটা করার চল নেই। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি করা মতিয়া চৌধুরী অনেকটা ব্যতিক্রম। কৃচ্ছতা সাধনের মাধ্যমে জীবন যাপনে অভ্যস্ত। আড়ম্বরহীন সাধারণ নাগরিকের প্রামাণ্য পথিকৃত। ১৯৯৬ ও ২০০৯-এ পূর্ণ মেয়াদের কৃৃষিমন্ত্রী হন। ওনার বদান্যতা সততার মিথ-এ পরিণত হয়েছে। ১৯৬৭ থেকে মস্কোপন্থী ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ করেছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের সেবক ছিলেন।

স্বাধীনতা উত্তরকালে কট্টর সমালোচক ছিলেন সরকারের। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শুধু নয়। শীর্ষ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকেও ছাড়তেন না। চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজানোরও ঘোষণা দেন। ১৯৭৩-এর পয়লা জানুয়ারি মতিয়ুল-কাদের নিহত হন। কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় নেতা উভয়ে। ঢাকার তোপখানা রোডে পুলিশের প্রকাশ্য গুলীতে প্রয়াত। তাদের মিছিল মার্কিন ‘বাইসেন্টিনিয়াল হল’ পোড়াতে যাচ্ছিলো। সেই অগ্নুৎপাত ঠেকাতে পুলিশ রক্তপাত ঘটায়। ফলে সরকার বা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ন্যাপ, জাসদ ফুঁসে ওঠে। অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী তখন অনেকটাই বেপরোয়া। অনুগত রাজনীতিক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ডাকসু’র ভিপি। তারা বাতিল করলেন– ডাকসু’তে বঙ্গবন্ধুর আজীবন সদস্যপদ।

পঁচাত্তরের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠা করেন। জাসদ’কে নিষিদ্ধ করে সহযোগী বানান মোজাফ্ফর-মনিসিং-মতিয়াকে। বাকশালে আ’লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি আত্মীকরণ হলো। ন্যাপনেত্রী মতিয়া চৌধুরী বাকশালে পদ-পদবী পেলেন। ১৯৭৯-তে রাজনীতিক আব্দুর রাজ্জাকের মাধ্যমে গেলেন আ’লীগে। ১৯৮১-তে দিল্লীতে বসেই আ’লীগের সভাপতি হলেন শেখ হাসিনা। সেবছরেই ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত।

ভালো মন্দেই মানুষ, মতিয়া চৌধুরীও। ১৯৭৮ সালের উপান্তে তিনি মফস্বলের একটি জনসভায়। বৃহত্তর রংপুরের নীলফামারীর ডোমারে। কেন্দ্রীয় ন্যাপনেত্রী হিসেবে তিনি প্রধান অতিথি। আমি সাপ্তাহিক মুক্তিবাণী, দৈনিক দেশ প্রতিনিধি। ডোমার হাইস্কুল মাঠে প্রাণবন্ত জনসভা। সভাপতিত্বে জেলা ন্যাপনেতা অধ্যাপক জাকারিয়া। সেবার ৩ জুনে জে. ওসমানীকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন জিয়া। জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি গড়েছেন পয়লা সেপ্টেম্বর। সংসদ নির্বাচন ঘোষিত হয়েছে ১৯৭৯-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি।

সভায় মতিয়া চৌধুরী প্রেসিডেন্ট জিয়ার কড়া সমালোচনা করলেন। বললেন, জিয়া জেলী আমদানিতে ট্যাক্স কমিয়েছেন। এই জেলী মানুষের কি কাজে লাগে? বড়োলোকের মাইয়াগো জিহ্বা মোলায়েম করতে এইটা লাগে। জিয়া ‘ট্রাক্টর আমদানি’তেও ট্যাক্স মওকুফ করেছেন। কৃষি উৎপাদনে শ্যালো-পাওয়ার টিলার চান। বিদেশী ট্রাক্টর দিয়া কৃষিবিপ্লব করতে চান। কিন্তু আমাদের কৃষক হালের গরু-নির্ভর। তাদের ঐসব কৃষিযন্ত্র দিয়ে হাইকোর্ট দেখানোর প্রয়োজন কি?

