হুমায়ুন কবির ,ঝিনাইদহ সংবাদদাতাঃ
ঝিনাইদহ মোবারকগঞ্জ চিনিকল ২০২০-২১ মৌসুমে ১১৬ দিন মিলটি যান্ত্রিক ত্রুটি ছাড়াই আখ মাড়াই কার্যক্রম শেষ করতে পেরেছে। এটি বিগত দশ বছরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এছাড়া চিনির আহরণের লক্ষমাত্রা যেখানে  ছিল ৬ সেখানে আহরন হয়েছে ৫.০৮। এটাও বিগত তিন বছরের মধ্যে  সবথেকে বেশি পরিমান চিনি আহরন করা হয়েছেে। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর মোচিকের আখ মাড়াই শুরু হয় এবং শেষ হয় চলতি বছর ১২ এপ্রিল। চিনিকলটি এবার খুব বেশি একটা লোকসানের বোঝা নিতে হবে না বলে আশা করছেন চিনিকল কর্তৃপক্ষ। ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ভারী শিল্পটি সফলতার সাথে চলছে মিল প্রশাসন ও শ্রমিক ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আন্তরিকতার ফলে।

মোচিক কর্তৃপক্ষ বলছেন এবার আখ মাড়াইয়ের লক্ষমার্ত্রা নির্ধারন করেছিল, ১ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন, সেখানে আখ মাড়াই হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৮২ মেট্রিক টন। চিনি উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ছিল হয়েছে ৯ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন সেখানে চিনি উৎপাদন হয়েছে ৭ হাজার ৮,শ মেট্রিক টন। ১ লাখ ৫৭ হাজার বস্তা(৫০কেজির বস্তা)। কর্তৃপক্ষ বলছেন চিকিলটি এবার দেরিতে মাড়াই কাযৃক্রম শুরু করার কারনে প্রায় ৮ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন কম হয়েছে। মোবারকগঞ্জ চিনিকল ২০২০-২১ মাড়াই মৌসুমে প্রায় ৮ হাজার কৃষক তাদের ক্ষেতের আখ সরবরাহ করেছে। পাশাপাশি এবার আখ রোপনের লক্ষমাত্রা নির্ধারন ছিল ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। সেখানে রোপন হয়েছে ৪ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। যা আগামী মৌসুমে চিনিকলটি বেশিদিন চলার সম্ভাবনা রয়েছে এমনটি ধারনা করছে কর্তৃপক্ষ। আগামী ২০২১-২০২২ মাড়াই মোসুমে আখ মাড়াইয়ের লক্ষমাত্রা নির্ধারন করেছে ১ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। সব মিলিয়ে আগামী মৌসুমে কোন যান্ত্রিক ত্রুট না ঘটলে চিনি উৎপাদনের আহারন ভালহবে বলে ধারনা করছেন।
চলতি মৌসুমের শুরুতে সরকার দেশের ছয়টি অলাভজনক চিনিকল বন্ধ করে দিয়েছে। এসময় মোবারকগঞ্জ চিনিকলটিও বন্ধের গুঞ্জন শুরুর হয়। সেসময় ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার’র নির্দেশনায় মিল প্রশাসন ও শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি গোলাম রসুল মিলের দূর্নীতি বন্ধো কাজ শুরু করেন। মিলের প্রতিটি বিভাগে সকল কার্যক্রম স্বচ্ছভাবে পরিচালনা শুরু করেন। ফলে গত দশ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম ব্রেকডাউন ছাড়াই মিলটির কার্যক্রম শেষ হল।
