হাবিবুর রহমান খান

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান বলেছেন, করোনার কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক। এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে লুটেরা শ্রেণির সামনে লাজুক হয়ে থাকলে চলবে না।

সম্প্রতি যুগান্তরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় প্রস্তুতি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ দেশের বিভিন্ন খাতে অনিয়ম, করোনা-পরবর্তী রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন খালেকুজ্জামান।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ দেশের সার্বিক দুর্নীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নীতিহীনতা দুর্নীতির উৎস। রাজনীতি, অর্থনীতি, শাসন-প্রশাসন, আইন, বিচার, শিক্ষা, সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রে গণমুখী নীতি ও দায়বদ্ধতা-জবাবদিহিতার মাত্রা যত বেশি থাকে, দুর্নীতির মাত্রাও তত কম হয়। রাজনীতি সমাজের ও রাষ্ট্রের পরিচালিকাশক্তি। ফলে রাজনৈতিক দুর্নীতির গতি অপরাপর সব দুর্নীতির গতি ও ক্ষেত্র বাড়িয়ে দেয়, ছড়িয়ে দেয়।

একটা জাতির আশা-আকাক্সক্ষা-প্রত্যাশা ও সংগ্রামী চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ও বিপরীত মুখে রাষ্ট্র প্রশাসন ব্যবস্থাকে পরিচালিত করা দুর্নীতির অন্যতম প্রধান উৎস। স্বাধীনতা-উত্তর কালের অঙ্গীকার জনগণের ক্ষমতায়নের গণতন্ত্রের কথা বলে জনগণকে ক্ষমতাহীন করার প্রক্রিয়া চলতে চলতে এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে গণতন্ত্র তো দূরের কথা, ভোটতন্ত্রও রক্ষা করা যাচ্ছে না।

পার্লামেন্ট থেকে ইউনিয়ন কাউন্সিল পর্যন্ত প্রায় ৬৬ হাজার কথিত জনপ্রতিনিধি রাতের ভোটে, টাকার জোরে, বাহুবলে, ক্ষমতার দাপটে ও প্রশ্রয়ে, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের কারসাজিতে নির্বাচিত হয়ে যান। এতে রাজনীতি জনসেবার নীতির বদলে আত্মসেবার দুর্নীতিগ্রস্ত পথে অগ্রসর হয়। রাজনৈতিক বাণিজ্য ও বাণিজ্যের রাজনীতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে থাকে। যে কারণে দেখা যায় ১৯৫৪ সালে যেখানে পার্লামেন্টে ৪ শতাংশ ব্যবসায়ী ছিল, বর্তমানে সেখানে প্রত্যক্ষ ব্যবসায়ী ৭০ শতাংশ অতিক্রম করার পর্যায়ে।

গণতান্ত্রিক প্রথা-প্রতিষ্ঠানগুলো এর সহযোগী হতে গিয়ে সেগুলোও গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে স্বেচ্ছাচার ও স্বৈরতন্ত্রের খুঁটি হয়ে দাঁড়ায়। আমলাতন্ত্র কামলাতন্ত্রের রূপ লাভ করে আর হাতেকলমের কাজের বদলে কাগজেকলমে হিসাব মিলিয়ে উপরি পাওনা লাভের পারদর্শিতায় অনিয়মের নিয়মকে স্থায়ী করে দেয়। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি এরই অংশমাত্র, কোনো ক্ষেত্রেই এ থেকে মুক্ত নয়।

খালেকুজ্জামান বলেন, করোনা দুর্যোগ অনেক লুকানো বিষয়বস্তুর সামনে থেকে পর্দা সরিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে উন্নয়নের অসার গালগল্পকে পরিহাস করে স্বাস্থ্যসেবাসহ সব শাসন-প্রশাসনিক ব্যবস্থার ভঙ্গুর দশাচিত্র হাজির করে শুধু দেশে নয়, দেশের সীমানার বাইরেও টেনে নিয়ে গিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে দর্শনীয় করে রেখেছে। শিব গড়ার দোহাই দিয়ে বানর তৈরির চেহারা কোনো ‘ভাব’ খাড়া করেই ভাব এবং মূর্তি একযোগে রক্ষা করা যাচ্ছে না।

