সাজ্জাদুল হাসান:

এটি কোনো গল্প বা চলচ্চিত্রের কাহিনী নয়! একেবারেই বাস্তব। তিনি এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। সমস্ত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে, তথাকথিত পূর্বাভাস ভুল প্রমাণ করে বিশ্বের সবচাইতে বয়োজ্যেষ্ঠ নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন কিংবদন্তিতুল্য নেতা, আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার জনাব মাহাথির মোহাম্মদ। বিষয়টা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর! তার চেয়েও বেশি কৌতূহলোদ্দীপক। ৯২ বছর বয়সে রাজনীতিতে কেন তাঁর এই অকস্মাৎ প্রত্যাবর্তন? দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রটির ইতিহাসে সর্বাধিক ২২ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি। ২০০৩ সালে যান অবসরে। অবসর ভেঙ্গে দীর্ঘ ১৫ বছর পরে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে পুনরায় ফিরে এলেন চির-সবুজ এই মহানায়ক।

নানা কারণে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে ছিল মালয়েশিয়ার সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচন বিশেষ করে মাহাথির মোহাম্মদ। একটু পিছন ফিরে তাকানো যাক। ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বিগত ৬১ বছর যাবৎ দেশ পরিচালনা করে আসছিলো বারিসান ন্যাসিওনাল (বিএন) নামক রাজনৈতিক জোট। ১৯৬৯ সালে বৃহৎ তিনটি রাজনৈতিক দল: ইউনাইটেড মালায়াস ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও); মালয়েশিয়ান চাইনিজ এসোসিয়েশন (এমসিএ) এবং মালয়েশিয়ান ইন্ডিয়ান কংগ্রেস (এমআইসি) মিলে গঠন করে এই জোট। পরবর্তীতে বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনৈতিক দল যোগ দেয় এই জোটে। মাহাথির মোহাম্মদের রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি, উত্থান আর ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ – সবকিছুই অর্জিত হয় এই প্রভাবশালী জোটের অন্যতম বৃহৎ দল ইউএমএনও’ র কারণে। বলা যায় তাঁর জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল ইউএমএনও তথা বিএন। সুদীর্ঘ প্রায় সত্তরোর্ধ বছরের সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে এই রাজনৈতিক জোটের বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন এবং তাদের ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করলেন! অনেক চুল-চেরা বিশ্লেষণ হয়েছে এই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে। ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। তা সত্ত্বেও বিএন এর জয়ের ব্যাপারে তেমন কোনো সন্দেহের অবকাশ ছিলোনা। যদিও বিরোধী জোট পাকাতান হারাপান ২০১৩ সালের নির্বাচনে তাঁদের অবস্থান বেশ সংহত করতে সক্ষম হয়। ওই নির্বাচনে সাধারণ ভোট (popular vote) বেশি পাওয়া সত্ত্বেও নির্বাচনী আসন বিন্যাসের কারণে বিরোধী শিবিরে ঠাঁই হয় তাঁদের। সব কিছুকে ছাপিয়ে যে কারণটি জয় আর পরাজয়ের মধ্যে ব্যবধান গড়ে দিয়েছে সেটি আর কিছুই নয় – মাহাথির ম্যাজিক!

ঔপনিবেশিক দুঃশাসনের কবল থেকে মাতৃভূমি মুক্ত করার আন্দোলনে যোগ দেয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় মাহাথির মোহাম্মদের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের। ১৯৬৪ সালে ইউএমএনও’র টিকিটে প্রথম বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৬৯ সালে সংঘটিত জাতিগত দাঙ্গা মোকাবেলায় ব্যর্থ হওয়ার জন্যে মাহাথির ক্ষমতাসীন সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। এর ফলে তৎকালীন প্রথানমন্ত্রী টুঙ্কৃ আব্দুর রহমানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি হয় এবং এক পর্যায়ে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয় জাতিগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় তিনি ছিলেন সব সময় উচ্চকণ্ঠ। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মালয়রা ছিল সংখ্যালঘিষ্ঠ চীনা জনগোষ্ঠী থেকে অনেক পিছিয়ে। পিছিয়ে পরা এই জাতিগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা আর বঞ্চনা থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ” দ্য মালয় ডিলেমা”। ১৯৭০ সালে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে। মাহাথিরকে দলে ফিরিয়ে নিতে নেতৃত্বের উপর বাড়তে থাকে চাপ। ওই বছরই পদত্যাগ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টুঙ্কু আব্দুর রহমান। আব্দুল রাজাক হুসেইন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিছুদিনের মধ্যে হুসেইন মাহাথিরকে দলে ফিরিয়ে আনেন। এরপর আর পিছে ফিরে তাকাননি এই ক্যারিশম্যাটিক নেতা। ১৯৭৪ সালে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই বছরই শিক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। ১৯৭৬ সালে উপ প্রধানমন্ত্রীর আসন অলংকৃত করেন মাহাথির। ১৯৮১ সালের জুন মাসে তিনি ইউএমএনও’ র সভাপতি নির্বাচিত হন এবং তার ঠিক এক মাস পরে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন।