মোবারকগঞ্জ চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি ও শ্রমিক ফেডারেশনের আইন ও দরকষাকষি সম্পাদক গোলাম রসুল বলেন, গত বছর দেশে ৬টি চিনিকল বন্ধ হয়ে গেছে,সেখানে তিনি কর্পোরেশনের মিটিংএ প্রস্তাব ও কমিটি গঠন করা বন্ধ হওয়া প্রতিটি শ্রমিক কর্মচারিদের হাতে আগেই হ্যান্ডসেক দেওয়া হবে। কিন্তু গোলাম রসুল প্রস্তাব করছিলেন আগে সাধারন কৃষকদের টাকা পরিশোধ করার জন্য প্রস্তাব করছি। ঐ মিটিংয়ে কর্মকর্তারা বলেছিলেন ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্ধ হয়েছে তন্মধে ৫০ কোটি কৃষকদের আর ৫০ কোটি অবসর প্রাপ্ত ম্রমিক কর্মচারিদের। মোবারকগঞ্জ চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি গোলাম রসুল বলছিলেন আগে কৃষকদের টাকা পরিশোধ করে তাদের বাচাতে হবে।
এছাড়া চলতি মৌসুমে কৃষকদের আখ ক্রয়ের টাকা দ্রুতই পরিশোধ করা হচ্ছে। ফলে মিল এলাকার কৃষকরা খুশি। যা বিগত ১০ বছরে এমন ঘটনা বিরল। এছাড়া এর আগে শ্রমিক নেতাদের আক্রোসে পড়ে ১৩ জনকে অন্যত্রে বদলি করা হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে মিলটির শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনে সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গোলাম রসুল ১২ জনকে পুনরায় মোবারকগঞ্জ চিনিকলে ফিরিয়ে আনেন। তাদের কে প্রতিপক্ষ হিসাবে ও মনোনিত নেতাদের পক্ষে ভোট না করার জন্য ১৩ জন কে অন্যাত্র চিনিকলে বদলি করা হয়েছিল।
মোচিকের ৮টি সাবজোনের অধিনে ৪৮ টি ক্রয় কেন্দ্রের আওতায় কৃষক রয়েছে প্রায় ৮ হাজার। আগামি মৌসুমের জন্য রোপনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে প্রায় ১০ হাজার একর। কিন্তু লক্ষমাত্রা অর্জিত হয়নি শুধু মাত্র চিনিকলটি দেরিতে আখ মাড়াই শুরু তরা জন্য।
দেশের ১৫ চিনিকল প্রতি বছর সরকারকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ভ্যাট প্রদান করে থাকে। সেখানে এসব মিলে বিভিন্ন যৌক্তিক কারনে লোকসান হয় মাত্র ২০০ কোটি টাকা। এছাড়া সরকারের সাথে বেসরকারী চিনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের চুক্তি অনুযায়ি রিফাইনারী সাদা চিনি দেশের বাজারে বিক্রি করতে পারবে না। শুধুমাত্র দেশের বাইরে বিক্রি করবে কিন্তু বেসরকারী চিনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গুলো সে শর্ত না মেনে দেশের বাজারে চিনি বিক্রি করছে। এদিকে আখের দাম পেয়ে কৃষকরা অত্যান্ত খুশি। কালীগঞ্জের পাতবিলা গ্রামের আখচাষী জাহাঙ্গির হোসেন বলেন, আমরা এর আগে বিগত কয়েক বছর আখের দাম সময়মত পায়না। এবছর আমার সময় মত আখের টাকা পাচ্ছি। যে কারণে কৃষকদের মাঝে আখ চাষে আগ্রহ রয়েছে
মোচিকের হিসাব অনুযায়ি, অফিসারগন বেতন পান সাড়ে ১৩ লাখ টাকা, ইক্ষু বিভাগের স্থায়ী কর্মকর্তা ও কর্মচারিা প্রতি মাতে বেতন পান ৩৬ লাখ টাকা, চুক্তি ভিত্তিকরা পান ১৩ লাখ টাকা, মৌসুমি ইক্ষু বিভাগের তারা পান প্রতি মাসে ১৫ লাখ টাকা। বিগত কয়েক বছর এসব টাকা নিতে শ্রমিক কর্মচারিদের মাসের পর মাস বেতন ভাতা না পয়ে হতাশার মধ্যে পড়ে থাকতে হত। কোন সময় দেখা যতে ৩ থেকে ৪ মাস তারা বেতন পেতেন না। পাওনা টাকার জন্য ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দপ্তর পর্যন্ত ঘেরাও করতো। কিন্তু বর্তমানে এমন ঘটনার দৃশ্য আর চোখে মেলে না। সব মিলিয়ে চিনিকলটির অবস্থা বর্তমানে অনেকাংশে ভাল অবস্থানে রয়েছে।
