পঞ্চম জাতীয় উপজেলা নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল দায়িত্ব পালনের জন্য বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় আসি; পেট্রোল টিম নিয়ে টহল দিতে গিয়ে হঠাৎ সামনে পড়ে যায় মহাস্থানগড়‌। মহাস্থানগড় আড়াই হাজার বছরেরও বেশি পুরনো এক নগরী৷ বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার উত্তরে করতোয়া নদীর তীরে প্রাচীন এই প্রত্নস্থানটির অবস্থান৷ জায়গাটা আমার কর্মস্থল জয়পুরহাটের অনেক কাছের। এই পথে ঢাকা আসা যাওয়া করলেও বাস থেকে নেমে আর দেখা হয়নাই, তাই আজ সুযোগ পেয়ে দর্শনের জন্য নেমে পড়লাম।

২০১৫ সাল থেকে সার্ক কালচারাল সেন্টার সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কোনো একটি দেশের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী অঞ্চলকে সার্কের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে আসছে৷ সার্কভুক্ত দেশগুলোর ইংরেজি নামের আদ্যক্ষরের ভিত্তিতে দেশগুলোর স্থান বেছে নেওয়া হয়৷ এ জন্য আফগানিস্তানের বামিয়ানের পর ২০১৬ সালে সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ছিল মহাস্থানগড়৷

চারপাশে প্রাচীর ঘেরা প্রাচীন এক দুর্গ নগরী মহাস্থানগড়৷ বিভিন্ন সময়ে খননের ফলে নগরীর ভেতরে ও বাইরে নানান স্থাপনার সন্ধান পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা৷ এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত বাংলাদেশের সবচাইতে প্রাচীন রাজধানী শহর মহাস্থানগড়৷ কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এ স্থানটি পরাক্রমশালী মৌর্য, গুপ্ত এবং পাল শাসকবর্গের প্রাদেশিক রাজধানী ছিল৷ পরবর্তীতে হিন্দু সামন্ত রাজাদের রাজধানী হয় এটি৷ বিভিন্ন সময়ে খননের ফলে মহাস্থানগড়ের কয়েকটি প্রবেশদ্বার আবিষ্কার হয়েছে৷ এগুলো হলো উত্তরপাশে ‘কাঁটা দুয়ার’, পূর্ব পাশে ‘দোরাব শাহ তোরণ’, দক্ষিণে বুড়ির ফটক এবং পশ্চিমে ‘তাম্র দরজা’৷

নানান প্রত্ননিদর্শন সমৃদ্ধ মহাস্থানগড় জাদুঘর ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত৷ মহাস্থানগড়ে বিভিন্ন সময়ে খননের ফলে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে এ জাদুঘরে৷ রোববার পূর্ণ দিবস, সোমবার অর্ধ দিবস এবং সরকারি ছুটির দিনগুলোতে বন্ধ থাকে জাদুঘরটি৷
মহাস্থানগড় জাদুঘরের সামনে করতোয়া নদীর বাঁকে অবস্থিত গোবিন্দ ভিটা৷ এটি মূলত একটি প্রাচীন মন্দির৷ খ্রিস্টীয় ১২শ-১৩শ শতকে রচিত সংস্কৃতি গ্রন্থ ‘করতোয়া মহাত্ম’-তে এ মন্দিরটির কথা উল্লেখ আছে৷ এখানে সর্বপ্রথম ১৯২৮-২৯ সালে এবং পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে প্রত্নতাত্তিক খননের ফলে খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতক থেকে শুরু করে বিভিন্ন যুগের নানান নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে৷

বেহুলার বাসরঘর, এর আরেক নাম গোকুল মেধ৷ মহাস্থানগড় থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে গোকুল গ্রামে অবস্থিত এ প্রত্নস্থলটি৷ ঐতিহাসিকদের মতে, এটি আনুমানিক সপ্তম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে নির্মিত৷ ইট নির্মিত এ স্তূপটি পূর্ব পশ্চিমে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ এবং তিনকোণ বিশিষ্ট৷ খননের ফলে এ স্থাপনাটিতে ১৭২টি কক্ষ আবিষ্কৃত হয়েছে৷

মহাস্থানগড় থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার পশ্চিমে ভাসু বিহারের অবস্থান৷ ১৯৭৩-৭৪ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে জায়গাটিতে দুটি মাঝারি আকৃতির বিহার এবং একটি মন্দিরের স্থাপত্তিক কাঠামো আবিষ্কৃত হয়৷ আরও মেলে আট শতাধিক প্রাচীন নিদর্শন৷ ভাসু বিহার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বিহার ধাপ৷ স্থানীয়ভাবে এটি তোতারাম পণ্ডিতের ধাপ নামেও পরিচিত৷ বিভিন্ন সময়ে খনন করে এখানে একটি বৌদ্ধ বিহার, একটি বৌদ্ধ বিহারের অংশবিশেষ, দুটি বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষসহ নানান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সন্ধান মেলে৷

মহাস্থানগড়ের ঠিক আগেই রয়েছে হযরত শাহ সুলতান বলখী মহীসওয়ারের মাজার৷ কথিত আছে এ অঞ্চলের জনগণকে রাজা পরশুরামের অত্যাচার থেকে মুক্ত করতে আফগানিস্তানের বলখ প্রদেশ থেকে মাছের পিঠে চড়ে এখানে এসেছিলেন তিনি৷ ১২০৫-১২২০ খ্রিস্টাব্দে পরশুরামের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ হয়৷ যুদ্ধে পরশুরাম পরাজিত ও নিহত হন৷ মহাস্থানগড়ের ভেতরে বড় কূপের নাম জিয়ৎ কুণ্ড৷ কথিত আছে, এই কূপের পানি পান করে রাজা পরশুরামের আহত সৈন্যরা সুস্থ হয়ে যেত৷ জিয়ৎ কুণ্ডর পাশেই একটি প্রাসাদের ভিত্তি খুঁজে পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা৷ ঐতিহাসিকদের মতে এটি হিন্দু নৃপতি পশুরামের প্রাসাদ৷

লেখক: মোঃ মোশারফ হোসাইন

সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জয়পুরহাট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here