মোস্তফা কামাল/নিউজবাংলা: বাংলা কবিতার ব্যবহৃত চরিত্রের জনপ্রিয়তা যাচাই করলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বনলতা সেন চরিত্রটি
নির্বাচিত হবে বলেই আমার মনে হয়। কবি জীবনানন্দ
দাশের চেয়েও বনলতা সেন চরিত্রটি বেশি জনপ্রিয়। বনলতা সেন আসলে একটি স্বপ্ন, একটি গান, একটি নাটকীয় চরিত্র।
প্রেমিকের কাছে বনলতা তার প্রেমিকা , প্রেমিকার নিজের
কাছে সে নিজেই বনলতা।
বনলতা সেন কবিতাটি তৎকালীন ‘কবিতা’ পত্রিকায়
প্রথম প্রকাশিত হয় আশ্বিন ১৩৪২/ডিসেম্বর ১৯৩৫ সালে। সে সময় কবিতা’র সম্পাদক ছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু। জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে দেখা যায়, কবিতাটি লেখা হয়েছিলাে ১৯৩৪ সালে। সিটি কলেজের সহকারী লেকচারারের চাকরি হারানাে সত্ত্বেও কবি জীবনানন্দ
কলকাতায় বাস করতেন। তিনি সর্বদা রুল করা খাতায় লিখতেন। কবিতাটি আট নম্বর খাতার (কবি নিজেই সেই
খাতাগুলােকে ১,২,৩ করে নম্বর দিয়ে রাখতেন) ২৪ তম পৃষ্ঠায়
পাওয়া যায়। কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বনলতা সেন কবিতার পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত রয়েছে ।
কবিতার মূল ভাবটিকে অনেকে ১৮৩১ সালে লেখা এডগার
এলেন পাে’র টু হেলেন কবিতার সাথে তুলনা করেন, তার দ্বারা
অনুপ্রাণিত বলে ভাবতে ভালবাসেন। যারা পাে’র নাম শুনেন নি
বা ইংরেজি কবিতার প্রতি আগ্রহ কম, তাদের একটি তথ্য
জানা প্রয়োজন যে, হলিউডের জনপ্রিয় নায়ক টম হ্যাঙ্কস দি
‘লেডিকিলার’ মুভিতে এই কবিতা কিছু অংশ আবৃত্তি করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ প্রভাব কাটিয়ে
কল্লোলযুগের পাঁচ কবি যে আধুনিকতার অনুসন্ধান করছিলেন তার যােগ্যতম প্রতিনিধি বনলতা সেন কবিতা।তাই এই কবিতাটি বাংলা কবিতায় একটি নতুন যুগের সন্ধান দেয়। অথচ এই কবিতায় কোনো
বিদ্রোহ নেই, সদম্ভ উচ্চারণ নেই, নিজের অনন্যতা ঘােষণা
করার কোনো সূক্ষ্ম প্রচেষ্টাও নেই। কবিতাটির বুনােট অত্যন্ত নিবিড়, রােমান্টিকতার মােড়কে কবি পুরাে মানবসভ্যতার
পরিভ্রমণ আর গন্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন তিনটি স্তবকের
আঠারােটি লাইনের মাধ্যমে। কবিতাটি পাঠে মনােরম, শব্দচয়নে ঐতিহ্যনির্ভর, ভাবে মিলনােন্মুখ। হাজার হাজার বছরের অবিরাম সন্ধান শেষে ‘বনলতা সেন’রূপী নারী অথবা প্রকৃতির কাছে মানবসভ্যতার স্বস্তিময় আত্মসমর্পণই কবিতার মূলসুর হিসেবে বেশিরভাগ পাঠকের কাছে ধরা পড়ে। কবি
বনলতা সেনের চুলকে তুলনা করেছেন বিদিশা নগরীর
আঁধারের রহস্যময়তার সাথে, মুখশ্রীকে তুলনা করেছেন
‘শ্রাবস্তী’ র কালজয়ী শিল্প উপাদান হিসেবে। ‘বনলতা’র চোখ
পাখির নীড়ের মতাে আশ্রয়দাত্রী, ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়া মধ্যযুগের
শিল্প-ঐশ্বর্য্যের ধারক ‘বিদিশা’র অমােঘ আকর্ষণের মতাে।
নেশা ধরানো চুল, শ্রাবস্তীর হাজারাে স্থাপত্য আর লাখাে শিল্পীর সযত্ন প্রয়াসে আঁকা মুখচ্ছবির মতাে তার রূপ। সারাদিনের ক্লান্তি আর অবসাদ পেছনে ফেলে পাখি যেমন সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরে তৃপ্তি পায়, ‘বনলতা’র চোখ তেমনি আশ্রয়।