শ্রমিক কর্মচারিরা বলছেন আমরা এখন নিয়মিত আমাদের বেতন ভাতা পাচ্ছি। এর আগে মাসের পর মাস বেতন ভাতা ওভার টাইম,বকেয়া থাকত কিন্তু এখন আমাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না। শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের বর্তমান সভাপতি গোলাম রসুল নির্বাচিত হওয়ার পর আমাদের অধিকার রক্ষা ও চিনিকলটির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। মিলের বিভিন্ন সেক্টরে তিনি দুর্নিতী কমিয়েছেন। এই কমিটি আসার পর আমরা ভালো আছি।
এ ব্যাপারে মোবারকগঞ্জ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন বলেন, এ বছর কাঁচামালের সহজলভ্যতা ছিল। এছাড়াও আখের ভালো ফলন হওয়া আর শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রচেষ্টায় মিলটি ব্রেকডাউন হয়নি। যে কারণে মিলের চিনি আহরণের হার বেড়েছে। আমরা আশা করছি গত মৌসুমের চেয়ে এ বছর অর্ধেকের ও কম পরিমান লোকসান হবে। আর এভাবে চললে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে লাভের মুখ দেখবে মোবারকগঞ্জ চিানকলটি। তিনি ও অধিক সময় কর্মকর্তা ও শ্রমিকনেতাদের সাথে নিয়ে চিনিকলের ভবিষ্যত আর কিভাবে বৃদ্ধি ও লাভের মুখ দেখা যায় তানিয়ে অধিক সময় পরামর্শ করে থাকেন। বর্তমানে মিলে কর্মকার্তা ও শ্রমিক- কর্মচারী রয়েছে প্রায় ৯শ জন। এ ছাড়া আখের জাতের কারণে এই লোকসান বাড়ছে বলে শ্রমিকরা জানান।
মোবারকগঞ্জ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন বলেন, পুরাতন যন্ত্রপাতি, কৃষক পর্যায়ে আখের মূল্য বৃদ্ধি জনবল সংকট, শ্রমিক মজুরী বৃদ্ধি দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও উৎপাদন ব্যয়ের সাথে সঙ্গতিহীন চিনির মূল্য নির্ধারনের ফলে লোকসান বাড়ছে। সাথে মোটা অংকের ব্যাংক ঋণের সুদ উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণ রয়েছে। তবে, উৎপাদন খরচ বেশি হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং নিত্য প্রয়োজনীয় ও পুষ্টিকর এই খাদ্য পণ্যটি জনসাধারনে মধ্যে সহনীয় রাখতেই সরকার নির্ধারিত মূল্যে চিনি বিক্রি করছেন বলে জানালেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা শহরে ১৯৬৫ সালে ৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০৭.৯৩ একর নিজস্ব জমির উপর নেদারল্যান্ড সরকার মোবারকগঞ্জ চিনিকলটি স্থাপন করে। এরমধ্যে ২০.৬২ একর জমিতে কারখানা, ৩৮.২২ একর জমিতে কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক কলোনী, ২৩.৯৮ একর পুকুর এবং ১০৭ একর জমিতে পরীক্ষামূলক ইক্ষু খামার। এ ছাড়া ১৮.১২ একর জমিতে জুড়ে রয়েছে সাবজোন অফিস ও আখ ক্রয় কেন্দ্র
প্রতিষ্ঠাকালীন মৌসুমে পরীক্ষামূলকভাবে ৬০ কর্মদিবস আখ মাড়াই চলে। লক্ষ্য পূরণ হওয়ায় ১৯৬৭-১৯৬৮ মাড়াই মৌসুম থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন শুরু করে। ঝিনাইদহের ৬ উপজেলা ছাড়াও যশোরের দু’টি উপজেলা নিয়ে গঠিত মোচিকের অধিনে আটটি জোনের আওতায় চাষযোগ্য জমির পরিমাণ রয়েছে সাড়ে তিন লাখ একর।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here