মোঃ মোশারফ হোসাইন: মহীসোপান হচ্ছে সমুদ্রের দিকে এবং পানির নীচে উপকূলীয় স্থলভাগের বর্ধিত বা সম্প্রসারিত অংশ। আরো সহজ করে বললে, পৃথিবীর মহাদেশগুলোর চর্তুদিকে স্থলভাগের যে অংশ ১ ডিগ্রি কোণে অল্প অল্প ঢালু হয়ে সমুদ্রের পানির মধ্যে নেমে গেছে তাকে মহীসোপান (Continental Shelf) বলে। অপরদিকে মহীসোপানের শেষ সীমা থেকে ভূ-ভাগ খাড়াভাবে নেমে সমুদ্রের গভীরে তলদেশের সাথে মিশে যাওয়া অংশকে মহীঢাল (Continental Slope) বলে ।

১৯৫৮ সালের UN Convention on Law of The Sea (UNCOLS-1) এর ধারা-১ অনুসারে মহীসোপান হলো “রাষ্ট্রীয় সমুদ্রের বাইরে কিন্তু সংলগ্ন জলরাশির তলদেশ ও তার অন্তর্ভূমি যা সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০০ মিটার জলের গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত।” মহীসোপানের সামগ্রিক ভূ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যসমূহ বিবেচনায় এনে ১৯৮২ সনের কনভেনশনে (UNCOLS-2) এর পূর্ণাঙ্গ আইনগত রুপ দেবার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে। সে হিসেবে মহীসোপানকে পানির নীচে উপকূলীয় রাষ্ট্রের স্থলভাগের বর্ধিত অংশ হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করা হয়েছে। মূলত এরপরই গভীর সমুদ্রের শুরু। ১৯৮২ সনের কনভেনশনের ধারা ৭৬ অনুযায়ী “মহীসোপান হচ্ছে মহীসোপনীয় প্রান্ত (Continental margin) পর্যন্ত বিস্তৃত উপকূলীয় রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় সমুদ্রের বাইরের জলরাশির সমুদ্র তলদেশ ও অন্তর্ভূমি(Sub-soil) যা তার স্থলভাগেরই স্বাভাবিক বর্ধিত অংশ। যে ভিত্তিরেখা থেকে রাষ্ট্রীয় সমুদ্রের দূরত্ব মাপা হয় সেখান থেকে পরিমাপ করলে যেখানে মহাসোপানীয় প্রান্তের বহিঃসীমা ২০০ মাইলের কম সেখানে মহীসোপানের বিস্তৃতি ভিত্তিরেখা হতে ২০০ মাইল পর্যন্ত ধরা হবে।

সামুদ্রিক জরিপে দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মহীসোপানের (প্রান্ত পর্যন্ত) বিস্তৃতি ২০০ মাইল বা তার কম। এসব ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অঞ্চলের সম্পদ ভোগই মহীসোপানের অধিকারের ভোগের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু কোন কোন এলাকায় মহীসোপানের বিস্তৃতি ২০০ মাইলের বেশি হতে পারে, যেমন- অষ্ট্রেলিয়া ও মাদাগাস্কার উপকূলের কোন কোন এলাকায় মহীসোপান ৫০০/৬০০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সমস্ত এলাকায় কনভেনশনে উপকূলীয় রাষ্ট্রকে আরো ১৫০ মাইলের অধিকার প্রদান করা হয়েছে। তবে, উন্মুক্ত সমুদ্রের মর্যাদা প্রথম ২০০ মাইলের মধ্যে প্রযোজ্য নয়। সর্বোপরি, ২০০ মাইল এলাকাকে বলা হয় এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক অঞ্চল (EEZ) বা একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল, যেখানে সমুদ্রের পানি ও তলদেশের ওপর ওই দেশের একছত্র অধিকার থাকে। সেখানকার সমুদ্রে অন্য কোন দেশ মাছ ধরতে পারে না। এরপর থেকে দেড়শ মাইল পর্যন্ত সীমার সমুদ্র তলদেশের খনিজ সম্পদের মালিক হবে ওই দেশ, তবে পানিতে থাকা মাছ ধরতে পারে অন্য দেশও। এই পুরো সাড়ে তিনশো মাইলকে ওই দেশের মহীসোপান।

১৯৮২ সনের কনভেনশনের ধারা ৭৭ অনুযায়ী মহীসোপানে উপকূলীয় রাষ্ট্রের অধিকারসমূহের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। মহীসোপানের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর উপকূলীয় রাষ্ট্রের একচ্ছত্র এবং সার্বভৌম অধিকার রয়েছে। এ সম্পদ উপকূলীয় রাষ্ট্র আহরণ বা উত্তোলন না করলেও তার অধিকার বহাল থাকবে। কেউ তার বিনা অনুমতিতে এখানে কোন কমকান্ড পরিচালনা করতে পারবে না। মহীসোপানের প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে শুধু খনিজ ও অন্যান্য অজৈব সম্পদকেই বোঝানো হয়নি, আসনাশ্রিত(sedentary) জৈব প্রজাতিও এর আওতাভূক্ত সম্পদের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য উপকূলীয় রাষ্ট্র মহীসোপান এলাকায় প্রয়োজনীয় স্থাপনা, কাঠামো ইত্যাদি তৈরি করতে পারবে। ধারা ৮২তে প্রস্তাব করা হয়েছে যে, উপকূলীয় রাষ্ট্র ২০০ মাইলের পরে ১৫০ মাইল পর্যন্ত মহীসোপান এলাকা থেকে উত্তোলিত সম্পদের আয়ের একটা অংশ সমুদ্র তলদেশ কর্তৃপক্ষকে (ISA)প্রদান করবে যা উন্নয়নশীল দেশ ও স্থলবদ্ধ দেশের বিশেষস্বার্থ বিবেচনা করে ন্যায়পরতার ভিত্তিতে কনভেনশনের পক্ষরাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বন্টন করার ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিপরীতমূখী ও পাশাপাশি মহীসোপানের সীমানাকরণের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুরুপ বিধান রাখা হয়েছে, অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে ন্যায়পরতার ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান করতে হবে। এই প্রসঙ্গে ১৯৬৯ সনে আন্তর্জাতিক আদালত কর্তৃক মীমাংসাকৃত একদিকে জার্মানি এবং অন্যদিকে ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডের মধ্যকার উত্তর সাগরের মহীসোপান সংক্রান্ত মামলাটিও বিবেচ্য। আদালত মহীসোপানের সীমাকরণের ক্ষেত্রে ১৯৫৮ সনের কনভেনশনের উল্লিখিত মধ্যবর্তী রেখা (Median line) নীতির পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ন্যায়পরতার (Equity) ভিত্তিতে এবং মহীসোপানের প্রাকৃতিক অবস্থান অর্থাৎ কোন স্থলভাগের সঙ্গে মহীসোপানের কোন অংশ অধিকতর স্বাভাবিকভাবে যুক্ত তা বিবেচনায় এনে চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পক্ষে তার রায় প্রদান করে থাকে।