কবি নির্মিত এই অপার্থিব নারীর অবয়ব নির্মাণে মাটির পৃথিবীর
কোন নারী রসদ জুগিয়েছে তার রহস্য অনেকেই জানতে চান।
কেউ কেউ মনে করেন বনলতা সেন নামটির ভেতর তার পরিচয় লুকিয়ে রয়েছে । নামটির দু’টি অংশ হলো- বনলতা আর সেন। বনলতা প্রকৃতি আর সেন নারী। জন্মলগ্ন থেকেই মানবজাতি নারী আর প্রকৃতির কাছেই শান্তি খোঁজার চেষ্টা করেছে। এই বিষয়টি স্পষ্ট করতেই কবি বনলতা সেন নামটি বেছে নিয়েছেন, সমসাময়িক আধুনিক নারীর নামের সাথে সাদৃশ্য রেখে কবি তার স্বভাবজাত রােমান্টিকতার আড়াল তৈরি করেছেন মাত্র। আবার,বিশিষ্ট আমলা আকবর আলী খান তার ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইয়ে বনলতা সেনের ‘সেন’ উপাধি আর তার বাসস্থান নাটোর এই দুইয়ের সংযােগে আরেকটি ব্যাখ্যা হাজির করেছেন।তাঁর ব্যাখ্যাটিও যথেষ্ট কনভিন্সিং।তাঁর মতে,’নাটোর’ শব্দটির ব্যবহার শুধু বনলতা সেনের ঠিকানা নির্দিষ্ট করতে নয়, তার পেশা নির্দিষ্ট করতেও এ নামটি ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে
দেখা যায় এ শতাব্দীর প্রথমদিকে নাটোর কাঁচাগােল্লার জন্য নয়,বিখ্যাত ছিলাে রূপাজীবিনীদের ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে। ‘সেন’ শব্দটি তার বংশের পরিচয় বহন করছে, পেশা গ্রহণ করবার পর ‘বনলতা’ নামের আড়ালে সে তার নিজের আসল নাম গােপন করেছে। ‘দু’দণ্ড শান্তি কথাটির মূল অর্থ আদিম অভিসার, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’ প্রশ্নটি এই হাহাকার প্রকাশ করে যে,কবিতার ‘আমি’ আগে দেখা দিলে, বনলতা রূপাজীবা’র পেশাটি গ্রহণ করতেন না। দুঃসময়ে কেন পাশে ছিলেন না, এই হাহাকার বনলতার বুক জুড়ে। আর এই কবিতায় আরােপিত ‘অন্ধকার’ বলে দেয়, বনলতা সেন’দের আলােকোজ্জ্বল পৃথিবীতে পাওয়ার সুযােগ নেই। ‘অন্ধকারে মুখােমুখি বসবার’ স্মৃতিটুকু সাথে নিয়ে পাখির মতােই ঘরে ফিরে যেতে হয়; যেখানে অপেক্ষা করে
সাধারণ নারী।

বনলতা সেন রচনার পচাত্তর বছর পূর্তিতে কলকাতার
আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে অশােক মিত্র জানাচ্ছেন, তিনি নিজে কবি জীবনানন্দ দাশকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এই ‘বনলতা সেন’ কে? কবি বনলতা সেন। কে এই প্রশ্নের সরাসরি কোন জবাব দেন নি। শুধু বলেছেন, বনলতা সেন নামটি কবি পেয়েছিলেন পত্রিকা থেকে। সে সময় নিবর্তক আইনে বনলতা সেন নামে এক একজন রাজশাহী জেলে বন্দিনী ছিলেন। সেখান থেকেই কবি এই নামটি গ্রহণ করেন। এই বনলতা সেন পরে কলকাতার কলেজে গণিতের
শিক্ষকতা করতেন।
কিছুদিন আগে জীবনানন্দের ডায়েরির প্রথম অংশ প্রকাশিত
হয়েছে কলকাতায়। ভূমেন্দ্র গুহের কাছে জীবনানন্দের ডায়েরি
রাখা রয়েছে । সেই ডায়েরিতে লিটারেরি নােটস্ হিসেবে Y নামে
এক মেয়ের নাম লেখা আছে। জীবনানন্দ তাঁর নিজের হস্তাক্ষরে লিখে রেখেছেন Y=শচী; এই ‘শচী’ জীবনানন্দের গল্প ‘গ্রাম ও শহরের গল্প’র শচী। ডায়েরির অন্যান্য পৃষ্ঠা বিবেচনায় ভূমেন্দ্র গুহ বলেছেন, জীবনানন্দের চাচাতাে বােন শােভনার প্রতি কবি বেশ দূর্বল ছিলেন। এই শােভনাই হচ্ছেন y বা শচী বা বনলতা সেন। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ কবি এই শােভনা মজুমদারকে উৎসর্গ করেছেন। কবি হিসেবে উপেক্ষার অনেক কঠিন সময়গুলোতে জীবনানন্দের কবিতার মুগ্ধ পাঠিকা ছিলেন শােভনা, দরজা বন্ধ করে প্রায়ই কবি শােভনাকে কবিতা পাঠ করে শােনাতেন। অর্থাৎ ভূমেন্দ্র গুহের বিবেচনায় বনলতা সেন নিখাদ প্রেমের কবিতা।আসলে বনলতা সেন কবিতায় বনলতা সেন কবির বিলুপ্ত কিন্তু শাশ্বত জীবনবোধের একটি চমৎকার চিত্রকল্প।

মোস্তফা কামাল
লেখ,গবেষক ও প্রাবন্ধিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here