মাহাথির এর অসাধারণ স্বপ্নদর্শী নেতৃত্ব গুণে অর্থনীতিতে ইর্ষণীয় অগ্রগতি অর্জন করে মালয়েশিয়া। আশির দশকের শুরু থেকে নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশটির অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৯%! মাথাপিছু জিডিপি ১৯৮০ সালে যেখানে ছিল ১৭৬৯ মার্কিন ডলার ২০০৩ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪৪৬৪ ডলারে! কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে অতি দ্রুত একটি শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয় দেশটি । সেমিকন্ডাক্টর, বৈদ্যুতিক পণ্য, সৌর প্যানেল, তথ্য প্রযুক্তি ইত্যাদি নানা খাতে বিশ্বের অন্যতম প্রধান রপ্তানিকারক দেশ আজ মালয়েশিয়া।

ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম পাঁচ বছরে মাহাথির কিছু কৌশলগত বিষয়ের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। ভারী শিল্পায়নের লক্ষ্যে অকপট রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান তার মধ্যে অন্যতম। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন জাপানে প্রচলিত সগোসসাস (sogososhas) মডেলের অনুরক্ত। জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুসৃত বিভিন্ন উন্নয়ন ধারণার অনুসারী ছিলেন মাহাথির। ওই সময়ে তাঁর স্লোগান ছিল “পূর্ব দিকে তাকাও” (“Look East”) । তাঁর এই পূর্বমুখী নীতির কারণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জাপানি বিনিয়োগ আসে মালয়েশিয়ায় যা দেশটির অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে রাখে অসামান্য অবদান। শুরুর দিকে তিনি সরকারী খরচের উপর আরোপ করেন কঠোর নিয়ন্ত্রণ।

দ্বিতীয় পর্যায়ে রপ্তানিমুখী উৎপাদন খাতের বিকাশে মনোযোগী হয় মাহাথির সরকার। এই সময়কালে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরী এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানামুখী পদক্ষেপ গৃহীত হয়। অবকাঠামোর অভূতপূর্ব উন্নতি হয় তখন। পেট্রোনাস টাওয়ার, কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, পুত্রাজায়া, নর্থ-সাউথ এক্সপ্রেসওয়ে, বাকুন জলবিদ্যুত ড্যাম সহ অসংখ্য মেগা প্রকল্প বদলে দেয় দেশটির ল্যান্ডস্ক্যাপ।

চাঁদের যেমন কলঙ্ক আছে; অসম্ভব সফল এই রাষ্ট্রনায়কও সমালোচনার উর্ধে ছিলেন না। তাঁর অনেক পদক্ষেপ নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। মাহাথির মোহাম্মদের বিরুদ্ধে প্রধানতম অভিযোগ – তিনি ছিলেন একনায়ক; বিরুদ্ধ মতামতের ব্যাপারে মোটেই সহনশীল ছিলেন না বরং তা তিনি কঠোর হস্তে দমন করতেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর একসময়ের ঘনিষ্ট সহচর আনওয়ার ইব্রাহিমের পরিণতি উল্লেখ করা যেতে পারে। উপপ্রধান মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা আনওয়ার ইব্রাহিমকে মাহাথিরের সম্ভাব্য উত্তসূরী মনে করা হতো। ১৯৯৭-৯৮ সালে অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলায় কিছু নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে মাহাথিরের সঙ্গে আনওয়ারের মতবিরোধের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে মাহাথির তাঁকে (আনওয়ারকে) বরখাস্ত করেন। শুধু তাই নয়, আপাত ভিত্তিহীন, যথাযথ প্রমাণ ব্যাতিরেকে বিব্রতকর এক অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে (আনওয়ার ) কারা অন্তরীণ করেন।

জাতিগত সমতা বিধানের ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট দায়িত্বশীল ছিলেন না। বরঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয়দের ব্যাপারে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগের তীর ছিল মাহাথিরের দিকে।

এই বর্ষীয়ান রাজনীতিক তার ফিরে আসার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, মালয়েশিয়াকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে চান তিনি এবং সেই সঙ্গে চান তার অতীত ভুলের সংশোধন করতে। দেশের স্বার্থে তিনি আনওয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে অতীত তিক্ততার অবসান ঘটিয়েছেন। কারাগারে তাঁর সাথে দেখা করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই আনওয়ার ইব্রাহিমের জেল থেকে মুক্তি নিশ্চিত করেছেন মাহাথির। গত ১৬ই মে কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে আনওয়ার মন্তব্য করেন, তিনি তাঁকে (মাহাথির) ক্ষমা করে দিয়েছেন কেননা মাহাথির ইতিমধ্যে তাঁর সদিচ্ছার প্রমাণ রেখেছেন, তাঁকে (আনওয়ার) জেল থেকে মুক্ত করতে জোড়ালো ভূমিকা রেখেছেন, সর্বোপরি দেশের স্বার্থে নির্বাচনে জয়ী হতে যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছেন। পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আনওয়ার ইব্রাহিমের স্ত্রী ডাক্তার ওয়ান আজিজাহ’ কে উপপ্রধান মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। মাহাথির স্পষ্ট করে বলেছেন, বেশিদিন ক্ষমতায় থাকবেন না; আনওয়ার ইব্রাহিমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেবেন তিনি। এটা নিঃসন্দেহে এক অনন্য নজির হয়ে থাকবে। ব্যাক্তিগত দ্বন্দ্ব ভুলে দেশের স্বার্থে এক হয়ে কাজ করার এই উদার মানসিকতা আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য অনেক বেশি প্রয়োজন।

লেখক :  চেয়ারম্যান  ও  ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিএএসএফ বাংলাদেশ লিমিটেড

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here