মতিয়া চৌধুরী বলেন– এবিষয়ে একটা মজার গল্প শোনাই। একজন রাণী তার ঝি’কে নিয়ে ছাদে পায়চারী করছে। দূরে কিছু লোক শ্লোগানসহ মিছিল করছিলো। রাণীমাতা ঝি’কে বলেন– ওরা মিছিল করে কেনো? উত্তরে ঝি বলে– ওরা ভুখা-নাঙা। ওদের ঘরে ভাত নাই তাই মিছিল করছে। রাণীমাতা বললেন– ভাত নেই তো কি হয়েছে। ওরা বাসায় বাসায় পোলাও রেধে খাবে। বুঝলেন, জিয়া সরকারের কাজকর্ম ঐ রাণীর মতোই। দেশের হালের গরুর খবর নাই, ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করবেন!

মতিয়া চৌধুরীর বক্তব্যটি আলোড়ন তুলেছিলো। আমি ‘ভাত নেইতো’ শিরোনামে পদ্যও লিখলাম। সংবাদ-এর খেলাঘর পাতায় পাঠালাম। মতিয়া চৌধুরীর স্বামী বজলুর রহমান পাতাটিরও সম্পাদক। ‘ভাইয়া’ নাম নিয়ে খেলাঘর সংগঠনও চালাতেন। যত্ন করে ইলাস্ট্রেশন সহকারে পদ্যটি ছাপলেন।

১৯৯৬-এর ২৩ জুন সরকার গঠন করলো আওয়ামী লীগ। কৃষি মন্ত্রী হলেন বেগম মতিয়া চৌধুরী। সেবার নতুন বাজেট ঘোষিত হলো ২৭ জুলাই। আমি তখন ঢাকায় ‘সাদাকালো’ ম্যাগাজিন সম্পাদক। নিউইয়র্কের ঠিকানা’ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি। বাজেট অধিবেশন কভার করতে গেলাম জাতীয় সংসদ ভবনে। ২৫ হাজার ২৮৫ কোটি টাকার বিশাল বাজেট। হবিগন্জ, সিলেটগর্ব শাহ এসএমএ কিবরিয়া অর্থমন্ত্রী। দেখলাম– মতিয়া চৌধুরী ওনার প্রশংসায় পন্চমুখ। সংসদ-বক্তব্যে ‘অগ্নিকন্যা’রূপে ফের উচ্চকিত। বলছেন, আমার দেশের কৃষি খাতের পক্ষ থেকে আপনাকে হাজার সালাম। আপনার নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কারণ প্রস্তাবিত বাজেটে আপনি বিপ্লব করেছেন। একশত কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছেন– ‘ট্রাক্টর আমদানি’তে। এই কাজের জন্য আপনি শতাব্দীর সেরা অর্থমন্ত্রী। আপনি বুঝেছেন, আধুনিক পদ্ধতির চাষবাস ছাড়া কৃষিখাত এগুবে না।

এই হলো প্রেসিডেন্ট জিয়ার রাজনীতি, শাসনকাল। আর এই হলেন ন্যাপ-বাকশাল-আ’লীগের বেগম মতিয়া চৌধুরী। উল্লেখ্য, আওয়ামী রাজনীতিতে মতিয়া চৌধুরী বরাবর শেখ হাসিনাপন্থী।

২০১৮-এর ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে ভোট দিতে গিয়েছিলাম। দুপুর এগারটায় গিয়ে শুনলাম আমার ভোটও দেয়া শেষ। পরিচিত পোলিং এজেন্ট আমাকে চিনতে পেরে হাসলেন। বললেন, মামা ভোট দিবেন তো কালকে রাইতেই আসতেন। দিনের বেলা খামোখা কষ্ট করে আইসলেন কেনো।

ব্যক্তিগতভাবে হয়তো সৎ ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। কিন্তু শেষ জীবনে কী অসৎ রাজনীতির ধারা রেখে গেলেন! গণতন্ত্রহীনতা, দুর্নীতিগ্রস্ততা, শহর-মফস্বলে বৈষম্যতার দাবানল। এর দায় ক্ষমতাসীন সকলের, ব্যর্থতার আঁচলঢাকা ইতিহাসের! তারপরও, প্রিয়দিন জন্মদিনে এই কৃতবিদ্যের দীর্ঘায়ু কামনা। সংসদে দাবি উঠেছে –‘বেহাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে’র হাল ধরতে। অর্থাৎ রাজনীতিহীনতার দুঃসময়েও তিনি ‘আশার আলো’। আটলান্টিকের পার থেকে জন্মদিনে সাগরসমান শুভেচ্ছা, শুভকামনা।

সালেম সুলেম সুলেরী: কবি লেখক ও গবেষক

নিউইয়র্ক, জুন ২০২০
# salemsuleri.ss@gmail.com

 

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here