বাংলাদেশের তীরভূমি খুবই ভঙ্গুর এবং আকৃতিও অর্ধ গোলাকার। মোহনায় সকল সশয় পলিমাটি জমার ফলে বহু চড়ার সৃষ্টি হয়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ আঞ্চলিক সমুদ্র নির্ধারণ করেছে এবং নৌ-চলাচল আইন পাশ করেছে। তীরবর্তী বঙ্গোসাগরের জলভাগ বেশ অগভীর এবং ক্রমশ ঢালু হওয়ায় মহীসোপানের প্রান্ত সীমা ৩৫০ নৌমাইল পর্যন্ত যেতে পারে।

২০১২ সালে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এবং ২০১৪ সালে ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ মীমাংসায় আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের রায়ে
বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশ অবস্থিত সব ধরণের প্রাণীজ ও অপ্রাণীজ সম্পদের উপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়।

গণমাধ্যমে প্রকাশশিত তথ্যানুসারে, ২০১১ সালে জাতিসংঘে মহীসোপানের নিজেদের প্রাপ্য দাবি করে আবেদন করে বাংলাদেশ। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমা নির্ধারণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক মামলায় যথাক্রমে ২০১২ এবং ২০১৪ সালে প্রদত্ত রায়ে বাংলাদেশ জয়লাভ করে। সেই রায়ে মহীসোপানের সীমানা আলাদাভাবে নির্ধারণ করার কারণে ২০২০ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সিএলসিএসে সংশোধনী জমা দেয়। কিছুদিন পূর্বে সীমানার ব্যাপারে আপত্তি দিয়েছে ভারত এবং ভারতের দাবি বাংলাদেশ ভূখণ্ডের যে বেসলাইনের ওপর ভিত্তি করে মহীসোপান নির্ধারণ করেছে তার একটি অংশ ভারতের। এছাড়া ভারতের মতে, বঙ্গোপসাগরে বিদ্যমান উক্ত গ্রে এরিয়া সম্পর্কে বাংলাদেশ কোন তথ্য দেয়নি। তবে এর আগে ভারত যে বেসলাইনের ভিত্তিতে মহীসোপানের দাবি তুলেছিল, সেটির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ২০০৯ সালে আপত্তি জানিয়েছিল এবং সেই আপত্তি এখনো রয়েছে। অপরদিকে মিয়ানমার বাংলাদেশের মহীসোপান দাবি ইস্যুতে কোন আপত্তি তোলেনি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব) মোঃ খুরশেদ আলম বলছেন, ”ভারতের আপত্তির ব্যাপারে আমি আইনগত জোরালো কোন ভিত্তি দেখছি না। কারণ আমাদের মহীসোপান আদালত থেকে ফয়সালা করে দেয়া হয়েছে। সুতরাং ভারতের আপত্তির কোন আইনগত ভিত্তি নেই বলেই আমি মনে করি। তারপরেও তাদের আপত্তির বিষয়টি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আমরা জাতিসংঘে জবাব দেবো। তিনি আরো বলছেন, আপত্তির যেসব পয়েন্ট ভারত তুলে ধরেছে, তার সঙ্গে মহীসোপানের কোন সম্পর্ক নেই। কারণ পানির বিষয়ে আপত্তির সঙ্গে তো মহীসোপানের বিষয় মেলে না (বিবিসি বাংলা)।

বাংলাদেশ ও ভারতের মহীসোপান সংক্রান্ত বিরোধের ব্যাপারে সুপারিশ দেবে জাতিসংঘের মহীসোপান নির্ধারণসংক্রান্ত কমিশন (সিএলসিএস)। দুই দেশের বক্তব্য বিচার বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি তাদের সুপারিশ জানাবে। সেই সুপারিশের ব্যাপারেও আবার আপত্তি জানানো যাবে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেহেতু আদালত সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছে, তার বাইরে বাংলাদেশের যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে কোন দেশ মানতে রাজি না হলে তারা পুনর্বিবেচনার পর আবার সিএলসিএসে যেতে পারে। কিন্তু চূড়ান্ত যে সুপারিশ তারা দেবে, সেটা সব দেশকে মানতে হবে। এখানে আদালতের মতো কোন শুনানি হয় না। তবে সিএলসিএসের যে কমিটি রয়েছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট দেশ তথ্য-প্রমাণসহ একটি প্রেজেন্টেশন দিতে পারে।

লেখক: সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ  ম্যাজিস্ট্রেট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here