করোনা মোকাবেলায় সরকার কতটা সফল জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার প্রচারে জনগণের কানে যত ব্যবস্থাপত্রের ও কর্মতৎপরতার বাণী পৌঁছাতে পেরেছে তার সাফল্য অনেক, কিন্তু জনগণের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তার হিসাব মেলানো কঠিন হয়ে পড়েছে দিনকে দিন। দেশে করোনার প্রথম প্রকোপ দেখা যায় মার্চ মাসে। এই সময়টাতে যে দায়িত্বশীল মনোযোগ ও যথাসম্ভব প্রস্তুতি গ্রহণে তৎপর হওয়া দরকার ছিল, তা সরকারের পক্ষ থেকে পরিলক্ষিত হয়নি।

প্রবাসীদের যথাযথ কোয়ারেন্টিন, চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের শুরুতেই উপযুক্ত সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করা এবং তা ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার ছিল। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য ছিল। তা যথাসময়ে যথোপযুক্তভাবে হয়নি। তার ওপর ভেজাল সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণে ক্ষয়ক্ষতি বাড়িয়েছে। আর্থিক প্রণোদনার ঘোষণা মালিকদের যতটুকু আশ্বস্ত ও সন্তুষ্ট করেছে, শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে তা অস্পষ্ট এবং অপ্রাপ্য থেকে গেছে।

সরকারি ত্রাণ তৎপরতা ও ব্যাপক চুরি-দুর্নীতি মানুষকে ক্ষুব্ধ ও হতাশ করেছে, যা বর্তমানে বন্যা পরিস্থিতিতেও ভাষণে-কাগজে যত প্রচার পাচ্ছে আর হাতে মানুষ যা পাচ্ছে তাতে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, এ মহামারী মোকাবেলায় সব মহলের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপক গণ-উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন ছিল। দলীয় বিবেচনা ও আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতা এ ধরনের মহাদুর্যোগ মোকাবেলায় ব্যর্থ হতে বাধ্য।

করোনা-পরবর্তী রাজনীতিতে পরিবর্তন আসবে কি না জানতে চাইলে খালেকুজ্জামান বলেন, এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের অনুমান মতে তিনটি সমভাবনা মোটা দাগে আঁকা যেতে পারে। প্রথমত, করোনাপূর্ব পরিস্থিতি যেখানে যেমন ছিল, তেমন জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার বা একই অবস্থা বজায় রেখে চলার উপায় থাকবে না।

পুঁজিবাদের আগের অবস্থা হুবহু বহাল রেখে চলতে গেলে শাসনব্যবস্থা আরও অধিক স্বৈরতান্ত্রিক-ফ্যাসিবাদী-কর্তৃত্ববাদী রূপ পরিগ্রহ করবে, ধনী-দরিদ্র বৈষম্য অবিশ্বাস্য চিত্রে দেখা দেবে। সামাজিক অস্থিরতা, পরিবারে-সমাজে সংঘাত-সহিংসতা, নারী-শিশু নির্যাতনসহ দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার বৃদ্ধি, বর্ণবাদী, জাতিগোষ্ঠীগত, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি ও যুদ্ধোন্মাদনাসহ যুদ্ধবিস্তারের লক্ষণগুলো স্পষ্ট হতে থাকবে।

দ্বিতীয়ত, যদি ব্যাপক গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার চাপে পুঁজিতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ছোট-বড় সংস্কারের মধ্য দিয়ে উদারনৈতিকতার ছাপ ও অর্থনীতিতে কিছু কল্যাণকামী পদক্ষেপ সম্প্রসারিত হতে পারে।

আর তৃতীয়ত, দীর্ঘস্থায়ী গণসংগ্রামের পথে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বদলের বৈপ্লবিক পরিবর্তনও অনেক ক্ষেত্রে ঘটতে পারে। এখন নির্ভর করে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে কারা কোন পথে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে পারবে, তার ওপরই মূলত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারিত হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here